আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের সেই কাঙ্খিত জয়

Hope is immortal

টেস্ট জয়ের আনন্দ একরকম ভুলতে বসেছিলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। ২০০৫ সালে দেশের মাটিতে প্রথম ও সর্বশেষ টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তারপর অনেকবার জয়ের খুব কাছে পৌঁছেও তার নাগাল পাননি তারা। প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে সাড়ে চার বছর পর সোমবার। কয়েক হাজার মাইল দূরে দ্বীপ দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে জয় পেয়েছ বাংলাদেশ দল।

তাই এর আনন্দের মাত্রাও অন্যরকম। এ জয় শুধু ক্রিকেটারদের নয়, ১৫ কোটি বাঙ্গালীরও। টেস্টে প্রথম ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাফল্য এসেছিল চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। সেবার দুই ম্যাচের সিরিজ ১-০ তে জিতেছিলো বাংলাদেশ। এক মাস আগে টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের কাছে হারায় নিন্দুকেরা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়।

প্রশ্ন তোলে টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে। এবার তাদেরকে ব্যাটে-বলে জবাব দিয়েছে বাংলাদেশের এক ঝাক তরুণ ক্রিকেটার। ওয়েস্ট ইন্ডিজে মাশরাফিরা ভাল খেলবে ধারণা ছিল প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলমের। এ জয় তার কাছে প্রত্যাশিতই। দলের সাফল্য মানে তারই সাফল্য।

কারণ তিনি যে জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক। দলের এমন সাফল্যে বেজায় খুশি রফিকুল আলম। এখন আশা করছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ জয়ের। "আমরা অবশ্যই সিরিজ জিতবো," বলেন তিনি। বাংলাদেশের এই সাফল্যের পর সমালোচকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন প্রধান নির্বাচক।

তিনি বলেন, "অনেকেই হয়তো বলবেন, এটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল দল না। তাদেরকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই। আইসিএলে ক্রিকেটাররা যোগ দেওয়ায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কিন্তু আমাদের সেরা একাদশ খেলাতে পারিনি। তারপরও সেটা বাংলাদেশ দলই ছিল। " মাত্র একটা ইনিংসের ব্যাটিংই বদলে দেয় বাংলাদেশ দলকে।

প্রথম ইনিংসে ২৩৮ রানে অল-আউট হয়ে যে শঙ্কায় পড়েছিল দল দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরি (১২৮ রান), জুনায়েদ সিদ্দিকীর ৭৮ এবং মুশফিকুর রহিমের ৩৭ রানে তা অনেকটা কেটে যায়। জয়ের বাকি কাজটুকু সারেন উজ্জীবিত বোলাররা। এর আগে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেই ২০০৪ সালে বীরদর্পে লারাদের কাপিয়ে দিয়েছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সেবার জয় না পেলেও লারার দলের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ ড্র অনেক কিছু। হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ পাইলটরা সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে সাফল্যের ছোট একটি চারা রোপন করে এসেছিলেন।

সে গাছই পাঁচ বছর পর জয় নামের সুস্বাদু ফল দিয়েছে। হাবিবুল বাশার এই সাফল্যকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিবর্তনের ছোঁয়া মনে করছেন। তিনি বলেন, "একটি জয় খুব দরকার ছিল। আমরা সেটি পেয়েছি। যদিও এই জয় নিয়ে অনেক রকম কথা হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ জিতেছে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই জিতেছে। " জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, "বাংলাদেশ দলের এই সাফল্য নিয়ে সমালোচনা করা ঠিক হবে না। বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বাহবা দেওয়া উচিত। কারণ হারলে আমাদের জন্য অনেক খারাপ হতো। " দেখতে দেখতে ৬০টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ।

শেষ ম্যাচটি জিতেছে। জাতীয় দলের আরেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট এ জয়কে মনে করছেন সমালোচকদের সমালোচনার জবাব হিসেবে। পাইলট বলেন, "কার সঙ্গে খেলছি, কে আমাদের সঙ্গে খেলছেÑ এটা বড় কথা নয়। আমরা কতটা ভাল খেলে টেস্ট জিতেছি সেটাই আসল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দলের বিপক্ষে আমাদের সাফল্য।

আমি অভিনন্দন জানাই ক্রিকেটারদের। " বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের চাপের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারার নজির আছে। হয় তাড়াহুড়া, নয় অধৈর্য গ্রাস করে তাদের। তবে এবার অন্যরকম টেস্ট খেলেছে জাতীয় দল। গাজী আশরাফ হোসেন লিপুও মানছেন এই প্রথম ধারাবাহিক ক্রিকেট খেলেছে বাংলাদেশ দল।

তিনি বলেন, "ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড যখন গেইলদের নামাতে পারলো না, তখন বিকল্প দলের বিপক্ষে ভাল খেলার একটা চাপ তৈরি হয়। " সে চাপ সামলে ক্রিকেটাররা সফল হওয়ায় তাদেরকে অভিনন্দন জানান লিপু। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ১০ বছর হতে চলেছে। বিদেশে এটি দেশের প্রথম টেস্ট সাফল্য হলেও সিরিজ জয়ের প্রত্যাশা এখন ক্রিকেট অনুরাগীদের। কেননা তা হলে টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের পয়েন্টের ঘরে আমাদের আর শূন্য থাকবে না।

ক্রিকেটামোদীরা বলছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ক্রমেই অতল জলের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। এ বিজয় তাই হঠাৎ আলোর ঝলকানি এবং অবশ্যই 'ঝলমল করে চিত্ত'। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ বিশ্বাস করেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এই জয় আগামীতে বিজয়ের নতুন পথরেখা সৃষ্টি করবে। আশরাফুলকে সরিয়ে দিয়ে দলনেতার পতাকাটি মাশরাফির হাতে তুলে দেওয়ার পর এই বিজয়ের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। কুসংস্কারে যাদের আস্থা রয়েছে তারা অনায়াসেই বলতে পারেন_ অপয়া জামানা শেষ হয়েছে।

সৌভাগ্যের বরপুত্র মাশরাফি বাংলাদেশ দলকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারেন। 'হ্যারিওন'_ ক্যারিবীয়রা তাদের ভাষায় সেন্ট ভিনসেন্টকে এই নামেই ডাকে। বাংলায় শব্দটির অর্থ 'আশীর্বাদের দ্বীপ'। সোমবার সেই আশীর্বাদের দ্বীপেই মাশরাফি-সাকিবরা লাল-সবুজ পতাকা ওড়াল। পুরো দেশকে টেনশনের রাত জাগিয়ে সেন্ট ভিনসেন্টের বিকেলে ইতিহাস লিখল তারা।

দেশের বাইরে এই প্রথম কোনো টেস্ট জিতল বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। দশ বছর বয়সী টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশের এটি দ্বিতীয় জয়। চট্টগ্রামের মাঠে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর অপেক্ষায় থাকতে হলো চারটি বছর। মাঝে বারবার সমর্থকদের হৃদয় ভেঙেছে। লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়েছে অনেকবার।

টেস্ট খেলুড়ে অন্য দেশগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু মাশরাফিদের পথচলার জন্য গর্বিত হওয়া যেতে পারে। ভারত বিদেশের মাটিতে গিয়ে ৩৫ বছর পর টেস্ট জিতেছিল। ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিদেশে গিয়ে পাকিস্তানের টেস্ট জিততে। আর শ্রীলংকার লেগেছিল ১৪ বছর, সেখানে আমরা বিদেশ জয় করেছি মাত্র ৯ বছরে। লোকে বলছে, ক্রিস গেইলরা এই টেস্ট বয়কট করেছেন বলেই জিততে পেরেছে বাংলাদেশ।

মাশরাফির প্রশ্ন, 'আমরা তো কাউকে খেলতে বারণ করিনি। আমরা আমাদের নিজেদের খেলার উন্নতি করতে চেয়েছিলাম। সেটিই করতে পেরেছি। ' সবাই জানে, রাতারাতি বানানো ক্যারিবীয় দলটির অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের যে দলটি খেলেছে, অভিজ্ঞতা কি তাদের খুব বেশি? আইসিএলে ১৪ ক্রিকেটার চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দলে ৭ জনের অভিষেক হয়েছে।

এই ম্যাচেও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আর রুবেল হোসেনের অভিষেক হলো। রাকিবুল হোসেন ৪ আর ইমরুল কায়েসেরও টেস্টের সংখ্যা ছিল ৪। জুনায়েদ সিদ্দিকী আর তামিম ইকবাল ১০টি করে টেস্ট খেলেছেন বটে, তবে তাদের সবার জন্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট উইকেট ছিল অজানা। মাশরাফির অনুপস্থিতিতে টেস্টে শেষ তিন দিন যে সাকিব আল হাসান দল চালিয়েছেন, তারও অভিজ্ঞতা ১২ ম্যাচের। বিপক্ষের শক্তি সম্পর্কেও অস্বচ্ছ ধারণা ছিল তাদের।

আর সে কারণেই প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং-বোলিং দু'দিকেই টানাপড়েন গেছে। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য তা শুধরেছেন ব্যাটসম্যানরা। তামিম তার ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। প্রথম ইনিংসে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের ব্যর্থতার পরও অধিনায়ক মাশরাফি দলের স্কোর ২৩৮ পেঁৗছে দিয়েছিলেন। ইনিংস সর্বোচ্চ ৩৯ রান এসেছিল তার ব্যাট থেকেই।

সেই সঙ্গে শাহাদাত হোসেন রাজীবও ক্যারিয়ার সেরা ৩৩ রান যোগ করেছিলেন দলের স্কোরে। ক্যারিবীয়রা কিন্তু বাংলাদেশিদের এই স্কোর টপকে প্রথম ইনিংসেই ৩০৭ রান তুলেছিলেন। ৬৯ রান পিছিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে তামিমের সেঞ্চুরিতে ভর দিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল ৩৪৫ রান। জিততে হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে টার্গেট তখন ২৭৭ রানের। সোমবার রিয়াদের ৫ আর সাকিবের ৩ উইকেট দখলেই ১৮১ রানে গুটিয়ে যায় ক্যারিবীয় ইনিংস।

আর তাতেই ৯৫ রানের জয় নিশ্চিত বাংলাদেশের। ১-০ ম্যাচে এগিয়ে থেকেই আগামী শুক্রবার গ্রানাডার সেন্ট জর্জে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে খেলতে নামবেন সাকিবরা। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়টাকে যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের 'টার্নিং পয়েন্ট' ধরা হয়, তাহলে ২০০০ সালে টেস্ট অভিষেক, ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় এবং ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে এই বিজয়কে উজ্জ্বল অধ্যায় বলে মানতেই হবে। তথ্যসূত্রঃ বিডিনিউজ সমকাল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.