আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দু'জন পৌরাণিক মায়ের কাহিনী

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

গান্ধারী, মহাভারতে বর্ণিত হস্তিনাপুরের জন্মান্ধ মহারাজা ধৃতরাষ্টের সহধর্মিনী। গান্ধার নরেশ শকুনীর বোন ও দুর্যোধনসহ শত পুত্রের মাতা। রাঁধা, দ্রোপদী বা কুন্তীর মতো আলোচিত নারী চরিত্র তিনি নন। কিন্তু অন্তত আমার কাছে তাঁকেই মহাভারতের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সর্বগুণে গুণান্বিত একজন পরিপূর্ণ নারী বলে মনে হয়। সততা, ধর্মনিষ্ঠা, স্বামী ভক্তি এবং পরিস্থিতিকে সহ্য করার অনন্য ক্ষমতাসম্পন্ন চারিত্রিক দৃঢ়তা মহাভারতের অন্য কোন নারীচরিত্রে আমি পাইনা।

তবে তাঁর চরিত্রের সকল রূপকে যে রূপটি ঢেকে দিয়েছে তা হচ্ছে পুত্রস্নেহ। প্রকৃতপক্ষে এটাই নারীর শ্বাশত রূপ। স্বামী অন্ধ ছিলেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন স্বামীর মতো এ পৃথিবীর আলো তিনিও দেখবেন না। তাই বরণ করে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছা অন্ধত্ব । শত পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন।

কিন্ত তাঁরা কে দেখতে ক্যামন তা তিনি কখনো জানেননি। চোখের আলোকে পরিত্যাগ করলেও সততার আলো ছিল তাঁর চোখের নিত্যসঙ্গী। সে কারণেই পুত্রদের প্রতি স্বামীর অন্ধ ভালবাসাকে যেমন মেনে নেননি তেমনি ভ্রাতা শকুনীর কূটচালকেও প্রশ্রয় দেননি। ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি জানতেন তাঁর ছেলেরা অধর্মের পথে আছে।

তাই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে তিনি নিজ পুত্রদের দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ দিলেও বিজয়ের আশীর্বাদ দেননি। অধর্মী পুত্রের বিজয় তিনি চাননি সত্য। তবে তার ধ্বংস এড়াতে শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তার ছেলেকে দীর্ঘজীবি দেখতে চেয়েছিলেন। এ কারণে স্বামীর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন সেই স্বেচ্ছা অন্ধত্বকেও কিছুক্ষণের জন্য ত্যাগ করেছিলেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এক পর্যায়ে দুর্যোধনের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত রূপ লাভ করে। ইতোমধ্যেই পিতামহ ভীস্ম শরশয্যায় চলে গেছেন, গুরু দ্রোণাচার্য ও অঙ্গরাজ কর্ণ নিহত হয়েছেন। দুঃশাসন সহ নিরানব্বই ভাই নিহত হয়েছেন। এই চরম মুহুর্তে গান্ধারী দুর্যোধন বললেন সন্ধি করার জন্য। বরাবরের মতোই উদ্ধত দুর্যোধন তা নাকচ করলেন।

গান্ধারী বুঝলেন ছেলের মৃত্যু অবশ্যসম্ভাবী। তবুও শেষ চেষ্টা করলেন। দুর্যোধনকে বললেন নগ্ন অবস্থায় গঙ্গায় স্নান করে সেই অবস্থায়ই তাঁর কাছে আসার জন্য। দুর্যোধন বিব্রতবোধ করলে গান্ধারী বললেন মায়ের সামনে ছেলের নগ্নাবস্থা বিব্রত হওয়ার মত কিছু নয়। তাছাড়া দুর্যোধনতো তাঁর কাছে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মতোই।

তাঁকে তিনি কোনদিন দেখেনেনি। দুর্যোধন নগ্ন অবস্থায় গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। ফিরবার পথে শ্রীকৃষ্ণের সাথে দেখা হল। চতুর ও কৌশলী শ্রীকৃষ্ণ এ অবস্থার অন্তর্নিহিত মানে জানতেন। তিনি দুর্যোধনকে ক্ষেপানোর জন্য বললেন রাজপুত্রের এ বেশ শোভা পায়না।

দুর্যোধন জানালেন মায়ের আদেশেই তিনি এমনটি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন মায়ের কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা মানার মতো সংস্কৃতি তোমার মাঝে নেই। মায়ের কোন সদুপদেশই তুমি মাননি। কাজেই এই উপদেশ পালন করারও কোন মানে নেই। তছাড়া এ অবস্থায় মায়ের সামনে যাওয়াটা সভ্যতার পর্যায়েও পড়েনা।

কৌশলী শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য বুঝার সামর্থ্য দুর্যোধনের ছিলনা। শ্রীকৃষ্ণ যে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে তাঁকে এ নগ্নাবস্থা থেকে ফিরাতে চাচ্ছেন তা সে বুঝতে পারলনা। শ্রীকৃষ্ণের কথায় প্রণোদিত হয়ে দুর্যোধন শরীরের নিম্নাংশটিকে কলাপাতায় আবৃত করে মায়ের সামনে গেলেন। গান্ধারী তাঁর চোখের আবরণ খুললেন। অবাক বিস্ময়ে প্রথমে পুত্রকে দেখলেন।

পরে ব্যথিত হয়ে বললেন, ‍"পুত্র! আমি তোমাকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমার কাছে আসতে বলেছিলাম। জীবনের এই চরম ক্ষণেও তুমি আমার কথা শুনলেনা। যদি তুমি আমার কথা শুনতে তবে তুমি নিরাপদ হয়ে যেতে। কারণ তোমার শরীরের যে অংশে আমার দৃষ্টির আলোকছটা লেগেছে সে অংশ সকল অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যদি তুমি নগ্নাবস্থায় আসতে তবে তোমার পুরো শরীরই অশুভ থেকে রক্ষা পেত"।

উদ্ধত দুর্যোধন বললেন, "এতেই চলবে। আগামীকাল আমি ভীমের সাথে গদা যুদ্ধ করব। এ যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে কেউ শরীরের নিম্নাংশে আঘাত করতে পারেনা। শরীরের বাকি অংশ যেহেতু নিরাপদ সেহেতু ভীম আমার কিছুই করতে পারবেনা। আমি ভীমকে এমন আঘাত করব যে সে মৃত্যুকে সানন্দে গ্রহণ করবে"।

পরদিন যথারীতি গদা যুদ্ধ হল। ভীম কিছুতেই দুর্যোধনের সাথে পেরে উঠছিল না। উপায় না পেয়ে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে ভীম কাপুরুষের মতো দুর্যোধনের নিম্নাংশে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করেন। মহাভারতেরই আরেক মহান চরিত্র ভীস্ম। তিনি দেবী গঙ্গার পুত্র, মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের চাচা এবং অর্জুনদের পিতামহ।

সততা, নির্লোভ ও দেশপ্রেমের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। হস্তিনাপুরের যুবরাজ ছিলেন তিনি। তাঁকে কেন্দ্র পিতার সাথে দ্বিতীয় স্ত্রীর অশান্তি আসতে পারে ভেবে এবং পিতাকে সুখী করার প্রয়াসে সিংহাসনের উপর থেকে তাঁর অধিকার প্রত্যহার করেন। শুধু তাই নয়, প্রতিজ্ঞা করেন যে আজীবন অবিবাহিত থেকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনকে রক্ষা করে যাবেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তা করে গেছেনও।

হস্তিনাপুরের সিংহাসনের সাথে বাঁধা ছিলেন বলে অধর্ম জেনেও হস্তিনাপুরের ধ্বজের নীচে যুদ্ধ করে গেছেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে অর্জুনের বাণের আঘাতে ভীস্ম শরশয্যা নেন। হস্তিনাপুর চারিদিক নিরাপদ- এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইচ্ছামৃত্যুর বরদান সত্ত্বেও তিনি শরশয্যার কষ্টকে বহন করে চলেছিলেন। যুদ্ধে যুধিষ্ঠিদের জয়ের পরে যখন তাঁর মনে হল তার দেশ চারিদিক থেকে নিরাপদ তখন জন্মান্তরের এই কঠিন বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য মৃত্যুকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাণত্যাগের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুনয় করে বললেন, যেন মৃত্যুর পরে ভগবানের চরণে তাঁর ঠাই হয়।

শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বললেন, একজন ভক্ত হিসেবে ভগবানের কাছে ভীস্মের পাওনা আরো অনেক বেশি। ভীস্ম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভক্তের কাছে ভগবানের চরণে ঠাই পাওয়ার চাইতে আর কি বেশি পাওনা থাকতে পারে? উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "মায়ের কোল। মায়ের কোন সন্তানের কাছে ঈশ্বরের চরণযুগলের চেয়েও অনেক বেশি পবিত্র"। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীস্মকে তার মা অর্থাৎ দেবী গঙ্গার কোলে চির ঠাই দিলেন। প্রথমোক্ত কাহিনীটার উদ্দেশ্য হচ্ছে মা তাঁর সন্তানকে কতোটা ভালবাসেন তা বিবৃত করা।

স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসার তাগিদে গান্ধারী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন অন্ধ স্বামীর মতোই এ পৃথিবীর আলো তিনি আর দেখবেন না। কিন্তু সন্তানকে রক্ষা করার জন্য গান্ধারী তাঁর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গেন। এখানে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা বা আনুগত্যের চেয়ে পুত্রের প্রতি মায়ের স্নেহ যে গভীর তা ধরা পড়ে। দ্বিতীয় কাহিনীটার উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তানের কাছে মায়ের মূল্য কতোটুকু তা উপস্থাপন করা। ঈশ্বর এখানে স্বয়ং বলেছেন মায়ের কোল সন্তানের কাছে ঈশ্বরের চরণযুগলের চেয়েও পবিত্র।

অর্থাৎ সন্তানের কাছে মা ঈশ্বরের চেয়েও শ্রদ্ধেয়, ঈশ্বরের চেয়েও আরাধ্য। আর আমার মা? না, তিনি পৌরাণিক চরিত্রের কেউ নন। তিনি বাস্তব। তবে পৌরাণিক চরিত্রের মায়েদের চেয়েও অনেক বেশি উজ্জ্বল। মায়ের সমস্ত কর্মকান্ড, চিন্তা-চেতনা পরিপুষ্ট হয় আমাকে ঘিরে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ঈশ্বরই হয়তো আমার কষ্টকে লাঘব করবার জন্য মায়ের রূপ ধারণ করে এ পৃথিবীতে এসেছেন। ইশ্বরের অন্য রূপ হয়তো মা কিংবা মায়ের অন্য রূপই হয়তো ঈশ্বর।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।