কালের শপথ
লেখাটি বিষয় কিছুটা রীতি বহির্ভূত মনে হলেও আমার মনে হয় পাঠক সকলেই এ সমস্যা নিয়ে সম্যক অবগত। প্রচন্ড বিরক্তি আর সচেতন নাগরিক হিসাবে বা নিকট কেউ যাতে প্রতারিত না হন, সে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই আমার লেখা।
রাস্তাঘাটে, বাজার-হাটে কিংবা স্টেশন, বন্দরে বিভিন্ন গাছের সাথে কিংবা লাইটপোস্টের গায়ে ঝোলানো অথবা যারা নিয়মিত বাসে চলাচল করেন, তাদের বোধহয় একটি বিষয় প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে। আর তা হলো হাপানি, পাইলস আর পুরুষত্বহীনতা দূরীকরণের বিজ্ঞাপণগুলো। অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায়, কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপণগুলো বাসের ভেতরে জানালায় কিংবা ড্রাইভারের সামনের কাঁচটিতে সেটে থাকা পোস্টারগুলোর বক্তব্য প্রায় একই।
সেদিন দেখলাম একটার পাশে আবার কাবা শরীফের ছবি সেঁটে দেয়া হয়েছে। নোংরামীর চুড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে যেতে দেখে একবার ভাবলাম, পোস্টারের নিচের মোবাইল নাম্বারটাতে রিং দিয়ে কয়েকটি গালি পাঠিয়ে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম। আবার প্রায়ই দেখা যায় কিছু বোরখা পড়া মহিলা স্টপেজগুলোতে বাসের জানালা দিয়ে ছোট ছোট বিজ্ঞাপনের কাগজ ফেলে দিচ্ছে যাত্রীর কোলে। গরীব এই মহিলাগুলো সারাদিন কষ্ট করে ১০০-১৫০ টাকা রোজগারের আশায় এ পেশা বেছে নিয়েছে।
এসব লিফলেটের বক্তব্য ঐ একই। হাপানি নির্মুল, পাইলস নিশ্চিহ্ন আর আগা মোটা,গোড়া চিকন, আকারে ছোট, বিয়ের আগে ভয় আর অশ্রাব্য যত শব্দ। প্রথমত দুটি কমন সমস্যা হচ্ছে হাপানি আর পাইলস। বিজ্ঞাপণ গুলোতে ২৪ ঘন্টার ভেতরে ফলাফলের গ্যারান্টি দেয়া হয়। দেশজুড়ে এত প্রচারণায় মনে হয় বাংলাদেশীরা জাতীয়ভাবে হাপানি, পাইলস আর আগা মোটা, গোড়া চিকন,আকারে ছোট (কথাগুলো এভাবে বলতে চাইনি, কিন্তু বিজ্ঞাপনে ভাষা আরও নোংরা) সমস্যায় ভুগছে।
আমার অফিসের এক কর্মচারী, যার সমস্ত বস হচ্ছেন ডাক্তার, ছোটবেলা থেকেই হাপানির রোগী। এ রোগীদের র্দুভাগ্য এটাই যে, এ রোগটি স্টাবলিসড হয়ে গেলে পুরোপুরি নির্মুল করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু একজন রোগী কিছু নিয়ম মেনে চললে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ খেলে আজীবন সুস্থ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারেন। সে মনভোলানো বিজ্ঞাপনে নিয়মিত ঔষধ খাবার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে এক পীরের কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে আসল। আমাকে অফিসে এসে দেখাচ্ছে, স্যার, অমুক স্যারের ঔষধ অনেকদিন খেলাম (স্বনামধন্য চেস্ট স্পেশালিস্ট), অসুখ তো পুরা ভালো হয়না।
এক পীর সাহেবের কথা শুইনা তার কাছ থেকে স্বপ্নে পাওয়া হারবাল ঔষধ নিয়া আসলাম।
পীর বললো সারা জীবনে আর কিছু খাইতে হবেনা, এটা খাইলেই হবে।
আমি বলি, তুমি এত ডাক্তারের অধীনে কাজ করে পীর সাহেবের কাছ থেকে ঔষধ আনলে?
আপনি একটু দেখেন। ছোট্ট একটা কাগজের পোটলা, তার ভেতরে অর্ধেক করে রাখা কিছু ট্যাবলেট। দেখে আমি তো হতবাক।
হায়রে বাঙ্গালী।
বললাম, এই তোমার হার্বাল ঔষধ!! এগুলো তো স্টেরয়েড আর এরকম ট্যাবলেট বানাতে গেলে তো কয়েক কোটি টাকার মেশিন লাগে। পীর সাহেব কি সরাসরি এগুলো স্বপ্নে আমদানি করে নাকি মেশিনে বানায়? আর এ ঔষধ সারা জীবন খেয়ে গেলে তো তোমার কিডনী, লিভার সব যাবে।
আমি তাকে দুটো টুকরো মিলিয়ে দেখালাম। একটা ঔষধ কোম্পানীর নামও বোঝা গেল।
সব দেখে শুনে সে পুরো বোকা বনে গেল। আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু স্যার হাজার হাজার মানুষ তো তার কাছ থেকে নিয়ে এই ঔষধই খাচ্ছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,আর এজন্যই তো হাসপাতাল আর ডাক্তার চেম্বারে দিন দিন লিভার আর কিডনী সমস্যার রোগীর ভীড়ও বাড়ছে। এই হলো আমাদের সচেতনতার নমুনা।
পাইলস রোগটি মূলত যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তারাই বেশি ভোগেন।
টয়লেটের সময় রক্ত যায়। এ নিয়ে আরেকদিন লিখব, পোস্ট বড় হয়ে যাচ্ছে। তবে মনে রাখা দরকার, এটি ১ ডিগ্রী, ২ ডিগ্রী ও ৩ ডিগ্রী হিসাবে চিকিৎসা করা হয়। ২ ডিগ্রী ও ৩ ডিগ্রীর চিকিৎসা মূলত সার্জারী। বাংলাদেশে অত্যন্ত সুলভে মেডিকেল কলেজ, জেলা সদর হাসপাতাল সহ প্রায় সকল হাসপাতালে এর সার্জারী সম্ভব।
পিজি হাসপাতালসহ ঢাকার কিছু বেসরকারী হাসপাতালে না কেটেই বিশ্বমানের অপারেশন হচ্ছে। সম্প্রতি কিছু ভালো ঔষধও বাজারে এসেছে, ১ ডিগ্রীর জন্য কাজে দেয়। তবে প্রচলিত অপচিকিৎসায় সাময়িক ভালো বোধ হলেও শেষ পর্যন্ত দেরী করার কারনে ১ ডিগ্রীর রোগীরা যখন সার্জনের কাছে যায়, তখন অলরেডি প্রমোশন হয়ে রোগ ২ বা ৩ ডিগ্রী হয়ে গেছে।
পাশ্চাত্যে ইন্টারেস্টিং রোগগুলোর মাঝে, 'বাংলাদেশী সিনড্রোম' নামে একটি রোগ আছে, যার শতকরা ৯০ ভাগ রোগীই মূলত বাংলাদেশী। এসব সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীরা ডাক্তারদের কাছে উপরোক্ত কয়েকটি মোটা-চিকন,ছোট-বড় মার্কা যৌন সমস্যা নিয়ে যান এবং হাসির পাত্রে পরিণত হন।
এমনই সিনড্রোম যে তার নামই হয়ে গেছে দেশের নামে। পাশ্চাত্যে হাসির কারণটি হচ্ছে, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আর অসচেতনতা। সস্তা বিজ্ঞাপণে আমরা জাতীয়ভাবে এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে মনে হয় সমস্যাগুলো আসলে বাস্তব। অথচ অসাধু এক শ্রেনীর ব্যবসায়ী আমাদের পুরো জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। পাঠকের সচেতনতার জন্য এতটুকু বলছি যে বাহ্যিক কোন আকার-আকৃতি কোন প্রয়োজনের মুহূর্তে কোন সমস্যার জন্ম দেয়না, কারণ ব্যক্তিগত জীবনে সুখী হবার জন্য আকার-আকৃতির ভূমিকা অতি নগণ্য।
পোস্টের শালীনতার রক্ষায় এর বেশি বলতে পারছিনা, তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। স্বাভাবিক যে কোন ব্যক্তিরই এজাতীয় কমপ্লেন থাকতে পারে। যতক্ষণ না ব্যক্তিগতভাবে সত্যিকারের সমস্যা ফিল করছেন, এ চিন্তাগুলোকে আপনি র্নিদ্বিধায় ইগনোর করতে পারেন। আর সমস্যা হলে ডাক্তার তো আছেনই। তবে এমন কোন ঔষধ নেই, যা ঐসব সমস্যার সমাধান করতে পারে।
যদি কেউ পারেই, রিস্ক আপনার। যত ঔষধ প্রেসক্রাইব করা হয়, সবই ফাংশনাল স্টিমুলেটর। অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে দৌড়ান। মনে রাখা দরকার, তারা হচ্ছেন যৌন ও তৎসংক্রান্ত রোগের চিকিৎসক, ফাংশনাল কোন প্রবলেম তারা চিকিৎসা করেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রব্লেমটি নেহায়েতই মানসিক দুর্বলতা।
এজন্য ভূক্তভোগীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছেই যেতে হবে।
স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আমাদের জানার পরিধি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সঠিক বিষয়টি না জানার কারনে আমরা প্রায়শই বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুকির মাঝে পড়ে যাই। আপনার আপনজনকে পরামর্শ দিন যে, কোন ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে কার্পন্য না করতে। ভিজিট দিয়ে প্রাইভেটভাবে না দেখাতে চাইলে সিম্পলি সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালের আউটডোরে ৫-২০ টাকার টিকিটে ভালো পরামর্শ ও সেবা পাওয়া সম্ভব। নানা অভিযোগের মাঝেও সেখানে ভালো সেবা পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু সেটুকু পেতে খানিকটা উদ্যোগী হওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।