মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে...
কালিদাস এবং ... - ১
কালিদাস এবং ... - ২
কালিদাস এবং ... - ৩
কৃতজ্ঞতাঃ
জাফর উল্লাহ্ এবং জোয়ানা কির্কপ্যাট্রিক অনূদিত “An Illustrated Meghaduta by Mahakavi Kalidas” থেকে মেঘদূত কবিতার বাংলা পংক্তি এবং ছবিগুলো নেয়া, প্রকারন্তরে যা নরেন্দ্র দেবের “মেঘদূত” (দে প্রকাশনী, কলকাতা, ইন্ডিয়া; ১৯৯৮; ISBN 81-7612-145-2) কাব্যগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। লিঙ্কগুলো এবং মাঝে মাঝে স্তবকের নীচের তথ্য গুলো আমার সংযোজন।
***বিষয়বস্তু এবং ছবিগুলো সকল বয়সী পাঠকের উপযুক্ত নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পাঠকের শৈল্পিক বিবেচনাবোধের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
উত্তর মেঘ
***
১
***
বিদ্যুৎলতা ললিতা বণিতা-ইন্দ্রধনুর চিত্র প্রায়,
বাজে মৃদঙ্গ সঙ্গীত সুরে গম্ভীর গুরু মূর্চ্ছনায়;
গগনলগন মণিময় পুরী রচিত সেথায় দেখিবে জানি,
তোমার তুল্য অতুলন তারা, স্নেহনীরে ভরা হৃদয়খানি।
২
***
লীলা কমলেতে বিধৃত কর, অলকে শোভিছে কুন্দ কলি,
লোধ চূর্ণে চর্চিত মুখ পান্ডু আননে চন্দ্রাবলী;
নবকুরুবকে সজ্জিত চূড়া; কর্ণে সুচারু শিরীষ দুল,
সীমন্তে দোলে তব স্নেহ-জাত বধূজনপ্রিয় কদমফুল।
৩
***
মত্ত ভ্রমর গুঞ্জরে সদা, তরুশাখে ফোটে পুষ্প নিতি
কলাপোজ্জ্বল ভবনশিখীর কেকারবে জাগে চিত্তে প্রীতি;
হংসশ্রেণীর রচিত মেখলা নিত্য নলিন-পদ্ম সরে
নিত্য-জোৎস্না-হসিত সন্ধ্যা সতত যে পুরী দীপ্ত করে।
৪
***
আখিঁ ঝরে শুধু পুলকে যেথায়, দুঃখশোকের চিহ্ন নাই,
কুসুম-শরের আঘাতে কেবল আনন্দ-তাপ যেথায় পাই;
প্রণয়-কলহ ভিন্ন যেথায় সুখে আছে সবে দ্বঙ্গহীন,
বিত্ত যেথায় নিত্য পূর্ণ, চির যৌবনে যাপিছে দিন।
৫
***
শুভ্রমনির হর্ম্যে যেথায় জ্যোতির ছায়ায় রচিত ফুল,
যক্ষেরা যেথা যাপে আনন্দে সাথে ল’য়ে প্রিয় প্রেয়সীকুল;
কল্পতরুর সজ্ঞ্যাতসুধা, মধুরতি ফল সেবি’ছে সুখে,
গম্ভীর তব নির্ঘোষ রব-পুষ্কর-প্রীতি জাগায়ে বুকে;
৬
***
মন্দাকিনীর শিশির সলিলে সিক্ত বাতাশ শীতল যেথা,
তীরে শোভা তার মন্দারতরু, ছায়া দানে নাশে নিদাঘ সেথা।
অমরবালারা লয়ে মুঠি মুঠি ছড়ায় বালুকা কনকভাতি,
গুপ্ত মণির অনুসন্ধানে ক্রীড়ারত সবে আমোদে মাতি।
৭
***
বিশ্ব-অধরা সুন্দরীদের নীবির বাঁধন শিথিল হেরি’
প্রণয়ীজনেরা কটি হতে যেথা বসন ঘুচাতে করে না দেরি!
লজ্জাবিমূঢ়া তরুণীরা ত্বরা মুষ্টিপূর্ণ ফেলিয়া চূর
বৃথা করে শ্রম রত্নদীপের প্রদীপ্ত শিখা করিতে দূর!
৮
***
আকাশচুম্বী প্রাসাদচূড়ায় হে মেঘ, তোমারে লইয়া সাথে,
বাধাহীন গতি বায়ু দিত দেখা, সুক্ষ্ম সুজল কণিকা পাতে
পশি’ বাতায়নে প্রাচীর-চিত্র দূষিত করিলে জাগিত ভয়
বাষ্প আকারে পলাইতে সে যে গবাক্ষে ঠেকি’ চূর্ণ হয়।
৯
***
মেঘ-ছায়া-হীন চন্দ্র-ধবল নিশীথ রাত্রে অঙ্গনারা,
প্রিয়তম-ভুজ-বন্ধন হ’তে মুক্তি লভিয়া ক্লান্ত তারা;
জুড়াতে তাদের অঙ্গের গ্লানি ঢেলো জলকণা একটুখানি,
চন্দ্রকান্ত মণিজালে ঘেরা চন্দ্রতাপের ঝলরটানি।
১০
***
অক্ষয় নিধি রক্ষি’ছে যারা বসি’ প্রতিদিন যক্ষপুরে,
যেথা ধনপতি কুবেরের খ্যাতি সকল কন্ঠে নিত্য ঝুরে;
ল’য়ে অপ্সরী বারনারী যত বৈভ্রাজের ঐ কুঞ্জে নিতি,
হেরিবে ফুল কিন্নর দল মধুরসালাপে জানায় প্রীতি।
১১
***
সূর্য উদয়ে দেখা যায় যেথা গত যামিনীর অভিসারিকা
রেখে গেছে পথে কত চারু স্মৃতি, তনু হ’তে ঝরা পত্র-লিখা,
ত্বরিত-গমন-স্পন্দনে চ্যুত মন্দার ফুল অলক হ’তে,
স্বর্ণ-কমল কর্ণাভরণ খসিয়া কোথাও পড়েছে পথে;
গুরু নিতম্ব ত্যজি’ ধূলি’ পরে মুক্তা মেখলা লুটিছে তার,
শঙ্কা-উতল উরসের স্ফীতি ছিন্ন করেছে কন্ঠহার।
১২
***
ধনপতি সখা মহাদেব নিজে আনন্দে যেথা করেন বাস
যাঁর ভয়ে মন্মথ আর স্পর্শ করে না পুষ্প-পাশ,
অলিগুঞ্জিত ফুলশরে তাঁর কুসুমধন্বা না-পারে যাহা,
কৃষ্ণপক্ষা নয়নের কোণে চতুরা বণিতা সাধিছে তাহা,
ঘনকালো দুটি ভ্রুধনুতে যেন মদন-সায়ক সমুদ্যত,
কামীজন চিতে অমোঘ যে বাণ সন্ধানি’ করে মর্মাহত!
১৩
***
চাহিলেই যেথা পূর্ণ করিছে যা-কিছু কামনা কল্পতরু,
নিমেষে ভরিয়া ওঠে ফুলে ফলে ইচ্ছামাত্র যেথায় মরু;
কত বিচিত্র বেশভূষা দেয়, শোভায় নয়ন ধাঁধিয়া যায়,
করে সুধারসে বিহ্বল আঁখি, আঁকে অলক্ত কমল পা’য়।
১৪
***
কুবের আলয় উত্তরি’-পাবে উত্তরে মোর আবাস, যার
দূর হ’তে দেখে মনে হবে গড়া ইন্দ্রধনুতে তোরণ দ্বার।
একধারে তুমি দেখিবে একটি শিশু মন্দার বাড়িছে ধীরে,
পত্নী আমার তনয় তুল্য পালিছেন তারে স্নেহের নীরে।
ছোট্ট তরুটি মেলি’ কচি বাহু ফুলভারে এত পড়েছে নুয়ে
মনে হবে যেন পাওয়া যাবে ফুল কর প্রসারণে শাখাটি ছুঁয়ে
১৫
***
মরকত-শিলা-গঠিত-সোপান দীর্ঘিকা আছে ভবনে মোর,
ফুটিতেছে সেথা নীলমাণিকের মৃণালে কনক-কমল কোর;
হংস মিথুন সুখে করে কেলি, মানসে যাবার নাহিক সাধ
হেরি’ তোমারেও বিচলিত তারা হবে না হে, শোনো এ সংবাদ।
১৬
***
সেই বাপীতটে ইন্দ্রনীলের রচিত শৈল হেরিবে তুমি
আমার প্রিয়ার অতি প্রিয় ঠাঁই-কনক-কদলী-কানন ভূমি!
সেথায় তোমার সুনীল অঙ্গ হেরি বিজড়িত বিজলী রাগে,
মিলন-মধুর সজল-রাতের কত সুখ-স্মৃতি স্মরণে জাগে।
১৭
***
মাধবী-কুঞ্জ ঘেরা কুরুবকে কত সুন্দর হেরিবে সেথা
চঞ্চল-শাখা রক্ত-অশোক, হাসে পাশে তার বকুল যেথা।
তোমার সখীর বাম পদাঘাত চাহে একজনা আমার সাথে,
অন্যজনের আকাঙ্ক্ষা – লভে’ মুখামৃতের স্বাদটি যাতে।
১৮
***
মধ্যে তাদের স্ফটিক-ফলক কাঞ্চনময় দন্ডে রাজে,
দন্ডমূলের মণির বাঁধন তরুণ বেণুর বর্ণে সাজে,
নীলাভকন্ঠ ময়ূর তোমার বন্ধু যেথায় দিনের শেষে
প্রিয়ার বলয়-শিজ্ঞ-তালে নৃত্য করিতে বসিত এসে।
১৯
***
তুমি সজ্জন, রাখিও স্মরণ লক্ষণ যা-যা বলি হে শোনো-
দেখিবে যেথায় দুয়ারে অগ্রে শঙ্খ পদ্ম চিহ্ন কোনও,
সূর্য লুকালে অস্ত আড়ালে কমল যেমন দেখায় স্নান,
দেখিবে এখন আমার বিহনে আধাঁর সে পুরী শূন্য-প্রাণ!
২০
***
শিশু-করী সমধরিও আকার, তবে সখা ত্বরা পশিবে সেথা,
প্রমোদ-গিরির রম্য আসনে বসিলে তোমায় মানাবে যেথা।
জোনাকী পুঞ্জ চমকি’ যেমন ক্ষণে ক্ষণে হানে মৃদুল জ্যোতি,
তেমনি স্বল্প তড়িৎ প্রভায় হোক গৃহে মোর তোমার গতি।
২১
***
তন্বী তরুণী, শ্যামলিম তনু, শিখরোজ্জ্বল দশন পুট,
পক্ব বিম্ব অধর ওষ্ঠ, ক্ষীণ কটি তার, নাভিটি কূট,
চকিত-হরিণী নয়নের দিঠি, অলস গমনা শ্রোণীর ভারে;
কুচ চাপে নত যুবতী-যেন বা বিধাতে প্রথম সৃজিল তারে।
২২
***
স্বল্প-ভাষিণী ললিত ললনা, সে যে গো দ্বিতীয় জীবন মোর,
সাথীহারা যেন চক্রবাকীটি মাপিছে একাকী বেদনা ঘোর।
দীর্ঘ দিনের গুরু উদ্বেগ উৎকন্ঠায় শীর্ণা বালা,
শিশির-মথিতা পদ্মিনী হেন রুপহীনা-সহি’ বিরহ জ্বালা।
২৩
***
তিক্ত রোদনে সিক্ত নয়ন, উষ্ণ গভীর দীর্ঘশ্বাস,
বিবর্ণ দুটি রাঙা ঠোঁট তার, দেখিবে প্রিয়ার মলিন বাস,
শ্লথ কুন্তলে আবরিত মুখ-মেঘে যেন ঢাকা চাঁদের প্রায়,
রাখি’ করতলে ক্লিষ্ট কপোল বেদনা-বিভল দিবস যায়।
২৪
***
ফুটল আকাশে দিনের আলো সে ব্যাকুল দেখিবে পূজার তরে,
হয়ত কখনো শীর্ণ আমার মূর্তিটি স্মরি চিত্র করে,
মধুর বচনে কভু সারিকায়* শুধায় হয়ত’ – রসিকা, ওরে,
প্রভুর কথা কি মনে পড়ে সারি? ভালবাসিতেন তিনি যে তোরে!
* সারিকা - শালিক
২৫
***
হেরিবে সৌম্য, ম্লান বেশবাস, বীণাখানি তার পড়িয়া কোলে,
আমার নামে যে সঙ্গীত রচি সাধ জাগে তার সুরটি তোলে;
নয়ন সলিলে তন্ত্রী ভিজিয়া হানে সাধে বাদ বারংবার,
দোষ যদি সারে, সুর যায় ভুলে – এম্নি কাতর হৃদয় তার।
২৬
***
হয়ত দেখিবে গণিতেছে দিন দেহলী হইতে নামায়ে ফুল।
কতদিন আর বাকি ফিরিবার, হিসাবের তার না হয় ভুল।
কিংবা হয়ত কল্পনা লোকে মিলনের স্মৃতি স্মরিছে মনে,
বিরহিনী নারী এইভাবে জেনো ভুলায় নিজেরে বিরহ ক্ষণে
২৭
***
রহি’ সারাদিন কর্মে নিরত আপনার গৃহে প্রেয়সী মোর,
বিচ্ছেদ ব্যথা চাহে পাশরিতে, কিন্তু, নামিলে রজনী ঘোর
পারে না সহিতে বিরহ বেদনা; যেও বাতায়নে তখন তুমি,
কহি মোর কথা কোরো তারে সুখী, বিনিদ্র সে যে, শয্যারভূমি!
২৮
***
কৃশতনু তার বিরহশয়নে একপাশ আধো মিশিয়া আছে
প্রাচীকোলে যেন ক্ষীণ-কলা শশী। যেও সাবধানে প্রিয়ার কাছে।
আমার সঙ্গ-সুখ-ভোগে তার মনে হ’ত যেন ক্ষণিক রাত!
বিরহে যে রাতি কাটে না যে আর, করিছে তপ্ত অশ্রুপাত।
২৯
***
সুধা-কৌমুদী অনিন্দ্যপদে গবাক্ষ দ্বারে দাড়াঁলে এসে,
পূর্ব প্রীতির পরিচয়ে প্রিয়া নেহারিবে জানি নির্নিমেষে;
হয়ত সহসা আবরিয়া আখিঁ অশ্রুসাগরে ভাসিয়া যাবে,
দেখে মনে হবে স্থল-কমলিনী ফুটেও ফোটেনি পূর্ণভাবে।
৩০
***
নিঃশ্বাস তাপে বিরস অধর-কচি কিশলয় ক্লিষ্ট প্রায়,
রুক্ষ সিনানে অলক কঠিন বিঁধিছে গণ্ডে চপল বায়;
স্বপনে মিলন ঘটিবে হয়ত, ঘুমায়তে চাহে ইহারই আশে,
নয়ন সলিল উথলি’ ঘুচায় আখিঁ পাতে ঘুম যেমনি আসে।
৩১
***
বিদায় বেলায় ছিঁড়ি’ ফুল হার একটি যে বেণী বেঁধেছে সেই,
ফুরালে আমার কুবেরাভিশাপ স্বগৃহে আবার ফিরিব যেই-
আমারই হাতে সে খুলিবে বেণীটি, মনে মনে জানি করেছে পণ;
শুষ্ক কঠোর কেশ কন্টক বিঁধিছে কপোলে অনুক্ষণ,
বাড়িয়াছে নখ চাঁপার আঙুলে-সেকথা নাহি যে স্মারণ তার,
দেখিবে হয়ত সরায় অলক সেই হাতে ভুলে বারংবার।
৩২
***
ত্যাগ করি’ তার অঙ্গভূষণ দুঃখে মনের শয্যালীন,
কান্ত কোমলা অবলা বালা সে, কৃশতনু তার বিরহে ক্ষীণ,
হেরিয়া তাহারে নবজলধারে অশ্রুমোচন করিবে জানি,
সদয় হৃদয় সুজনেরা প্রায় বাঁচায় আর্তে করুণা দানি।
৩৩
***
অবগত আমি তব সখী-হৃদি, আমার প্রতি সে দরদে ভরা,
জীবনে এই তো প্রথম তাহার বিরহ-বেদনা সহ্য করা!
বাচালতাময় উক্তি ই-নয় পত্নী-প্রেমের অহংকারে,
সত্য মিথ্যা এখনি তো তুমি জানিবে সকলি হেরিলে তারে।
৩৪
***
তৈলশূন্য কুন্তল জালে আয়ত লোচন পড়েছে ঢাকা,
অজ্ঞনহীন নয়ন প্রান্তে কটাক্ষবাণ নাহিক’ আঁকা;
মদির-অলস ভ্রু-বিলাস ভুলে মৃগাক্ষী মোর তোমার প্রাণে,
তুলি’ আঁখি দুটি চাহিবে যখন, স্পন্দন ঘন জাগিবে প্রাণে,
হয়ত ফুটিবে নয়নে তখন চাহনি চপল কৌতূহলে,
যেন চঞ্চল মীনদল ক্ষোভে আহত কমল কাঁপিছে জলে!
৩৫
***
মুক্তা-মেখলা নিতম্বে তার নখ-লাঞ্জন শূন্য মোর,
দৈববিপাকে বর্জিত আজ সেই পরিচিত ভূষণ ডোর;
সম্ভোগ শেষে ক্লান্তি হরিতে পদসেবা যার করেছি সাধে,
সেই বাম উরু সরস কদলী কাঁপিছে হয়ত সুসংবাদে।
৩৬
***
পহুঁচিয়া সেথা, শুনহে জলদ! নিদ্রিতা যদি দেখহে তারে,
শব্দ কোর না, রহিও নিরবে একটি প্রহর শয়নাগারে।
যদি সে স্বপনে পেয়ে থাকে মোরে বাহু-বন্ধনে আপন বুকে,
গর্জনে তব ছিন্ন কোরো না সেই আশ্লেষ-আবেশ-সুখে।
৩৭
***
তব জলকণাসিক্ত শীতল বাদল বাতাসে মেলিবে আখিঁ,
নব নব রুপে মালতী মুকুল, তুমি এসো তার সুরভি মাখি’!
তোমার সখীর ঘুম নিও হরি’ বাতায়ন পথে প্রবেশি’ ধীরে;
মানিনী যখন মুখপানে তব বিলোল নয়নে চাহিবে ফিরে,
বিজলী-ঝলকে স্তিমিত নয়না হবে চোখে-চোখে তোমার সনে,
বোলো মোর কথা কানে কানে তারে অত মৃদু মধু গুঞ্জরণে!
৩৮
***
বলিও তাহারে-‘আয়ুষ্মতি গো! বন্ধু আমার দয়িত তব,
জীমূত আমার নামটি, তোমারে প্রিয়জন বাণী বাখানি’ কব!
গৃহে ফেলে আসা প্রিয়ার বেণীর বাধঁন মোচনে ব্যাকুল মন
প্রবাসী জনেরে আশা দিতে মোর মধুর মন্দ্রে এ গর্জন!’
৩৯
***
প্রেয়সীরে মোর একথা কহিলে চাবে মুখ তুলি’ তোমার মুখে,
জানকীর পাশে পবন-তনয়** লভিল আদর যেমতি সুখে-
তুমি হে সৌম্য, পাবে সেই মান স্বামী-সন্দেশ সখিরে কহি’,
সুহৃদ্ বচনে সান্ত্বনা পাবে বিরহে যে হৃদি যেতেছে দহি’।
* জানকী - সীতা
** পবন-তনয় - হনুমান
৪০
***
তোমার আয়ুর বৃদ্ধি যাচি’ হে, সাধি’ পরহিত ধন্য হও,
পত্নী সকাশে উত্তরি’ মোর এই ক’টি কথা যদিহে কও—
--অবলে, তোমার প্রিয় সহচর রামগিরি-বাসে নিবসে’ একা,
কোনও মতে আছে পরাণ ধরিয়া, ব্যাকুল লভিতে কুশলে দেখা।
৪১
***
বিধির বিপাকে রুদ্ধ সে পথ, তব সহচর সুদূরবাসী,
বিচ্ছেদ ব্যথা ভুলিতে কবে সে এক হ’য়ে পুন মিলিবে আসি
ঝরিছে নয়নে তপ্ত অশ্রু, অনঙ্গতাপে অঙ্গ জ্বলে;
নিঃশ্বাসে বহে আগুন, সে তাই তোমারে যে চায় স্বপ্নছলে।
৪২
***
সখীর সমুখে যাহা বলা যায়, সে কথাও যেবা কহিত কানে,
কথার সুযোগে মুখে মুখ দিয়ে আনন্দ যার উপজে’ প্রাণে,
সে প্রিয় সুদূরে, শ্রবণ নয়ন পায়না এখন নাগাল তার,
মোর মুখে তাই পাঠাল বারতা, উৎকন্ঠা যে সহেনা আর!
৪৩
***
প্রিয়ঙ্গু-লতা রচিত অঙ্গ, চকিতা-হরিণী-চাহনি চোখে,
বদনে তোমার শশীকলাদ্যুতি, শিখীর পুচ্ছ অলক লোকে;
নাচে তরঙ্গ ভ্রুভঙ্গে তব মুগ্ধ করিয়া নয়ন মোর,
জানি মিলিবেনা তোমার তুলনা খুঁজি যদি আমি জীবন ভোর!
৪৪
***
প্রণয়-কুপিতা ছবিখানি তব আকিঁ ধাতুরাগে শিলার স্তুপে
পড়ি আছাড়িয়া পদতলে তার প্রসন্নতার প্রার্থীরুপে!
কিন্তু নয়নে বহি’ ঘন ধারা দৃষ্টি আমার ঝাপ্সা হয়,
ঘটে পাছে পটে মিলন মোদের-ক্রুর বিধাতার ইচ্ছা নয়।
৪৫
***
স্বপন-মিলনে যদি কভু প্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে ধরিতে যায়,
শূন্য আকাশে প্রসারিয়া বাহু বৃথাই কেবল দুঃখ পাই!
হেরি অভাগার গভীর যাতনা দেবতারও আখিঁ সজল হয়,
তরু কিশলয়ে অশ্রু মুকুতা ঝরি’ ঝরি’ পড়ে বেদনাময়!
৪৬
***
দেবদারু বনে সদ্য ছিন্ন কিশলয়চ্যুত রসের বাসা,
সুরভিত হ’য়ে শীতল সমীর দক্ষিণাপথে যখন আসে,
তোমার পরশ অঙ্গে বুলায় আসিছে বুঝিবা, ভাবিয়া মনে
আমি যে তাহারে, অয়ি গুণবতি! ধরিবারে ধাই আলিঙ্গনে!
৪৭
***
চটুলা নয়না! দীর্ঘ রজনী কেমনে বলনা কাটিবে ত্বরা,
কেমনে ঘুচিবে সন্তাপ-দাহ সারাটি দিনের পাগল করা?
জানি জানি প্রিয়ে কামনা আমার দুর্লভ অতি, উপায় নাই,
তোমার বিরহ-বেদনে-বিপুল বক্ষে আমার বহিগো তাই!
৪৮
***
ওগো কল্যাণি! নিরুপায় আমি, রহিয়াছি একা নিজেরে ল’য়ে
তুমিও আমার দুঃখ অপার কোনওমতে প্রিয়ে থাকিও স’য়ে।
যেথা বেশি সুখ, দুখ ততোধিক, সুখ দুখ নহে চিরস্থায়ী;
চাকার মতই ঘুরিতেছে তাই, উপরে ও নিচে দু’য়েরে পাই!
৪৯
***
শারঙ্গধর বিষ্ণু যখন সর্প-শয়ান উঠিবে ছাড়ি’,
আমার শাপের অন্ত তখন, দেখা হবে পুন ফিরিলে বাড়ি!
শারদ নিশীথে চাদেঁর আলোয় আবার দু’জনে মিলিব সুখে
এই ক’টা মাস স’য়ে থাকো সখী যা-কিছু কামনা কাঁদায় দুখে।
৫০
***
একদা আমার কন্ঠ বেড়িয়া আরামে যখন ঘুমায়ে ছিলে,
সুপ্তির মাঝে সহসা কাঁদিয়া আমারেও সখী কাঁদায়ে দিলে!
শুধানু তোমারে কি হ’ইয়েছে বলো নিবিড় আদরে জড়ায়ে বুকে
‘হেরিনু স্বপনে আন নারী লয়ে খেলিছ’ কহিলে সহাস মুখে!
এবং তাকে আশ্বস্ত করবার জন্য যে, তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু এবং বার্তাবাহক, অনুগ্রহ করে তাকে স্মরণ করে দিও যে, একদা যখন আমাকে জড়িয়ে শোয়ে ছিলে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে তুমি কেদেঁ উঠেছিলে।
কারণ তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে যে আমি অন্য এক নারীর সাথে প্রেম করছি
৫১
***
আমার কুশল বারতা যেদিন জানিবে আমার অভিজ্ঞানে,
হয়ত সেদিন, কাজল-নয়না! খনেক শান্তি লভিবে প্রাণে!
থাকনা যেখানে দয়িত তোমার, সে নহে কখনো অবিশ্বাসী,
মিলন অভাবে বাড়ে ভালবাসা, বিচ্ছেদে প্রেম যায়না ভাসি’।
৫২
***
উগ্র হয়েছে প্রথম বিরহে তোমার সখির যে দুখ ভার
আশ্বাসবাণী শুনাইয়া প্রিয়, লঘু ক’রে দেই বেদনা তার,
মহেশ বাহন বৃষভশৃঙ্গে বিদীর্ণ শিলা লঙ্ঘি’ ত্বরা
বাঁচাও আমারে শুভ সংবাদে, সে যে প্রভাতের কুন্দ ঝরা!
৫৩
***
তোমার তুল্য সৌম্য যে-জন বন্ধুকৃত্য করেই জানি,
স্তব্ধ গভীর তব মৌনতা সম্মতি বলি লইব মানি’
চাতক যাচিলে পিপাসার বারি নীরবে যেমন নামাও ধারা,
ভক্তজনের বাঞ্ছা তেমনি পূর্ণ করেন মহৎ যাঁরা।
অনুগ্রহ করে প্রথমে আমার এই কাজটি করো। তারপরে যেও চাতকের তৃষ্ণা মেটাতে যারা প্রথম মৌসুমের বৃষ্টির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে।
৫৪
***
বন্ধু তোমার বিরহ-কাতর; কৃপাপরবশ হইয়া প্রিয়;
হেন অনুচিত প্রার্থনা তার করুণায় তুমি মানিয়া নিও।
তারপরে যেও গৌরবে তব প্রাবৃট্-শোভায় ধরণীময়
বিজলি প্রিয়ার সঙ্গে তোমার বিচ্ছেদ যেন কভু না হয়!
প্রয়োজনের চেয়ে আমি ইতিমধ্যে অতিরিক্ত চেয়ে ফেলেছি। কিন্তু বন্ধুত্ব বা করুণা করে হলেও আমার এই প্রার্থনাটুকুন তুমি রেখ। বৃষ্টি-শোভায় শোভিত হয়ে তুমি যাও। আমার প্রিয়ার থেকে যেমন আমি বিচ্ছিত বিজলি প্রিয়ার সাথে তুমি যেন ক্ষণিকের জন্যও আলাদা না হও।
***সমাপ্ত***
মেঘদূত নিয়ে চমৎকার একটি আর্টিকেল
ইংলিশে মেঘদূত
http://www.textetc.com/exhibits/et-kalidasa-1.html
http://sanskrit.farfromreal.com/files/meghaduta.pdf
http://www.poemhunter.com/kalidasa
http://hellscream.multiply.com/tag/meghdoot
সংস্কৃতে মেঘদূত
সংস্কৃতে মেঘদূত
মেঘদূত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।