আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বহুত হইছে; এবার থামেন

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

আমি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ভক্ত। নব্বইয়ের ইটালি-বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যাওয়ার পর আমি বহু রাত ঘুমাতে পারিনি। নিজের ব্যক্তিগত কোন ক্ষতির চেয়ে আমার কাছে তা ছিল আরো অনেক বিরাট কিছু। পুরো নব্বই মিনিট ব্রাজিল একচেটিয়া খেলে। ক্যারেকা, আলেমাওদের শটগুলো কখনো বারের উপর দিয়ে, কখনো বারের পাশ ঘেষে আবার কখনোবা বারে আঘাত করে ফিরে আসছিল।

সারা খেলাতে আর্জেন্টিনা কেবলমাত্র দুটো সুযোগ পায়। এর একটিতে ম্যারডোনার বাড়িয়ে দেয়া বলে ক্যানেজিয়া গোল করেন। দ্বিতীয়টিতে, বড় ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেয়া ম্যারাডোনার ফ্রিকিকটি ব্রাজিলের গোলরক্ষক টাফারেল কোনরকমে পাঞ্চ করে ফিরান। প্রিয় দলের এই অনাকাংখিত বিদায় আমাকে এমনভাবে টাচ করেছিল যে বিষাদের মাত্রাটা অন্যদিকে কনভার্ট করার জন্য সপ্তাহখানেক পরে পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও আমি অসময়ে নানাবাড়িতে বেড়াতে যাই। বিষাদের এই ক্ষতটি ৪ বছর পরে ১৯৯৪ সালে ইউএসএ-বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জয় দিয়ে পূরণ হয়।

ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের মাত্রাটা নিজের ব্যক্তিগত কোন অর্জনের চেয়ে অনেক বড় কিছু ছিল। আনন্দের এই রেশ বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার বহুদিন পরও বিদ্যমান ছিল। তবে ৯৮ ও ২০০৬ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে ব্রাজিলের শোচনীয় পরাজয় আমাকে আর আগের মতো শোকে আচ্ছাদিত করেনি। ঠিক যেমনটা ২০০২ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয় আগের মতো উচ্ছসিত করতে পারেনি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ফুটবল বা ব্রাজিলের প্রতি আমার আবেগ কমে আসছিল।

ফুটবলের প্রতি আবেগ আগের মতোই ছিল। তবে বয়সটা পরিণত হওয়ার সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি ফুটবল একটি খেলামাত্র। খেলাতে জয়-পরাজয় থাকবে। এখানে প্রতিবার জয়ী হওয়া অসম্ভব। ফুটবল একটি বিশ্বজনীন এবং নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই এর চর্চা আছে। তাই এতে প্রতিযোগিতাও ব্যাপক। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়ে এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কাজেই এমন একটি খেলাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া চাট্রিখানি কথা নয়। এখানে সবাই সর্বশক্তি দিয়ে লড়েন।

পৃথিবীতে অন্তত ডজনখানেক দল আছেন যারা মানে প্রায় সমপর্যায়ের। এর মধ্য থেকে একটি দল চ্যাম্পিয়ন হবে। এসব পর্যালোচনা আর পরিণত বয়সের ভাবনা আমাকে বুঝিয়েছে ব্রাজিল বারবার চ্যাম্পিয়ন হবেনা। আর সব সময়ে যোগ্যদল চ্যাম্পিয়ন হবে এমন কথাও নেই। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে গেলে ভাগ্যের সহায়তাও লাগে, যার উপর আমাদের কারো হাত নেই।

ব্রাজিলের ইতিহাসে পেলে-আলবার্তো পেরেরার সত্তরের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলটিকে সবচেয়ে প্রতিভাধর বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরপরের স্থানেই রয়েছে সক্রেটিস-ফ্যালকাও-জিকোর ১৯৮২ এর বিশ্বকাপ দল। কিন্তু এই প্রতিভারা ব্রাজিলকে কোন সাফল্য দিতে পারেনি, যেটা দিয়েছেন তাদের চেয়ে অনেক কম প্রতিভার অধিকারী ৯৪-এর বিশ্বকাপের রোমারিও-বেবোতোরা। ঠিক তেমনি ২০০২ এর রোনাল্ডো-রিভাল্ডোদের ব্রাজিলের চেয়ে ২০০৬ সালে ফ্যানটাস্টিক ফোর বলে পরিচিত রোনাল্ডো-রোনালদিনহো-আদ্রিয়ানো-কাকাদের ব্রাজিল অনেক শক্তিশালী ছিল। ২০০২ সালে ব্রাজিল অতিকষ্টে বাছাই পর্বের বাধা এড়ায়।

ইনজুরির কারণে রোনাল্ডো বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। শেষপর্যন্ত ইনজুরি নিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিলেও তিনি বেশিরভাগ ম্যাচগুলোতে পুরো নব্বই মিনিট খেলতে পারেননি। অথচ এই অনিয়মিত ও ইনজুরি-বিধ্বঃস্ত রোনাল্ডোই টুর্ণামেন্টের সেরা গোলদাতা হন এবং ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেন। কিন্তু ২০০৬ সালে ফ্যানটাস্টিক ফোর বলে পরিচিতি রোনাল্ডো-রোনালদিনহো-আদ্রিয়ানো-কাকারা সম্পূর্ণ সুস্থ ও ফর্মের তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ দিতে পারেননি। একটা সময় বাংলাদেশে ফুটবল অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল।

আশির দশকে আবাহনী-মোহামেডানের খেলার দিন সেটাই ছিল জাতীয় ইস্যু। কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে বারবার ব্যর্থতা এবং পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কারণে একসময়ে ক্রিকেট ফুটবলের স্থান নিয়ে নেয়। তাছাড়া প্রতিযোগিতা কম থাকা এবং আইসিসি কর্তৃক খেলাটিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার কারণে এখানে তাড়াতাড়ি সফলতা লাভেরও একটি সুযোগ ছিল। সরকারও বিষয়টা উপলব্ধি করে ক্রিকেটের দিকে অধিক মনোনিবেশ ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। সফলতাও আসে।

১৯৯৭ সালে আইসিসি কাপ জয়ের সূত্র ধরে বিশ্বকাপে পদার্পন এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে ভাল পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা লাভ করে। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দীর্ঘ নয় বছরে বাংলাদেশ টেস্ট অঙ্গনে ভাল কোন পারফর্মেন্স না দেখাতে পারলেও একদিনের ক্রিকেটে বেশ কিছু নজরকাড়া পারফর্মেন্স দেখিয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা আগোগোড়াই আবেগপ্রবণ। কাউকে মাথায় তুলতে অথবা ছুড়ে ফেলে দিতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগেনা। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সে রকম একটা দৃশ্যেরই অবতারণা হয়েছিল।

আমাদের উচ্ছাসের প্রকাশ এতোটাই বাড়াবাড়ি ছিল যে একে ধারণ করতে গিয়ে কয়েকজনকে জীবন দিতে হয়। আমরা খেলোয়ারদের ঘটা করে পুরস্কৃত করলাম। কোচ গর্ডন গ্রিনীজকে বাংলাদেশের নাগরিক্ত প্রদান করলাম। অথচ এই সন্মানীত লোকটিকেই দুবছরের মাথায় অসন্মানজনকভাবে বিদায় করলাম। কি করেছিলেন তিনি? একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলেছিলেন।

বলেছিলেন বাংলাদেশকে টেস্টমর্যাদা দেয়ার সময় এখনও আসেনি। বোর্ড সভাপতি সহ অনেকেই তার এই উক্তির জন্য কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু আজ টেস্টমর্যাদা প্রাপ্তির একদশক পরে এসে কেউ কি বলতে পারবেন গর্ডন অবাস্তব কিছু বলেছিলেন। আমাদের বাড়াবাড়ির কিছু নমুনা গত একমাস এই ব্লগ বা পত্রিকাগুলোর পাতা ঘাটলেই পাবেন। গত আইপিএলে মাশারাফি-কে নাখেলানোর কারণে আমাদের পত্রিকাগুলো বুকাননের মতো বিশ্বজয়ী কোচকে নিয়ে তামাশা করেছিল।

এই ব্লগেই অনেকে তাকে নানা অশ্লীল ভাষায় চুতষ্পদের সাথে তুলনা করে গালাগালি করেছিল। তবে শেষতক মাশরাফিকে যখন খেলানো হলো তখন তার পারফর্মেন্সতো আমরা সবাই দেখলাম। যাক, পত্রিকাগুলো অবশ্য এ নিয়ে আর কোন আলাপ করেনি। আমিও করবনা। তবে যেই মাশরাফিকে না খেলানোর কারণে সাংবাদিকরা বা ব্লগাররা কোচ বুকাননের মন্ডুপাত করেছিলেন সেই পত্রিকাওয়ালা এবং ব্লগাররাই সেই মাশরাফিকে এখন বিড়াল এবং রিকশাওয়ালা বানাতে ওঠেপড়ে লেগে গেছেন।

খেলাটার প্রতি জনগণের আবেগ ও উচ্ছাসকে বিবেচনায় নিলে এ বহিঃপ্রকাশগুলোকে হয়ত বাড়াবাড়ি বলা যাবে না। তবে আক্রমণটা খেলোয়ার ও খেলাটির সাথে সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে যখন তৃতীয় কারো দিকে ধাবিত হয় তখনতো নিঃসন্দেহে একে বাড়াবাড়ি বলা যায়। গত সপ্তাহে একজন ব্লগারকে দেখলাম বাংলাদেশ দলের পরাজয়কে কেন্দ্র করে একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে তুলোধুনো করতে। সন্মানীত ব্লগার ঐ সাংবাদিকের নামটিকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। বেচারা সাংবাদিকের প্রতি ব্লগার মহোদয়ের আচরণে এমন মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের এই পরাজয়ে ঐ সাংবাদিকই দায়ী।

ঐ সাংবাদিকই বাংলাদেশে দলের ম্যানেজার, কোচ কিংবা নির্বাচক ছিলেন। পাশাপাশি অন্য একটি পত্রিকার সাংবাদিকের অকুন্ঠ প্রশংসা করতেও তিনি কুন্ঠিত হননি। তার অভিব্যক্তিতে এমন মনে হয়েছে যে তার ঐ পছন্দের সাংবাদিককে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব দিলে তিনি দলটিকে অজেয় করে ফেলবেন। আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত ক্রিকেট একটি খেলামাত্র। খেলা খেলাই।

এতে জয়-পরাজয় থাকবেই। খেলোয়ার সুলভ মনোভাব নিয়ে এটাকে গ্রহণ করতে হবে। উপরন্তু ক্রিকেট সম্পর্কে বলা হয়- It's a game of great uncertain. একদিনের ক্রিকেট বা টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে এ উক্তিটি আরো বেশি গুরুত্ব বহন করে। বিশেষদিনে যে কেউ খেলাটিতে জয়ী হতে পারে। আর এই সিস্টেমের ক্রিকেটে কয়েক ওভার খারাপ খেললেই ম্যাচে ফিরে আসা অসম্ভব।

অস্ট্রেলিয়ার মতো দল প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছে, ইংল্যান্ড হল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে, চ্যাম্পিয়ন ও ফেভারিট ভারত দ্বিতীয় রাউন্ড পার হতে পারেনি। এগুলো খেলারই অংশ। বাংলাদেশের পরাজয়টাকে সে হিসেবেই নেয়া উচিত। ক্রিকেট বিশ্বজনীন কোন খেলা নয়। এ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকও খেলাটির সাথে পরিচিত নয়।

তারপরেও বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সেনাশাসন আর দুর্নীতির খবরের বাইরেও ক্রিকেটের কারণে এদেশটি বিশ্বসংবাদের শিরোণাম হয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তি আক্রমণ পরিহার করে যতদূর সম্ভব সহানুভূতির নিয়ে খেলাটির সাথে সংশ্লিষ্টদের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দেয়াটাই যৌক্তিক মনে হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।