seremos como el Che
ফেলুদা সিরিজের ‘বাদশাহী আংটি’ পড়েছেন আর মনে মনে ‘ভুল ভুলাইয়া’ জিনিসটা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছা হয়নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। আমিও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিলাম না। কিন্তু সাধের সাথে সাধ্য আর সুযোগের মিল ছিল অপ্রতুল। ঘটনাচক্রে সেই লখনৌতে যাবার সুযোগ এসে গেল ২০০৯ সালের মাঝের দিকে।
লখনৌকে বলা হয় ‘নবাবদের শহর’।
লখনৌ পৌঁছেই খেয়াল করলাম যে এই শহর ঠিক আর দশটা শহরের মত নয়। এখানে সব কিছুতেই কেমন জানি একটা ‘বাদশাহী’ ভাব বিদ্যমান। লোকজন সবাই কথা বলছে উর্দূতে, কাউকে হিন্দীতে কিছু জিজ্ঞাসা করলে একবারে বুঝতে পারে না, দু-তিনবার বলে বুঝাতে হয়। খাওয়া-দাওয়া করা মানেই একটা এলাহী কারবার। বলা হয়ে থাকে যে তৎকালীন আওয়াধ রাজ্য(যার রাজধানী ছিল লখনৌ) থেকেই কাবাবের মত ঢিমে আগুনে রান্না করা খাবারের সূত্রপাত।
রাতে খেতে গিয়ে খেলাম আট রকমের মাংসের আইটেম, অনেকগুলোর নামও আমি শুনিনি আগে। শোনা যায়, আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্’র খাবার ছয়টা আলাদা আলাদা রন্ধনশালা থেকে আনা হত।
এই নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্ ছিলেন ছিলেন একজন কবি, নৃত্যশিল্পী এবং শিল্পকলার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। ভারতীয় কথক নৃত্যে তার অবদান অসামান্য। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের এক বছর আগে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে ব্রিটিশদের কাছে তার আওয়াধ রাজ্যের পতন ঘটে।
এই ঘটনা এবং তার সমসাময়িক পরিপার্শ্বিকতার সাথে তৎকালীন সমাজের রাজনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মিশেলে কিংবদন্তী বাঙ্গালী চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন তার উর্দূ চলচিত্র ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। মুন্সী প্রেমচাঁদের লেখা উর্দূ গল্প ‘শতরঞ্জ কি বাজি’ অনুসারে ১৯৭৭ সালে তিনি এটি নির্মাণ করেন।
মুভিটিতে দু’টি ঘটনা পাশাপাশি দেখানো হয়। একদিতে দেখা যায় নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্’কে গদি থেকে উৎখাত করার জন্য ইংরেজদের পরিকল্পনা এবং এ ব্যাপারে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্’র প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে দেখানো হয় সমাজের দুইজন বিত্তবান ব্যক্তি মীর্জা সাজ্জাদ আলী এবং মীর রওশন আলী’কে যাদের জীবনের ধ্যানজ্ঞানই হচ্ছে দাবা(শতরঞ্জ) খেলা, এর বাইরে বাস্তব জীবনের কোন কিছুই তাদের ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
একটু শান্তিতে দাবা খেলার জন্য তারা বাড়ি ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যেতেও পিছপা নন। তাদের দু’জনের স্ত্রীদের মধ্যেও ব্যাপারটা ভিন্ন হতে দেখা যায়। মীর্জার স্ত্রী যখন চেষ্টা করে যায় বিভিন্নভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণের তখন মীরের স্ত্রী তার স্বামীর অনুপস্থিতির সময়টুকু কাটায় অন্য পুরুষের সংস্পর্শে।
নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্’র ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেন ‘গাব্বার সিং’ খ্যাত আমজাদ খান এবং জেনারেল ওটার্মের ভূমিকায় অভিনয় করেন ইংরেজ অভিনেতা রিচার্ড অ্যাটেনবেরে। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন সঞ্জীব কুমার, সাঈদ জাফরী, শাবানা আজমী, ডেভিড আব্রাহাম, টম অল্টার এবং ভিক্টর ব্যানার্জী।
ধারা বর্ণনা করেন অমিতাভ বচ্চন।
টম অল্টার একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে সত্যজিৎ সবকিছু নিখুঁত করতে চেয়েছিলেন। জেনারেল ওটার্মের যে ষ্টাডি রুম ফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে সেটাও সত্যজিৎ ছবি এঁকে নিয়েছিলেন যেন কোন কিছু বাদ না পড়ে। টেবিলের উপরের জিনিসগুলা থেকে দেয়ালের ছবিগুলো সবই ছিল গবেষণা করে নির্দিষ্ট করা। এসবের জন্যই ফিল্মটি তৎকালীন ইতিহাসবিধদের মাঝেও ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
চলচিত্রটিতে সত্যজিৎ এর চিন্তার মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। লর্ড ডালহৌসির রাজ্য দখল আর ইংরেজদের সাথে আওয়াধের নবাবদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তার ফলাফল ছোট্ট কার্টুনের মাধ্যমে দেখিয়ে ফেলার ব্যাপারটা ছিল অসাধারণ। এছাড়াও তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন বিনোদনের অঙ্গ যেমন ঘুড়ি ওড়ানো, মোরগের লড়াই, মেষের লড়াই এবং এসবে বাজী রাখার মত ব্যাপারগুলোও মূল ঘটনা প্রবাহের সাথে সাথে দর্শকের সামনে উঠে এসেছে সমানতালে। মাঝে মাঝে কিছু হাস্যরস যোগ করতেও ভুল হয়নি সত্যজিৎ এর।
এই ছবিতে অভিনয় করার পর রিচার্ড অ্যাটেনবেরের এক বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সত্যজিৎ এই ছবির প্রতিটি শট এক টেকে নিয়েছেন। এত নিখুত নির্মাণ এক শটে প্রতিটি। ভাবা যায়? শুধু তাই নয় রিচার্ড যখন সত্যজিৎকে বললেন, আপনি কি নিরাপত্তার খাতিরেও একটা শট অতিরিক্ত নিবেন না? সত্যজিতের সেই উত্তর শুনলে নিজেকে এত ছোট মনে হয় যে সেটা কল্পনারও অতীত। তিনি বলেছিলেন, আমাদের এত টাকা নেই।
শুরু করেছিলাম আমার লখনৌ যাবার কথা বলে, সেটা দিয়েই শেষ করা যাক।
এই মুভিটি দেখা শুরু করার পরে যখনই কোন বিল্ডিং দেখায় তখনই আমার মনে হয় আরে এইটা তো বড় ইমামবড়া, আরে এইটা তো তার বিপরীতের বিল্ডিংটা, এইটা তো ইমামবড়াতে ঢোকার গেট, আরে এইটা তো রুমী দরওয়াজা। মুভিটা দেখার পর আমার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে, কেন যে লখনৌ যাওয়ার আগে এইটা দেখিনি, তাহলে অনেক ডিটেল বুঝে দেখতে পারতাম ওখানের সবকিছু। তাই বলি, আপনারা কেউ আমার মত একই ভুল করবেন না, মুভিটি দেখে ফেলুন, দেখবেন লখনৌ গেলে ‘নবাবদের শহর’ আপনার চোখে ভিন্ন দ্যোতনায় ধরা দেবে। মুভিটি টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করতে চাইলে করতে পারবেন এখান থেকে ।
২৯শে অক্টোবর, ২০১১, ঢাকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।