আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাইলাম তুমুল বৃষ্টি, পেলাম তুমুল ঝড়, বাঁধভাঙ্গা পানি.... আইলার তান্ডব



গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে অন্য সবার মত আমরাও অতীষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। এত প্রচন্ড তাপদাহ অনেক বছর দেখিনি! মাঠ ফেটে চৌচির, এই চৌচির কথাটা আমরা বইতে ছোট বেলায় পড়েছি, এখনো বলতে গেলে অবলীলায় বলে ফেলি। কিন্তু এর যাতনা যে কি, তা যারা মাঠে ফসল ফলাতে যান তারা হাড়ে হাড়ে টের পান। পৃথিবীর যেন আকন্ঠ পিপাসা, এত এত সেচের পানি নিমীষেই গিলে ফেলছে, মাটি আবার সেই শুকনো! তাই খুব চাইছিলাম তুমুল বৃষ্টি হোক, সব ভেসে যাক। আর ভাল লাগে না! মে মাস শেষ হয়ে এল এতটুকু বৃষ্টি নেই, ঢাকায় আবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে, অথচ উপকূলের এই এলাকা গুলোতে বৃষ্টিরে নামগন্ধ নেই।

সবাই শুধু বৃষ্টি চাই। আমার ষ্টাফরা বলছে, আল্লাহ, ভগবান কবে যে বৃষ্টি দেবেন তার কে জানে! যখন তিন নম্বর সংকেত শুনলাম, বন্ধুরা, পরিবার পরিজন খবর নিল, কেমন আছ? কোন সমস্যা? আমার রাগ হয়! কোথায় কি তিন নম্বর? এখানে এখনো রাতের আকাশে তারা ঝিলমিল করে! এই বুঝি প্রথম, রাতের আকাশের তারাকে ভাল লাগে না। আমরা মেঘমুক্ত আকাশ চাই না, তারা ভরা আকাশ চাই না। আমরা মেঘের গর্জন শুনতে চাই, তুমুল বৃষ্টির শব্দ শুনতে চাই। পৃথিবীর পিপাসা মিটে যাক।

মাটির শুকনো পোর স্পেস গুলো সব ভরে যাক, পানির স্তর উপরে উঠে আসুক। এ খরা থেকে মুক্তি চাই। আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়, তিন নম্বর সঙকেতে আমরা বরং একটু খুশি হয়ে উঠি। উপকূলের নদীগুলোর নিয়ম প্রকৃতি ভারী আলাদা। এখানে জোয়ার ভাটা হয় দেখার মত।

ভাটার সময় নদীগুলো শুকিয়ে মৃতপ্রায় খালের মতন হয়ে যায়, আবার যখন জোয়ার হয় তখন নদীগুলোকে দেখায় পূর্ণযৌবনা, দুকূল ছুঁয়ে যায় পানি। এহেন নদীটি তিন নম্বর সংকেত এর খবরে আরো একটু খুশিতে ডগমগ করতে করতে আরো ফুলে ফেঁপে ওঠে। জোয়ারের সময় তার দুকূল উপচে ওঠে। বৃষ্টি নামে, আমরা খুশিতে ভিজি, ভরা সন্ধ্যায় বৃষ্টিস্নাত হই। রাতের ঝোড়ো হাওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সারা রাত ছাপিয়ে পরদিন বা তারপরদিনও তার দেখা মেলে না। মিলবে কি ভাবে? পরদিন থেকেই ঝোড়ো হাওয়া। আমাদের নিয়মিত কাজ বন্ধ করে আমরা অপেক্ষা করি ঝড় থামার। তারপরও ২.৫ ইঞ্চি বৃষ্টি হওয়াতে মন খুশিতে ভরে ওঠে, মনে হয় এমন আরো দুদিন হোক, ভেসে যাক ডুবে যাক সব। আমার জাফনা সারাক্ষন বৃষ্টিতে ভিজে, একটু পরপর ভিজে আসে।

এর মাঝেই আসতে থাকে দুঃসংবাদ। একর পর এক। দাকোপ এ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে, ভেসে গেছে গরু বাছুর, ধান ভর্তি দানের গোলা, বাড়ী ঘর সব সবকিছু। মানুষগুলো কাছের স্কুলঘরে ঠাঁই নিয়েছে। কজন নিতে পেরেছে কে জানে! চালনা বাজার দেড় ফুট পানির নীচে।

ঘুর্ণিঝড় আইলা তার ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে আমাদের উপর দিয়ে। তার সোহাগে কাজীবাছা নদী ভরা জোয়ার আসবার আগেই ফুসে ওঠে, সে কি রূপ তার। মাটির বাঁধ এর নরম জায়গা ভেঙ্গে পানি উপচে পড়ে বাজার ভেসে গেছে। এবার প্রাণপণ ঠেকানোর চেষ্টা। কিছুদুর পরপর বাঁধ উপচে লোনা পানি ঢুকছে ভিতরে।

বিকেল হতে পানির তোড় আরো বাড়ে, প্রমত্তা নদী কাকে বলে এবার চাক্ষুষ দেখা। সে কি জল! চারদিক শুধু থই থই জল, আর উত্তাল ঢেউ, সব রকম নৌকা ফেরী চলাচল বন্ধ দুপুর থেকে। "পূর্ণিমার আগে ভারী অমাবস্যার লেজে ভারী" ঘূর্ণিঝড় আইলা এসেছে অমাবস্যার পরে তাই জোয়ারের এত তেজ। এদিকে পূবের ঝোড়ো বাতাস, তাইতে জল কমার নাম নেই। কেননা পূবের বাতাসে জল বাড়ে, অর্থাৎ পূবের বাতাস সাগরের জল কে ডাঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে আসে, নামতে দেয় না।

বিকেল এ ভাটার সময়ও নদীর কূল সমান জল। এই যদি ভাটা হয় তাহলে জোয়ারে কি হবে! মাটি র বাঁধে আছড়ে পড়ছে পানি, ওপারে বাঁধ চুঁইছুই জল। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়বে বাঁধ, তলিয়ে যেতে পারি আমরা, দাকোপ এর মত। জাফনা বলে সমুদ্দ, সমুদ্দে কত ঢেউ! শেষ ভাটায় পানির উচ্চতা একটু কমে, ঝড় তবু কমে না। থেকে থেকে হাওয়া দিয়ে যায়।

এমনটি কখনো দেখিনি আমরা, এখানটায় যারা থাকেন তারাও না। সারাদিন থেকে থেকে ঝড়! রাতের জোয়ারে তলিয়ে যাবার ভয় নিয়ে আমরা রাতে ঘুমুতে পারি না, ঘুমানোর চেষ্টা করি। এদিকে খবর পাই দাকোপে যারা বেচে আছে তারা সারাদিন রাত না খেয়ে আছে, পিপাসার জলটুকুও নেই। এই শুনে আমার সহকর্মীরা ঘুমাতে পারে না। নিজেকে বঙ্গোপসাগরের কোন দ্বীপে বিচ্ছিন্ন্ জেলেদের মত মনে হয়।

বিদ্যুৎ না থাকায় বর্হিবিশ্বের সববকছুর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, কোন খবর দেখতে পারছি না। মুঠোফোনের দমও ফুড়িয়ে গেছে। আহা আমার সোনার বাংলা, তোমার কোলে আমরা এ দুর্যোগে কি অসহায় হয়ে আছি! রাতের হাওয়া পশ্চিম দিক থেকে বইতে শুরু করে, ফলে এ যাতে আমরা রাতের জোয়ারের ছোবল থেকে বেঁচে যাই, বেচে যায় এখানকার অসহায় মানুষগুলো। নদীতীরের ছিন্নমূল মানুষগুলো তাদের যৎসামান্য সম্বল হারিয়েছে সেই দুপুরেই। সকালে ঝকঝকে রোদ দেখে বোঝার উপায় নেই কাল এখানে কি হয়েছিল।

আমাদের রুটিন মাফিক কাজ, সব করা হয়। ফ্রিজে রাখা মাছ মাংস হয়তো পচে গেছে, দেখা হয়ে ওঠে না। মানুষ বাঁচে না, আরা খাবার! দুপুর এ বিদ্যুৎ এসেছে। সহকর্মী খবার আর পানি নিয়ে দাকোপ গেছে। ভেজা মাঠ দেখে ভাবি বৃষ্টি চেয়েছিলাম এমন ঝড় তো চাইনি! শেষ কথা: একটা ভরা সংসার, গোলা ভরা ধান, গবাদি পশু, চোখের নিমিষে পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে পুরো পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে যায়, এ কেমন কথা! উপকূলের এই এলাকা তে কাজের সূত্রে জড়িয়ে আছি প্রায় আট বছর।

আমার জন্ম এখানে নয়, আমি আজন্ম শহরে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। তবু এখানকার মানুষগুলোর সাথে আমার অন্যরকম একটা টান হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে চলতে হয় এদের। লবনাক্ততা, পানির সমস্যা, আর নিম্নচাপ জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এদের জীবনটাকে দূর্বিসহ করে তুলেছে। দীর্ঘমেয়দী পরিকল্পনা না করলে এভাবে বাঁধ ভাঙ্গবেই, আর মানুষ নিঃস্ব হবে, মরবেই।

অবশ্য আমরা তাদের মানুষ মনে করি কিনা সেটাও একটা কথা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.