দিলের দরজা ২৪/৭ খুইলা রাখি মাছি বসে মানুষ বসে না। মানুষ খালি উড়াল পারে! এক দিন আমি ও দিমু উড়াল, নিজের পায়ে নিজে মাইরা কুড়াল...
পনর.
দেশে ফিরে একে একে প্রায় সমস্তটা কাজই গুছিয়ে ফেলেছিলাম। সাক্ষাৎকার পর্ব মোটামুটি সম্পন্ন। ১৫ অক্টোবর ২০০৮ এ এয়ার্পোটের সামনের গোল চক্করে মৃনাল হকের নির্মিতব্য শিল্পকর্মটি ভাঙার ঘটনাটি ও এর পরবর্তী দেড় মাসে ঘটনা পরম্পরা আমাকে অপরাজেয় বাংলা প্রজেক্ট থেকে দূরে নিয়ে যায়। ছবির হাটের কিছু সমমনষ্কদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় সচেতন শিল্পী সমাজ নামে যে একটি প্লাটফর্ম শুরু হয়ে ছিল আমি সে কার্য্যক্রমের পিছে পিছে ঘুরতে থাকি এই দেড় মাস যাবত।
এর মাঝে মন্ট্রিয়লের এক এনজিওর জন্য বানিয়েছি ছোট্ট একটা ফিল্ম তা ছাড়া ঢাকা শহরে আমার কোন চাকরী বাকরী নাই। হাতে সময় অফুরান, রাত ভর অনিদ্রায় ভুগি আর দিনভর পরে পরে ঘুমাই। দুপুর গড়ালে আস্তে ধীরে ক্যামেরা পোটলা নিয়ে রওয়ানা দি শাহাবাগ। মিটারে ৩২ টাকার ভাড়া ৬০ টাকার কমে কোন দিন যেতে পারিনি। তত দিনে পষ্ট হয়ে গেছে, এই দেশে নিয়মে চলবে না কিছুই!
শাহবাগ এলে ছবির হাট কিংবা চারুকলার লিচু তলার কোনায় গেলে কেমন যেন একটা স্বস্থি লাগে।
মনে হয় দুনিয়াটাকে পাল্টে ফেলা কত সহজ! গানে কবিতায় নাটকে সিনেমায় দুনিয়াত অলরেডি পাল্টানো শুরু করেছে, এইত আর মাত্র কটা রাত...
সচেতন শিল্পিরা প্রতি বিকেলে দলে দলে মিলিত হন চারুকলার মাঠে, ছাদে/ লিচুতলায়। লক্ষ্য করলাম এ শিল্পী মানে কেবল আঁকিয়ে নন, কিংবা গানের শিল্পী নন। এই দলে এসে যোগ দিয়েছেন লেখক, কবি, সংবাদ কর্মী, মঞ্চ শিল্পী, ব্যাংকার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বেকার, সমাজ কর্মী, ভবঘুরে কে নেই! কিন্তু এরা সকলেই সমাজের তেমন পরিচিত কেউ নন। মানে কোন হোমরাচোমরা নন। এরা সকলেই বয়সে খুবই তরুন।
ব্যাবসায়ী হলেও তিনি খুব তরুন ব্যাবসায়ী, প্রফেশনাল হলেও তিনিও সম্ভবত সবে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। বছর কয় আগেও যার বা যাদের পরিচয় ছিল কেবল ছাত্র। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক দু এক জন চুল পাকনা গিলে করা পাঞ্জাবী পাজামা'র দেখা মিললেও বাকী সব মুলত জিন্স ফতুয়া টিশার্ট।
চারুকলার জয়নুল গ্যালারীর উপরে গোল হয়ে প্রতি সন্ধ্যায় এরা মিটিং করে। ঠিক করে আগামী দিনের কার্য্যক্রম।
মূল এই সার্কেলের ভেতর আবার ছোট ছোট বৃত্ত আছে, যেমন শিল্পীদের দল, ফিল্ম মেকারদের দল, কবিদের দল, সংবাদ কর্মীদের দল, সংগীত শিল্পীদের দল, নাটকের দল, ছাত্র/ছাত্রী... এরকম আরো আরো দল। এ সব গুলো মিলে এক সঙ্গে সচেতন শিল্পী সমাজ। আমিও এদের এক দলে নাম লেখাই। যদিও এরা অনেকেই একে অন্যের মুখ চেনা বন্ধু স্বজন। ততদিনে আমিও তেমন আগুন্তক আর থাকি না তাদের কাছে।
চুপচাপ ওদের আলোচনা শুনে যাই। ওরা শিল্প কর্মের নামে যত্র তত্র ছাইপাশ নির্মানের যেমন বিরোধী তেমনি সমালোচনা করে টেলিভিশনে প্রতিভা সন্ধানের নামে কর্পোরেট পৃষ্ঠপেষকতায় চ্যানেল অলাদের অপকর্মের। আলোচনার বিষয় থেকে বাদ যায় না শিশুদের গানের অনুষ্ঠানের নামে টিভি অলাদের যথেচ্ছতাও।
শিল্প কর্ম ভাঙ্গার কারনে যে প্রতিবাদ মিছিলটি হয়ে ছিল সেদিন সেটিই আস্তে ধীরে এই দেড়মাসের মাথায় একটি মুভমেন্টে পরিনত হচ্ছে এই কথা ভাবতে ভাবতে আমি প্রতি রাতে বাড়ী ফিরি। বাড়ীতে এসে দিনের ফিরিস্তি লিখে ব্লগাই।
সেই সব লেখার শিরোনামে কখনো লিখি 'তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি' কখনো বা লিখি 'ঐ আলোর মিছিল ডাক দিয়ে যায়, তোরা কে কে যাবি আয়' অথবা লিখি আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন থাকতাম বোনের বাসায়, রাতে খেতে বসলে আমার বোন এসে আমাকে গল্প শোনায় আজকে কোন চ্যানেলে গানের অনুষ্ঠানে কোন বাচ্চাটা কি কি পাকনামী করেছে, আমার চাচী কাজের মেয়েটা দেখে হিন্দি সব সিরিয়াল, ভাগ্নি দেখে হিন্দি রিয়্যালিটি শো রোডিজ! লক্ষ্য করেছি পরিবারের সবাই মিলে একত্রে বাংলায় কেবল পোংটা নাটক গুলো দেখে। যার নাম হয়তবা বাসের চাকা, পানির গ্লাস, ইংরেজী পরীক্ষায় বাংলা নকল কিংবা কাউয়ার ঠ্যাং বকের ঠ্যাং টাইপের। আমার মাথা আর গোলাতে বাকী থাকে না কিছু! মধ্য রাতে যখন রিমোট কন্ট্রোলটা হাতে পাই তখন দেখি দিনের শেষে মধ্যরাতে অশ্ব ছোটাচ্ছেন সবাই! চ্যানেলে চ্যানেলে এক যোগে ক্যামেরার সামনে চলছে রাজা উজির হাতি ঘোড়া কতল। টক শো নামের মহান মহান সব টেলিভিশন প্রযোজনা! এত সব দেখে দেখে গলা আমার শুকিয়ে এলে পানি খেতি ডাইনিং স্পেসে যাই।
টেবিলের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গ্লসের দিকে তাকিয়ে থাকি অসহায়। আমার বোন এসে বলে কিচ্ছু হইত না ভাই খাও খাও। আমরা এই পানি খাইয়াই বইচ্চা রইছি। ফুটাইন্না পানি, ঐ গুলান তলানী কোন অসুবিধা নাই আল্লাহ্ নাম নিয়া খাইয়া ফেল। মনে মনে বলি উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে কোথায় চলেছ তুমি স্বদেশ, কোন সমাজ নির্মানে? অথচ এখানে মানুষ এখন পর্য্যন্ত খাবার জন্য এক গেলাশ বিশুদ্ধ পানি পর্য্যন্ত পেলনা!
এর মাঝে এক দিন কাওরান বাজারের আমার বড় ভাইয়ের অফিসে বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই।
দেশে এসে সেই জুলাই মাসে এয়ার্পোটে দেখা হয়ে ছিল আর দেখা হয় নাই। এ খবর সে খবরের পর দাদা জানতে চাইলেন দেশে আমি কি করছি অর কয় দিন আছি? আমি তাকে বিপুল উৎসাহে বলতে শুরু করি আমার মিশন অপরাজেয় বাংলা'র গল্প। আর এ গল্প বলতে আমার কোন ক্লন্তি লাগে না বলা শুরু করলে কোথায় কেম্নে থামতে হবে হুশ জ্ঞ্যান থাকে না। এক সময় কথা বলতে যেয়ে লক্ষ্য করলাম আমার বড় ভাই বিষন্ন হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি কথা শেষ করলাম।
আমার বড় ভাই এক সময় বুয়েটের তিতুমীর হল থেকে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ছিলেন। দাদার কেনা প্রেমাংশুর রক্ত চাই আর জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ পড়ে এক জীবনে চিনে ছিলাম নির্মলেন্দু গুন, মোহন রায়হান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশের কৃষক, জীবন আমার বোন, রৌদ্র করোটিতে বাংলাদেশ... বদর উদ্দিন উমর, মাহমুদুল হক, শামসুর রাহমান, খান মোহাম্মদ ফারাবী; সব সব চিনেছি দাদার বইয়ের তাক ঘেটে। সেই ভাই কেমন যেনো হতাশ কন্ঠে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বললেন, বিদেশ থেকে আইছ এই দেশের ভাবচক্কর ঠিক মত বুঝতে পারবা না। নিজেরে একটু সামাল দিয়া চলবা।
আর যে ইমোশন নিয়া কথা কইতাছ ঐ ইমোশন কেবল শাহাবাগ থেকে ইউনিভার্সিটি পর্য্যন্ত মিছিল করবে এর বাইরে কেউ ফিরা ও তাকাবে না। এইটা হইল এ দেশের চরম বাস্তবতা। নো বডি কেয়ার্স, নাথিং বদার্স টু নো ওয়ান! চরম অনিয়মের আর অরাজকতার রাজ্যে তুমি ফিরা আসছ!
দাদা'র কথা গুলো মুখস্ত বলতে পারবনা ঠিক তবে তার কথার সারমর্ম ছিল এই। তার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমাকে মানা করি না কিছুই শুধু খেয়াল রেখ নিজের দিকে। মনে রাখবা এই দেশে নিয়মে চলে না কিছুই, নিয়ম মানে না কেউ।
রাস্তা পার হবার সময় ট্রাফিক সিগনাল দেখে হাটা শুরু কইর না চোখ কান খোলা রাখবা সবসময়। সবাই যেম্নে পার হবে অমন কইরা তোমারেও পার হইতে হবে নাইলে গাড়ীর তলে পরবা। আমাকে শান্তনা দিয়ে দাদা বললেন, কথা গুলো শুনতে হয়ত খারাপ লাগবে তোমার তবুও বললাম নইলে এই করাপ্ট কান্ট্রিতে তুমি টিকতে পারবা না।
আমার শৈশবে আমি আমার ভাই কে দেখে একদিন কবি হবার স্বপ্ন দেখে ছিলাম, শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখে ছিলাম সে ভাইকে যখন দেখি এমন আশাহত আর বিব্রত তখন মন খারাপ হয়ে যায় খুব। অপরাজেয় বাংলা, সে কি কেবল গাল ভরা কোন নাম, কথার কথা? স্বাধীনতার ৩৮ বছরে যে দেশে আধা গ্লাশ পানিরই কোন শুদ্ধতা নাই, সে দেশে মানুষ শুদ্ধ হবে কি করে!
জানি না, জানি না, জানি না...
(ছলিবেক)
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন: অপরাজেয় বাংলা (১ থেকে ১৫ এবং + )
ওয়েব ঠিকানা, অপরাজেয় বাংলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।