আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাইমুখ বাধ নির্মান প্রতিরোধ করতে পারবো না আমরা



পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর গতকালের বক্তব্য শুনে নিশ্চিত হলাম ভারত টিপাইমুখ বাধ ও সেখানে জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করবেই- এটা বাংলাদেশের মৃদু প্রতিবাদ, বহুদলীয় সংসদীয় কমিটি, রাজনৈতিকদের নিয়ে গঠন করা হোক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়েই গঠন করা হোক না কেনো, তাদের সফর কোনো পরিবর্তন আনবে না, ভারতের সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হবে না। যেকোনো সাধারণ অধ্যাদেশ ৩৫টি সদস্য দেশ সাক্ষর করলে আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে গণ্য হতে পারে, তবে যেসব নদী একাধিক দেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তাদের উজান কিংবা ভাটিতে কোনো প্রস্তাবিত স্থাপনা, কিংবা তার অবাধ প্রবাহ স্থগিত করবার যেকোনো প্রস্তাবে অভিন্ন নদী ব্যবহারকারী দেশগুলোর সকলের সম্মতি লাগবে এমন অধ্যদেশটিতে ১৭টি দেশ সাক্ষর করেছে এবং আরও আশ্চর্য হলো এই সনদে ভারত কিংবা বাংলাদেশ কেউই সাক্ষর করে নি। সুতরাং দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ব্যতীত এটা সুরাহা করা সম্ভব হবে না। ভারত বাংলাদেশের এই প্রতিবাদ প্রতিরোধকে গণ্য করছে না, করবে না, গতকালের কুটনৈতিক শিষ্ঠাচারবহির্ভুত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতা একটা বড় ইস্যু, কিন্তু ভারতের নদীর উপরে বাধ নির্মান কিংবা জলবিদ্যুত উৎপাদনের প্রতিবাদ করাটা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পুরণের জন্য নয়, এমন বক্তব্য প্রদান করার অশিষ্ট আচরণ করবার পরেও সেখানে উপস্থিত সুশীলগণের কেউই এটার প্রতিবাদ করেন নি।

এটা দুঃখজনক নয়, বরং আমাদের সুশীলগণ সব সময়ই মেধার দৈন্যতার ভুগেন, তারা তাৎক্ষণিক বিবৃতি রচনা করতে পারেন না, তারা স্পষ্ট বলতে পারেন না। বুদ্ধিজীবিতার অর্থনৈতিক দাসত্বে তাদের স্বাভাবিক প্রতিবাদস্পৃহাও নেই হয়ে গেছে। ভারতের মিজোরামের রাজ্যসরকারকে চাপ দিচ্ছে টিপাইমুখ বাধ নির্মানে সহযোগিতা করবার জন্য। তারা অতিদ্রুতই সেখানে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইছে। মনিপুরের স্থানীয় মানুষেরা এটার বিরোধিতা করছে।

জলপ্রবাহ স্থবির করে দিলে থমকে যাওয়া জল কোথায় যাবে? সেটা ছড়িয়ে যাবে নদীর দুধার দিয়ে, আশে পাশের বসতি ডুবে যাবে। গণতন্ত্র সব সময়ই অধিকাংশ মানুষের সুবিধার জন্য গুটিকতক মানুষকে বলি করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় , এবং অধিকাংশ সময়ই এই বলিদানের শিকার হয় সংখ্যালঘুগণ। পাকিস্তান যখন কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করলো কর্ণফুলী নদীতে বাধ দিয়ে, বর্তমানের কাপ্তাই লেকের সম্পূর্ণ অংশটাই তখন ছিলো উপজাতিদের বসতি, তাদের সংস্কৃতি, তাদের জীবিকা ও জীবন আমরা বাধের নীচে তলিয়ে দিয়েছি। কারণ গণতান্ত্রিক আধুনিক সমতলবাসীদের বিদ্যুত প্রয়োজন, এবং সংখ্যালঘুদের এটা মেনে নেওয়া উচিত। একই ঘটনা ঘটেছে ভারতের নর্মদায়।

সেখানেও নদীতে বাধ দিয়ে জলবিদ্যুত উৎপাদন করা হয়েছে এবং সেখানেও আক্রান্ত মূলত আদিবাসী কিংবা সংখ্যালঘু উপজাতিরা। টিপাইমুখে বাধ নির্মিত হলে সেখানেও আক্রান্ত হবে স্থানীয় উপজাতিগণ। তারাই নিজেদের সংস্কৃতি এবং জীবন জীবিকার কারণেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করছে। ইতিহাসে পূর্বেও যা ঘটেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না । নদীতে বাধ দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন হবে, সেখানে জমে থালা জল দিয়ে আশেপাশের জমিতে সেচ দেওয়া হবে, এসব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হয়তো বাস্তবায়িত হবে।

সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে আশেপাশে, যতই সতর্কতা অবলম্বন করা হোক না কেনো সেটা স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করবে, এবং সেখানের কয়েকটি প্রাণী নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কয়েক হাজার কোটি জীব বৈচিত্রের কয়েকটা যদি পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায় তবে প্রকৃতির তেমন বড় কোনো ক্ষতি হবে না। যদি ১ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায় ১২০ কোটি মানুষের দেশে তেমন বড় কোনো ক্ষতি হবে না। ভারত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং ভাষাগত বৈচিত্রের বিজ্ঞাপন প্রচার করে সব সময়, মহান ভারতের সকল ভাষা ও জাতিগোষ্ঠির মানুষ সসম্মানে এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়েই বেঁচে আছে এবং মেরা ভারত মহাল গান গাইছে এমন রাজনৈতিক প্রচারণার পরেও ভারতে ১৯ থেকে ২১টি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে, ভারতের সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে এইসব আঞ্চলিক বিদ্রোহ ঠেকাতে ব্যস্ত, তারা সব সময়ই লড়াই করছে এইসব বিচ্ছিন্নতবাদীদের সাথে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র যথাযথ ভাবে বিকশিত হচ্ছে না কিংবা বিভিন্ন জাতি নিজেদের উপেক্ষিত ভাবছে এই মহান ভারতে তাই তারা নিজস্ব স্বাধীকারের আন্দোলন করছে, সেটা দমনের প্রচেষ্টা সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ সামরিক উপায়েই করতে চাইছে।

সফল হচ্ছে সব সময়? বৈষম্য রদ না করলে এই বৈষ্যমের বিরুদ্ধে সব সময়ই আন্দোলন চলবে, গুটিকতক নিষ্পেষিত মানুষ নিজস্ব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। নর্মদা অনেক বেশী বিখ্যাত হয়েছে, মেধা পাটেকার এবং ভারতীয় চলচিত্রের নায়ক নায়িকার একাংশ এটার সাথে যুক্ত হওয়ায়, মনিপুরী উপজাতীদের সাথে সংহতি জানানোর জন্য এখনও তেমন বড় মাপের চলচিত্র তারকার উপস্থিতি নেই। বাস্তবতা হলো, বহু জাতিগোষ্ঠির দেশ ভারতের গুটিকয় সংখ্যালঘু উপজাতিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিন্নতা হুমকির মুখে, তারা এর প্রতিরোধ করবে। এখানে পূর্ব থেকেই সেনামোতায়েন করা আছে। এই বাধ নির্মান ও রক্ষা করবার জন্য স্থানীয় সেনা টহল বাড়বে, আমরা কাপ্তাই রক্ষা করতে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন কিংবা ব্রিগেড সব সময়ই মোতায়েন করে রেখেছিলাম।

তারা পাহাড়ী মেয়েদের লাঞ্ছিত করেছে, ধর্ষণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে এবং গত ৩২ বছরে প্রায় ১০ হাজার পাহাড়ীকে খুন করেছে। এসব কোনোটারই ক্ষমা আমরা বাঙালী হিসেবে চাই নি কখনই। আমাদের নিজস্ব অবজ্ঞার বাস্তবতা থেকেই আমি নিশ্চিত, ভারতেও একই ঘটনা ঘটবে। আমরা আক্রান্ত হবো, সেখানে বাধ নির্মান হবে, যদিও পিনাক চক্রবর্তী নিশ্চয়তা দিচ্ছে সেখান থেকে পানি প্রত্যাহার করা হবে না, কিন্তু সেটাও বাস্তব সত্য নয়। ১৯৭৬ সালে ভারতের নদী কমিশন টিপাই মুখ সংক্রান্ত আলোচনা করেছিলো বাংলাদেশের সাথে।

সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য কি আছে আমাদের কাছে? এই আলোচনায় কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সেটা কি আমরা জানি? আমরা যতটুকু জানি, তার চেয়ে বেশী আমাদের অজ্ঞাত এবং ক্ষতির পরিমাণ যদিও প্রাক্কলিত ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশী হবে, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো আমাদের বোধ হয় পরাজয় মেনে বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া উচিত- আমরা টিপাইমুখ বাধ নির্মান প্রতিরোধ করতে পারবো না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.