আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন কবি কালিদাস

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের অবন্তী রাজ্যের বেত্রবতী নদীর জলের রংটি গৈরিক। এই পূর্বাহ্নের নির্মল আলোয় সেই জলে রাজাধিরাজ বিক্রমাদিত্যর একখানি বিশাল ময়ূরপঙ্খি নৌকা ক্রমশ দূর দিগন্তে মিলাইয়া যাইতেছিল। শরৎকাল বলিয়া ভারতবর্ষের বিস্তির্ণ আকাশে নীল রঙের ছোপ লাগিয়া ছিল।

এক্ষণে সেই নীলাভ আকাশে উপবৃত্তকারে এক ঝাঁক নীলকন্ঠ পাখি কলরব করিয়া উড়িয়া যাইতেছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঈষৎ কম্পমান বেত্রবতীর জলে সেই নীলাভ আকাশের ছায়া পড়িয়াছে। খ্রিষ্টাব্দ ৪১০। নির্জন বেত্রবতী কূলে এক দোহারা চেহারার যুবক বসিয়াছিল। যুবকের গাত্রবর্ণ শ্যামল রঙের; কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো চুল ঈষৎ কোঁকড়ানো, মুখ ভরতি চাপদাড়ি, আয়ত চোখ দুই খানি কেমন নিষ্প্রভ দেখাইতেছে।

নদীপাড়ে খালি গায়ে বসিয়া থাকা যুবকের পরনে মলিন ধুতি, কাঁধে একখানি শ্বেত রঙের উড়নি। যুবকটিকে দেখিয়া কেমন উদাস ও মলিন বলিয়া মনে হয়। মনে হয় যেন চতুপার্শ্বের বিশ্বপ্রপঞ্চে তাহার মন নাই । তাহার মন কোথায় যেন বিলীন হইয়া গিয়াছে ... দোহারা গড়নের শ্যামল যুবকের নাম কালিদাস। দীর্ঘদিন ধরিয়া কালিদাস গৃহের বাহিরে অবস্থান করিতেছে বলিয়াই কি তাহাকে কাতর ও বিমর্ষ দেখাইতেছে? এই প্রশ্নে আমরা কৌতূহল বোধ করিতেই পারি।

সুতরাং কালিদাসের গৃহত্যাগের বৃত্তান্তটি এক্ষণে বর্ণনা করা যাক। কালিদাসের স্ত্রীর নাম অনুরাধা। মেয়েটি তেমন সুন্দরী না হইলেও প্রখর রুচিজ্ঞানের অধিকারীণি। অনুরাধা বিবাহের পর আবিস্কার করিয়াছে যে তাহার স্বামীটি নিরেট মূর্খ এবং কাব্যজ্ঞানশূন্য। কালিদাসের ভাষাজ্ঞান সীমিত; প্রসিদ্ধ নাট্যকার ভাস-এর নাম সে জানে না; এমন কী অষ্টাদশ পুরাণ সম্বন্ধেও সে সম্পূর্ণরূপে অবগত নয় ।

সুতরাং অনুরাধা কালিদাসকে উত্তমরূপে র্ভৎসনা করিয়াছে । ইহাতে প্রগাঢ় অভিমান বুকে লইয়া কালিদাস গৃহত্যাগ করে । গৃহত্যাগ করিয়া কালিদাস বিষন্ন মনে বেত্রবতী নদীর তীরে আসিয়ে বসিয়াছিল। প্রচন্ড আত্মগ্লানিতের ভুগিতেছিল সে। কেন যে বিদ্যা অর্জন করি নাই, গুরুর বিদ্যাপীঠে ধন্না দিই নাই ।

তাহার বদলে পিতার বিপনী বিতানে বসিয়া বঙ্গ হইতে আমদানীকৃত মিহিন বস্ত্র বিক্রয় করিয়াছি। তাহাতে অর্থ আসিত বটে, এবং সে অর্থ ব্যয় করিয়া জীবনের পরমার্থ খুঁজিয়া পাইয়াছিল উজ্জয়িনী নগরের মহেশ্বর সড়কের ত্রয়ী রঙ্গালয়ের নটী বিভাবতীর আদিরসাত্মক সংগীতে । ধিক! নদীর পাড়ে বসিয়া আষাঢ়ের মেঘ দেখিয়া আত্মগ্লানীতে ভুগিতে থাকা যুবকটির মানসপটে বারংবার অনুরাধার মুখখানি ভাসিতেছিল । অনুরাধার শ্যামলবরণ মুখখানি বড়ই শ্রীময়ী। অনার্য মাতৃদেবীর মতন পদ্মপলাশ চোখ।

হায়! আমি সে দুটি চোখ কতদিন দেখিনা! ... অনুরাধা যে মুখরা কিংবা কুটিলা- তাহা কিন্তু নয়। নারীমাত্রই সুর, সংগীত এবং কাব্যপিপাসু হইয়া থাকে এবং অবধারিতভাবেই নারী সৌন্দর্যপূজারীও বটে। উজ্জয়িনী নগরের স্বশিক্ষিতা নারী অনুরাধাও এর ব্যাতিক্রম নয়। অনুরাধা অবন্তী রাজ্যের মেয়ে; অবন্তী রাজ্যের মেয়েরা স্বভাবতই অত্যন্ত শিল্পপ্রবণ এবং পটিয়সী হইয়া থাকে। কাব্যবিমুখ মূর্খ স্বামীদের তাহারা কৌশলে ঋদ্ধ করিয়া তুলে ।

কেননা, অবন্তী রাজ্যের নারীরা স্বামীর মধ্যে উন্নত রুচিবোধের স্ফূরণ দেখিতে চায়। নারীরা এইভাবে পুরুষের দ্বিতীয়বার জন্ম দেয়, চটুল বিষয় লইয়া মগ্ন পুরুষদিগকে মানবগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিয়া তুলিতে চায়। সুতরাং অনুরাধা কালিদাসকে তিরস্কার করিয়া প্রকারন্তরে তাহার বিদ্যা অর্জনের পথটিই কৌশলে দেখাইয়া দিয়াছে। নদীর তীরে বসিয়া থাকিতে থাকিতে কালিদাসের ঘোর লাগে। শরতের উতল হাওয়ারা বেত্রবতী নদীর পাড়ের হরিতকী বন আন্দোলিত করিয়া তোলে ।

হরিতকী বনে একখানি সুনন্দ দারুকুটির দৃশ্যমান। সেই কাষ্ঠনির্মিত কুটিরে বাস করেন অবন্তী রাজ্যের বিশিষ্ট পন্ডিত আচার্য আর্যদেব। আচার্য আর্যদেব সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন। স্বয়ং সম্রাট ২য় চন্দ্রগুপ্ত পন্ডিত আর্যদেবকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। ( উল্লেখ্য যে, গুপ্ত সম্রাট ২য় চন্দ্রগুপ্তই বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করিয়া বর্তমানে আর্যাবর্ত শাসন করিতেছন।

) ... আচার্য আর্যদেবের উজ্জয়িনী নগরের কর্মকোলাহল ভালো লাগে না। জ্ঞানচর্চায় নির্জনতা আবশ্যক। সুতরাং আর্যদেব নির্জন বেত্রবতীর তীরে নিবিড় হরীতকী বনে ‘আশ্রম’ নির্মাণ করিয়া নির্জনে বাস করিতেছেন। কালিদাসের মুখে পূর্বাপর সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া আচার্য আর্যদেব কালিদাসকে শিষ্যত্ব দান করিতে সম্মত হইয়া বেদ, উপনিষদ, সাংখ্য, যোগ, মীমাংশা, ন্যায়, চার্বাক প্রভৃতি দর্শন; মহাকাব্য, জৈন কথাসাহিত্য, বৌদ্ধ কথাসাহিত্য, পুরাণ, ছন্দঃশাস্ত্র, অলঙ্কার শাস্ত্র, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি শাস্ত্র পাঠ করাইলেন। কালিদাসের এতকাল আর্যদেবের আশ্রমেই কাটিয়াছে।

অধ্যয়ন সমাপ্ত হইলে কালিদাসকে সম্রাট ২য় চন্দ্রগুপ্তের নিকটে লইয়া উপস্থিত করাইবেন। আচার্য আর্যদেব এমন শপথও করিয়াছেন। নিবিড় অধ্যয়নের পাশাপাশি হরীতকী আশ্রমে কালিদাসের বিচিত্র এক অভিজ্ঞতাও হইয়া গেল । বস্তুত হরীতকী বন নাম হইলেও হরীতকী বনে কেবল হরীতকী গাছই নাই, সে বনে বিস্তর পিপুল,আমলকী, কামরাঙা নিম ও ন্যগ্রোধ (বট) গাছও রহিয়াছে। হরিণ এবং ময়ূর সমৃদ্ধ হরীতকী বনে নীলকন্ঠ পাখির অভয়ারণ্য বলিয়া মনে হয়।

অবশ্য ভিন্ন জাতের সুপ্রচুর পক্ষীও রহিয়াছে। অনুরাধার মুখটি স্মরণ করিয়া বিষন্ন থাকিলেও কালিদাসের হরীতকী বনতলের নির্জনতা ভালো লাগিত। একাকী নির্জনে বনময় ঘুরিয়া বেড়াইত। রাত্রি অধিক হইলে আচার্য আর্যদেব বনপথে কোথায় যেন চলিয়া যান। ইহা আবিস্কার করিয়া কালিদাস শিহরণ বোধ করে।

আচার্য আর্যদেব প্রায়শ মধ্যযামে আশ্রম হইতে বাহির হইয়া যান। এবং প্রদোষকালে আশ্রমে ফিরিয়া আসেন। কালিদাস কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবিল, আচার্য কি নারীসঙ্গ করেন? তাহা হইবে কেন? আচার্য নিষ্কাম জ্ঞানসাধনা করেন। এক রাত্রে সে সমীচীন না-হইলেও নিভৃতে আচার্যকে অনুসরণ করিল।

হেমন্তের চন্দ্রালোকে বনভূমি উদ্ভাসিত হইয়াছিল। আচার্য নিমগ্ন হইয়া হাঁটিতেছিলেন। বনমধ্যে একখানা দেবদারুর পতিত বৃক্ষগুঁড়ি পড়িয়া ছিল। আচার্য তাহার উপর বসিলেন। দেখিয়া মনে হইল আচার্য কাহার যেন অপেক্ষা করিতেছেন।

কালিদাস একটি কামরাঙা বৃক্ষের আড়াল হইতে দেখিতেছিল। হেমন্ত জোছনার মিহিন কুয়াশার ভিতরে একখানা ঘুমহীন পুরুষ ময়ূর উড়িয়া মিলাইয়া গেল। একটি অনিদ্র হরিণ নিমগাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া ইতিউতি চাহিল। কামরাঙার ডালে একখানা নীলকন্ঠ পাখি যখন পাখসাট করিয়া উঠিল- তক্ষণাৎ কালিদাস আকাশপথে একখানা রাজহংসে উড়িয়া আসিতে দেখিল। সেই বিশালকায় ধবল পক্ষীর পৃষ্ঠে শুভ্রবসনা একজন নারী।

পবিত্রা নারীটি হাতে বীণা লইয়া বসিয়া আছেন। কালিদাস চমকাইয়া উঠিল। আশ্চর্য! ইনি যে দেবী সরস্বতী! রাজহংস নিঃশব্দে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করিল। আচার্য ভক্তিভরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর মাথা ঝুঁকিয়ে দেবীকে প্রণাম করিলেন।

দেবী সরস্বতী রাজহংস হইতে নামিলেন না। তবে স্থানটি স্বর্গীয় জ্যোতিতে আলোকিত হইয়া উঠিল। রাত্রিকালীন পুষ্পের প্রগাঢ় সুগন্ধ ছড়াইল। আচার্য বিনীতকন্ঠে শুধাইলেন, আজ কি রাগ শোনাবেন দেবী? রাগ কৌশিক ধ্বনি। আশ্চর্য রিনরিন কন্ঠে দেবী বলিলেন।

বেশ। দেবী বীণায় ঝংকার তুলিলেন। সা গা মা ধা নি র্সা/ র্সা নি ধা মা গা সা। সহসা হরীতকীর বনভূমিখানি যেন স্বরস্বননে গীতল হইয়া উঠিল। সুখশ্রাব্য স্বরমালা শ্রবণ করিয়া কালিদাস শিহরণ বোধ করিল।

সঞ্চরণশীল রাগমঞ্জুরীর আতীব্র গমক- কম্পনে সেই সঙ্গে অনুভূতিশীল মুর্চ্ছনায় সে অবগাহন করিতে লাগিল। তারার ‘সা’ হইতে দেবী সুকৌশলে মীড় করিয়া ‘মা’ স্বরে আসিয়া ক্ষণিক থামিলেন। বনভূমির চেতন প্রাণিগণ তক্ষনাৎ অলীকের স্পর্শ পাইল যেন। এরূপ স্বরসঞ্চয়ন তাহাদের চেতনায় অত্যন্ত সুখপ্রদ মনে হইল। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করিয়া থাকা আচার্য কে ধ্যানমগ্ন মনে হইল।

আশ্চার্য এক অব্যক্ত ভাব তাহার মুখমন্ডলে সঞ্চারিত হইয়াছে। কালিদাসও তদ্রুপ সুরসমুদ্রে নিমগ্ন হইয়া রহিল। কত যুগ যেন এইভাবে কাটিয়া গেল। তুমি এখানে! তীক্ষ্ম কন্ঠ শুনিয়া কালিদাস সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল। সমুখে আচার্য আর্যদেব দাঁড়াইয়া আছেন।

রাজহংস এবং দেবী সরস্বতী মিলাইয়া গিয়াছে। যেন স্বপ্নদৃশ্য। বাস্তবে কখনও ঘটে নাই। কালিদাস অধোবদনে দাঁড়াইয়া রহিল। সে কি আর বলিবে? আচার্য গম্ভীর কন্ঠে বলিলেন, চল, আশ্রমে ফিরিয়া যাই।

কুয়াশা ঘনাইয়া উঠিতেছে। দুই জনে জোছনার আলোয় শিশির ভেজা শুকনা পাতা মাড়াইয়া পাশাপাশি হাঁটিতে লাগিল। দেবী সরস্বতীকে দেখিলাম। কালিদাস না বলিয়া পারিল না। হুমম।

দেখিলে। আচার্য বলিলেন। কালিদাস ঈষৎ অনুচ্চ স্বরে কহিল, বাস্তবে যে দেবীগণ দর্শন দেন, আমি তাহা জানিতাম না। আচার্য গম্ভীর কন্ঠে বলিলেন, যাহারা জ্ঞানসাধনা করে, জগতের পরমসত্যকে জানিবার জন্য ক্লেশ স্বীকার করে, জ্ঞানের দেবী তাহাদের দর্শন দেন বটে। কালিদাস চুপ করিয়া থাকিল।

আচার্য আর্যদেব বলিলেন, আমি দেবী শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীকে কখনও দেখি নাই। কারণ আমার ধনের লোভ নাই। তবে আমার সংগীতের প্রতি তীব্র মোহ আছে। জ্ঞানের সাধকদের কমবেশি সংগীতসাধনা করিতেই হয়। কালিদাস চুপ করিয়া থাকে।

আচার্য আর্যদেব চমৎকার রুদ্রবীণা বাজাইতে পারেন। ব্রাহ্মমুহূর্তে বেত্রবতী নদীতে স্নান করিয়া আসিয়া দারুকুটিরের দাওয়ায় বসিয়া কখনও রাগ রামকেলী কিংবা রাগ আহির ভৈরবের স্বরবিস্তার করেন। তখন হরিণেরা নির্বাক হইয়া যায়, ময়ূরগণ স্থির হইয়া থাকে এবং নীরকন্ঠপাখীরা চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। আচার্য ঈষৎ পরিহাস করিয়া বলিলেন, ওহে কালিদাস। বলুন।

জগৎ কে নির্মান করিয়াছেন বলিয়া তোমার মনে হয়? পরম ব্রহ্মা। কালিদাস বলিল। কেন? ব্রহ্মা কেন জগৎ নির্মাণ করিবার ক্লেশ স্বীকার করিতে গেলেন? কালিদাস উত্তর না দিয়া নিরুত্ত্বর রহিল। সে পূর্বে এরূপ নিগূঢ় তত্ত্ব লইয়া ভাবে নাই। আচার্য বলিলেন, চেতন জীবকে সৌন্দর্য অনুধাবণ করিবার নিমিত্তেই ব্রহ্মা জগৎ নির্মাণের ক্লেশ স্বীকার করিয়াছেন।

সৌন্দর্যই জগতের সার বস্তু। অন্য সকল হইল বাহ্য। ভাষার প্রাণ নাই যদি-না তুমি ভাষায় ছন্দ আরোপ না কর। পাথরও নিষ্প্রাণ যদি না অনিন্দ্য প্রতিমা নির্মাণ না-কর। নারীও মৃতবৎ -যদি না তাহাকে তীব্র ভালো না বাসিলে।

কালিদাস শ্বাস টানিল। তাহার অনুরাধার মুখখানি মনে হইল। আহা, কতকাল হইল অনুরাধাকে প্রণয় পাশে বিদ্ধ করা হয় না। আচার্য বলিলেন, কান পাতিয়া শোনো, অনিদ্র হরিণ তাহার ঘুমহীন হরিণীটিরে ডাকিতেছে ছন্দোবদ্ধ বিষাদী স্বননে। কিছু বুঝিলে কি? কালিদাস চুপ করিয়া থাকে।

আচার্য বলিলেন, তুমি নিরক্ষর ছিলে কালিদাস। তুমি মৃত ছিলে। এক্ষণে আমার আশ্রমে বসিয়া জ্ঞানসাধনা করিয়া শিক্ষিত হইলে। তোমার আত্মায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হইল। জগৎ যে নির্মান করিয়াছেন তাহারও ইচ্ছা এইরূপ যে তোমার আত্মায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হউক।

প্রত্যেক জীবের সত্তায় সৌন্দর্যবোধ জাগরিত হউক। ব্রহ্মা স্বয়ং নিগুর্ণ হওয়ায় তিনি ত্রিগুণাত্বক চঞ্চলা প্রকৃতির মাধ্যমে এই কার্য সম্পাদন করেন। এই ত্রিগুণাত্বক চঞ্চলা প্রকৃতিই হইল নারী। তুমি শিক্ষিত হও, মানবিক হও, তোমার অন্তরে সৌন্দর্যবোধের দীপখানি প্রজ্জ্বলিত হউক- ইহাই তোমার স্ত্রী অনুরাধার ইচ্ছা। এইবার কালিদাস যেন কিছু বুঝিতে পারিল।

সে হতবিহ্বল হইয়া পড়িল। অনুরাধার তিরস্কারে মনে আঘাত পাইয়া ঘরের বাহির হইল বলিয়াই সে আচার্য আর্যদেব-এর দেখা পাইল। আচার্যর সান্নিধ্যে এবং দেবী স্বরসতীর বরে কালিদাস কবি হইয়া উঠিল। বেত্রবতীর নির্জন কূলে বসিয়া থাকিতে থাকিতে স্ত্রী-বিরহে কাতর কালিদাসের শূন্য হৃদয়ে গুঞ্জরিয়া ওঠে কবিতা । একদা নিরক্ষর কবির অন্তত থেকে মন্দাক্রান্তা ছন্দে ধ্বণিত হয় বিস্ময়কর শব্দস্রোত - কুবের অভিশাপে মহিমা গেলো খোয়া/ বিরহভার হলো দুরূহ/ যক্ষ একাকী সে না-কাজ ফলদোষে/ পেলেন গুরু এই শাস্তি/ বসতি রামগিরি, যেখানে ছায়া দেয়/ নিবিড়নীল ওই তরুগণ/ সেখানে ধারাজল পুণ্য হয়ে আছে/জনকতনয়ার স্পর্শে/ হয়েছে কাঠিসার কান্তাবিরহিত/ খসেছে কঙ্কণ কনকের/ অসহ কয়মাস কীভাবে কেটে গেল/ কামুক অনুমানে বুঝে নাও/ সহসা মেঘ ওঠে ধূসর গিরিতটে/ প্রথম দিন এলো আষাঢ়ের/ সেখানে ঝুঁকে আছে ক্রীড়ায় রত/ যূথ- পতির গৌরব পাহাড়ে।

একদা কাব্যবিমূখ নিরক্ষর যুবকটি এক্ষণে কবি হইয়া উঠিয়াছে। আজই অনুরাধার সামনে গিয়া দাঁড়াইবে কালিদাস । ২ কালিদাস- এর মৃত্তিকা নির্মিত দ্বিতল বাড়িটি উজ্জয়িনী নগরের উপকন্ঠে দিঙনাগ সড়কে। মহাকাল মন্দিরের অতি সন্নিকটে। বাড়ির পিছনে কামরাঙা ও পিপুল গাছের ঘন বন।

বনের পাড়ে একখানা টলটলে জলের পুস্করিণী। জলে একখানা ধবল রাজহংস ভাসিতেছিল। বাড়ির সামনের নিকানো উঠোনটি পরিস্কার। অপরাহ্নের রৌদ্র আসিয়া নিথর হইয়া পড়িয়া ছিল। অনুরাধা দাওয়ায় বসিয়া বীণার তার বাঁধিতে ছিল।

মাঝেমাঝে পথের দিকে চাহিয়া ছিল। মহাকালের মন্দিরের পাশ দিয়া শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়ের গো-শকট যায়। আহা, আজই যদি স্বামী ফিরিয়া আসিত। তক্ষনাৎ কালিদাসকে আসিতে দেখিল অনুরাধা। এবং দ্রুত আঁচল সংযত করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

ধীর পদক্ষেপে কালিদাস তাহার সমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তুমি? অনুরাধার মুখে হাসির আভাস। স্বামীর বিরহে সেও কাতরা ছিল। কালিদাস বিশুদ্ধ সংস্কৃতে বলিল, অস্তি কশ্চিৎ বাগ বিশেষ (কিছু কথা আছে। ) অনুরাধা চমকাইয়া উঠিল না।

বরং হাসিল। কালিদাস বলিল, এইবার আমি ঘরে যাইতে পারিব কি? না। তাহা হইলে ? কালিদাস অবাক হইয়া গিয়া বলিল। অনুরাধা বলিল, তুমি আমাকে অস্তি কশ্চিৎ বাগ বিশেষ বলিলে না? হ্যাঁ। বলিলাম।

কালিদাস বলিল। অনুরাধা বলিল, এই বাক্যটি প্রতিটি শব্দের সূচনা অক্ষর দিয়া একটি করিয়া কাব্য লিখতে হইবে। তাহা হইলেই তুমি ঘরে প্রবেশ করিতে পারিবে। কালিদাস সম্মত হইল। নির্জন বেত্রবতী নদী এবং হরীতকী বন তাহাকে আমূল বদলাইয়া দিয়াছে।

সে কাব্য লিখিতে পারিবে বৈ কী। ‘অস্তি’ শব্দে কুমারসম্ভব কাব্যের আরম্ভ ‘অস্তÍ্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্বা’। ‘কশ্চিৎ’ শব্দটি দিয়া ‘মেঘদূত’ কাব্যের আরম্ভ। যেমন: ‘ কশ্চিৎ কান্তা বিরহ গুরুণা’। ‘রঘুবংশ’ কাব্যের প্রথম শ্লোকের প্রথম চরণ হইল-‘বাগর্থবিব সংপুত্তৌ বাগর্থপ্রতি পত্তয়ে।

‘বিশেষ’ শব্দ দিয়া কোনও কাব্যের আরম্ভ নাই বটে। তবে কালিদাসের উপখ্যানটি যাহারা আজও বিশ্বাস করে, তাহাদের বিশ্বাস ‘বিশেষ’ শব্দ দিয়া কোনও কাব্যের আরম্ভ হইয়াছে বটে, তবে কাব্যটি কালের অতলে তলাইয়া গিয়াছে। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অনুবাদ করেছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। উৎসর্গ: দেবযানী দে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.