নিয়তি অনতিক্রম্য
[গল্পের একটা নতুন ফরম্যাট আজকাল চিন্তা করছি। গল্প হবে সংক্ষিপ্ত। কোন বিশ্লেষণ থাকবে না , থাকবে শুধু ঘটনার এগিয়ে চলা। এমনকি কোন অনুভূতির প্রাধান্যও থাকবে না। গল্প এগিয়ে যাবে অসম্ভব দ্রুত গতিতে।
ভাষাগত কারুকার্য থাকবে না, অনুভূতিবোধের দীর্ঘ প্রকাশ থাকবে না। এ ধারনাটি কিছুটা রূপকথার গল্পের মত। বাচ্চারা পড়ে বলে রূপকথার গল্পে ঘটনার ঘনঘটা থাকে, কিন্তু দীর্ঘ বিশ্লেষণ থাকে না। “ এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজার ছিল তিন পুত্র।
একবার তারা বনে গেল” - এভাবে এগিয়ে যায় গল্প। গল্প উপাস্থাপনের এ ধারনাটি কাজে লাগিয়েছি আমাদের আধুনিক জীবনের প্রেক্ষাপটে। বর্ণনা বা বিশ্লেষণ না থাকলে তা Art বা শিল্প হবে কি না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ । Art কে আমি সৌন্দর্যবোধের নির্মাণ বলে মনে করি। ভাষাগত কারুকার্য না থাকায় এ ধরনের গল্পে সাহিত্যের প্রচলিত সৌন্দর্য হয়ত থাকবে না, কিন্তু থাকবে জীবনবোধের প্রকাশ।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমাদের আটপৌরে জীবনকে নতুন ভাবে দেখার সুযোগ হবে। আমার নিজের গল্পে ঘটনা নির্মাণের মাধ্যমে শিল্প ঠিকমত সৃষ্টি করা না গেলেও, অন্য কোন মেধাবী গল্পকার এ ধারনাটি কাজে লাগিয়ে স্বার্থক গল্প লিখতে পারবেন বলে মনে করি। এ ধরনের গল্প সাধারনভাবে খুব বেশি বড় হবে না, তবে এ ব্যাপারে লেখক অব্যশই পূর্ণ স্বাধীন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে এ ধরনের গল্পে কথোপকথোন থাকবে না। খুব মেধাবী লেখক হয়ত এ ধরনের সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যেও এক ধরনের ভাষাগত কারুকার্য আনতে সক্ষম হবেন।
লেখকের ভূমিকা হবে এক জন নিরপেক্ষ সাংবাদিকের তথ্য উপস্থাপনের মত। লেখকের দক্ষতা দেখা যাবে শুধুমাত্র ঘটনার নির্মাণে। নীচের গল্পটি এই ধারনার উপর লেখা। ]
জামাল সাহেব একজন মধ্যবিত্ত সৎ চাকুরিজিবী। বিয়ে করেছেন দু বছর।
সৎ থাকায় তার সংসার মোটামুটি চলে যায়। জামাল সাহেব একদিন হঠাৎ টের পেলেন তার স্ত্রী পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েছে। রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত হওয়ায় জামাল সাহেব মনে প্রচন্ড কষ্ট পেলেন, চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে বোঝাবার। কাজ হল না। জামাল সাহেবের স্ত্রী রুনা লোকটিকে সত্যি সত্যি ভালবেসে ফেলেছিল।
একদিন দুপুর বেলা রুনা জামাল সাহেবকে ছেড়ে নতুন প্রেমিকের ঘরে গিয়ে উঠল। জামাল সাহেব প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেলেন। কিন্তু বাস্তবতাবোধ মানসিক আঘাতকে অতিক্রম করে যায়। দুমাসের মাথায় আঘাতটা কেমন হাল্কা মনে হতে লাগল। বরং উলটো জামাল সাহেবের মধ্যে জন্ম নিল প্রচন্ড জেদ।
আগে সৎ ছিলেন, এখন ঘুষ খাওয়া শুরু করলেন। শরীরের চাহিদা আছে তাই কিছু বাজারে মেয়েমানুষ জুটিয়ে নিলেন। মদ ধরে ফেললেন। এক বছরের মাথায় দেখলেন এরকম প্রচন্ড ভোগী একটা জীবন একেবারে খারাপ নয়। ঘুষের টাকায় দামী দামী জিনিস পত্র কিনতে পারছেন।
মদ খেলে বেশ লাগে। আগে শুধু স্ত্রীর সাথে শুতেন, এখন প্রতি রাতে নতুন কেউ - বেশ মজা। নামায পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিছু ঊশৃংখল বন্ধু বান্ধব জুটেছে। এই ঢাকা শহরে এত ধরনের আমোদ প্রমোদের উপকরন আছে আগে তিনি জানতেনই না।
তার মনে হতে লাগল আগের জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর সময় তিনি নষ্ট করেছেন।
এর মধ্যে রুনা বেশ সুখী হয়েছে। নতুন স্বামী কায়েসের সংসারে তার মেয়ে হয়েছে একটা। জামাল সাহেবের কথা তার একেবারে মনে পড়েনি তা নয়। কিছুদিন পর ঠিক হয়ে গেছে।
এখন বেশ সুখী সংসার। বহু কান ঘুরে জামাল সাহেবের কথা তার কানে এসেছে। রুনা কিছু বলেনি। সম্পর্ক ছেড়ে আসার পর আর কিছু বলার থাকেনা। অপরাধ করে ফেললে কিছু অজুহাত দাঁড় করাতে হয়।
জামাল সাহেবকে ছেড়ে আসার কারন হিসেবে সে মানুষকে শুনিয়েছে জামাল সাহেবের ঊশৃংখল স্বভাবের কথা। আগে জামাল সাহেবের এ স্বভাব ছিল না । নিজের দোষ ঢাকতে রুনাকে মিথ্যে বলতে হয়েছে। জামাল সাহেবের সাম্প্রতিক অধঃপতনে কথা গুলো সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে। ডিভোর্সের ঠিক পর পর জামাল সাহেব একবার গিয়েছিলেন রুনাকে দেখতে ।
রুনা প্রায় অপমান করেই বিদায় করেছে। রুনার পরবর্তী সুখী জীবনের কথা জামাল সাহেবের কানে গেছে। কিন্তু তখন তিনি একজন অসম্ভব ভোগবাদী মানুষ। কোন কিছু নিয়ে বিলাপ করার সময় নেই। অতীতের কথা ভেবে তিনি বর্তমানের সুখ টুকু নষ্ট করতে রাজী নন ।
তাদের দুজনের আর দেখা হল না।
রুনা যখন ছেড়ে যায় জামাল সাহেবের বয়স তখন চৌত্রিশ। এখন প্রায় পঞ্চাশ হয়ে এসেছে। গত পনের বছর চলেছে তার উদ্দাম ভোগী জীবন। এই ভোগী জীবনটা এখন আর তার তেমন ভাল লাগছে না।
কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। উশৃংখল জীবন যাপনে শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, নারী দেহ হাতড়ে বেড়ানোর চেয়ে বারান্দায় বসে বৃষ্টি ভেজা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার বেশি ভাল লাগছে। মদের গ্লাসের চেয়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালে চড়ুই পাখির নাচে বেড়ানো তাকে বেশি টানছে। তার সহকর্মীদের ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে।
নাতি নাতনী নিয়ে সংসারে ডুবে আছে তারা। সন্তানের আকাঙ্খা জামাল সাহেবের একসময় ছিল, কিন্তু গত পনের বছরের উদ্দাম গতিময়তায় ওসব মনে পড়েনি। সেই গতি থেমে যাওয়ায় এখন কেমন যেন শূণ্যতা পেয়ে বসেছে।
আরও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত পনের বছরে তার দুর্নীতির মাত্রা অস্বাভাবিক ।
এখন একটা মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা এখন কী নিয়ে জীবন কাটানো যায় তা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। নারী, মদ যখন আর ভাল লাগছে না তখন কী করে সময় কাটাবেন ? কোন আদর্শ নয়, নৈতিকতার কোন দ্বন্দ্ব নয়, তার সমস্যা - তিনি খুঁজে পাচ্ছেনা না জীবনের বাকি দিন গুলোতে তিনি ঠিক কী করবেন। তার মনে হচ্ছে একটা পরিবার থাকলে আজ এই সমস্যাটা দেখা দিত না।
দুর্নীতির মামলা খুব বেশি দিন টিকল না । আইনের ফাঁক গলে জামাল সাহেব বেড়িয়ে গেলেন। কিন্তু তার ভোগী জীবন আর চললো না । খুঁজে পেতে একটা দাতব্য সংস্থাকে দুর্নীতি অর্জিত সম্পত্তির বড় অংশটা দিয়ে দিলেন। নিতান্ত সময় কাটানোর জন্যই দুচার খানা বই পড়া শুরু করলেন।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, এক জীবনের ভেতর তিনি তিনটি ভিন্ন জীবন যাপন করেছেন। বিষয়টা একেবারে খারাপ না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।