বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায়
মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিলাম যখন মন তখন নষ্টালজিক ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিলো ইতিহাসের সেই ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেমবারে সোমবারে , এই মাত্র খবর এসেছে মহানবী (সাঃ) কুবায় ৩দিন অবস্থানের পর রওয়ানা দিয়েছেন তার উট কাসওয়ায় চড়ে মদীনা তথা সেদিনকার ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে । মহানবী (সাঃ) উটের পিঠে চড়ে চলছেন তাকে অনুসরন করে পিছনে চলছে কয়েকশ মুসলমান এবং স্থানীয় নারী পুরুষের দল কেউ হাঁটে কেউবা আবার ঘোড়া আর উটের পিঠে চড়ে । পথে মধ্যে একে একে পাঁচটি গোত্র নবীজি (সাঃ) কে তাদের সাথে থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন । কিন্ত বিনয়ের সাথে অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে নবীজি বললেন "আমার উটকে আপন ইচ্ছায় চলতে দাও । সেই সির্দ্ধান্ত নেবে আমি কোথায় আমার আবাস গড়বো।
"
এদিকে ইয়াসরিবের দ্বারপ্রান্তে পথের দুধারে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর কিশোরীর দল দফা হাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নবীজিকে সালাম জানানোর জন্য, বিগত দিনগুলো তারা রচনা করেছে নবীজির প্রসংশামূলক গান । আজ এই দিনে সেই গান তারা গেয়ে নবীজিকে তাদের মাঝে বরন করে নিবে। প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ যুবক ,পৌঢ় আর নারীর দল । সবাই আছে সেই মানুষটির প্রতীক্ষায় যিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত হয়েছেন । তিনি সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলেন এবং আল্লাহর বানীকে পৌঁছে দেন মানুষের কাছে ।
তিনি মক্কার আল আমীন যিনি কুরায়েশ দের কাছে সমাদৃত বিশ্বাসী এবং সত্যবাদী হিসেবে ।
অবশেষে শহরের দ্বারপ্রান্তে উটের পায়ে ধূলা উড়িয়ে মুজাহিদের দল নিয়ে মহানবী (সাঃ) প্রবেশ করলেন ইয়াসরিব শহরে। কিশোর কিশোরীর দল গেয়ে উঠলো মহানবীর প্রশংসা স্তুতি দফায় বেজে উঠলো সুরের মূর্ছনা । মহানবী (সাঃ) উট কাসওয়ায় বসে আছেন আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন এক নতুন দিনের সূচনায় । উট এগিয়ে চলছে তার আপন মনে ।
অবশেষে উটটি এসে থামলো মালিক বিন নাজ্জাজের বাসার সামনে। নবীজি উট থেকে নেমে সামনে একটি বাসা যার মালিক আবু আইউব (রা: ) সাথে দেখা করলেন । তার অভিভাবকত্বে থাকা দুটি শিশু সাহল এবং সুহায়েলের জমিটি তিনি পছন্দ করলেন এবং কিনে নিলেন ন্যায্য দামে । এবং সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মানের আদেশ দেন । মহানবী (সাঃ) বলেন "এটাই হবে আমার গৃহ, আমার ইবাদতের স্থান এবং আমার চিরস্থায়ী বিশ্রামের স্থান"।
মহানবী (সাঃ) ইয়াসরিবে একসময় যে হিজরত করবেন এবং এটাই হবে তার আবাসস্থল একথা বিভিন্ন আসমানী কিতাবে ভবিষ্যবানী করা হয়েছিল। Peace or Destruction গ্রন্হে হাজী মাহবুব কাশিম 'তাফরিহুল আসকিয়া ফিল আহওয়াল উল আম্বিয়া গ্রন্হের বরাত দিয়ে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ্য করেন। ঐ ঘটনাটি মহানবী (সাঃ) এর ইয়াসরিবে হিজরত সম্পর্কিত।
ইয়ামেনের রাজা তিব্বা স্বীয় রাজ্য থেকে সিরিয়া ও ইরাক বিজয়ের উদ্দেশ্যে বের হন । যাত্রাপথে তিনি এমন এক স্থানে এসে উপস্থিত হন যা বর্তমানে মদীনা নামে সুপ্রসিদ্ধ।
জায়গাটি তার খুব ভাল লাগে তাই তিনি তার নিজ পুত্রকে ঐ স্থানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন । কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই স্থানের লোকজন মিলে যড়যন্ত্র করে রাজা তিব্বার ছেলে কে হত্যা করে । নিজ পুত্রের এহেন পরিনতি রাজা তিব্বাকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে । তিনি ই স্থানের লোকজন সহ স্থানটিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিন্হ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে মদীনায় গমন করেন । তার নিজ সৈন্যদলের সহায়তায় তিনি সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দেন ।
কিণ্তু অবাক বিস্ময়ে পরদিন লক্ষ্য করেন সবকিছু আগের মত আছে যা গতকাল তিনি ধ্বংস করেছিলেন। এভাবে বারবার চেষ্টা করেও তিনি যখন এই শহরটির কিছুই করতে পারলেন না ।
এসময় তার সাথে প্যালাইস্টাইনে এবং সিরিয়ায় যুদ্ধের সময় বন্দী চারশ ইহুদী ছিলো এবং তারা তাদের আসমানী কিতাব তাওরাত সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবিহাল ছিলো। তাঁরা রাজা তিব্বাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে তিনি তার শক্তির ব্যবহার যতখুশী করতে পারেন । কিন্তু এই স্থানটি তিনি কিছুতেই ধ্বংস করতে পারবেননা।
কারন এস্থানটি হবে সর্বশেষ নবীর আবাসস্থল। তাদের তাওরাত থেকে আনীত এই ভবিষ্যৎ বানী আসলেই সঠিক কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য রাজা তিব্বা একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন । দুজন বৃদ্ধ ইহুদী তাওরাত গ্রন্হ হাতে একটি উন্মুক্ত স্থানে অগ্নিকুন্ডের উপর দিয়ে সম্পুর্ন অক্ষত অবস্থায় হেঁটে গেলেন । এরপর রাজা তাদের দুজন যাজক কে তাদের সেইসময়ে সবচেয়ে বেশী পূজিত অগ্নিদেবতার দুটি মূর্তি হাতে হেঁটে যেতে বললেন সেই একই অগ্নিকুন্ডের উপর দিয়ে এবং তারা ঐ অগ্নিকুন্ড অতিক্রম তো করতেই পারলেন না এবং আগুনে দগ্ধ হলেন।
নবীজি (সাঃ)এর হিজরতের অনুরসনকৃত পথ
অবশেষে রাজা তিব্বা বিশ্বাস করলেন তাওরাতে যা বলা হয়েছে সেই ভবিষ্যৎ বানীর উপর।
এবং এখানেই শেষ নয় তিনি তার এই মদীনা শহরের ধ্বংস পরিকল্পনা বাতিল করলেন । তিনি মুক্ত করে দিলেন তার চারশ বন্দি ইহুদীদের এবং তাদের সেখানে তিনি বসতি গড়ে দিলেন । এভাবে সৃষ্টি করলেন নতুন একটি শহরের তার নামানুসারে শহরটির নাম হল ইয়া তিব্বা নামে । সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শহরের নামে ইয়াসরিব এ পরিবর্তিত হয়। মহানবী (সাঃ) যখন এই শহরে আসেন তখন এই শহরটি ইয়াসরিব নামে পরিচিত ছিল।
রাজা তিব্বা তার প্রতিষ্ঠিত শহরটির সাহাউল নামে এক বৃদ্ধ ইহুদীর হাতে এক পত্র দিয়ে বললেন তার জীবদ্দশায় যদি সেই প্রতিশ্রুত শেষ নবীর দেখা পান যেন তার হাতে এই পত্রটি দেন । আর না হলে তার পুত্রকে একই কথা বলে যেন বংশ পরস্পরায় তারা এই পত্রটি শেষ নবীর হাতে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অবশেষে ১০৪০ বছর পরে যখন মহানবী (সাঃ) এর মদীনায় আসার সময় প্রায় সমাগত তখন এক দল লোক মদীনা থেকে মক্কা গেলেন নবীজির (সাঃ) সাথে দেখা করার জন্য । সেই দলে আইয়ুব আনসারী নামে এক ব্যক্তি আবু লাইলা নামে একজন যাত্রীর কাছে সেই রাজা তিব্বার পত্রখানি দিয়ে বলেন এই পত্রটি যেন নবীজিকে দেয়া হয়। আর তিনি নিজ থেকে এই পত্রটি না চাইলে যেন পত্রটি ফেরত আনা হয়।
এই প্রতিনিধি দলটি যখন নবীজি (সাঃ) সাথে দেখা করতে গেলেন নবীজি তখন আল্লাহর মারফতে জানতে পারলেন ঘটনাটি এবং তিনি স্বয়ং আবু লাইলাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন "তোমার নাম আবু লাইলা। রাজা তিব্বার আমাকে দেয়া পত্রখানি তোমার কাছে আছে সেই পত্রটি আমাকে দাও "। উপস্থিত সবাই অবাক হল এই ভেবে যে এবারই প্রথম আবু লাইলা নবীজির কাছে এসেছিলেন তাকে নবীজির চেনার কথা নয়। নবীজির আদেশে আবু লাইলা সবার সামনে পত্রখানি বের করে জোড়ে জোড়ে পড়লেন:
" আপনার প্রশংসা ঘোষনা করে এবং আপনার নিরাপত্তা ও কল্যান প্রাথর্না করে আমি আপনাকে ,হে মুহাম্মদ( আপনার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক)জানাচ্ছি: আমি আপনাকে গ্রহন করার এবং সেই কিতাবের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের ঘোষনা করছি , যে কিতাব আল্লাহ আপনার মাধ্যমে প্রেরন করবেন। আমি আরও ঘোষনা করছি যে, আমি আপনার ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছি এবং আমি আপনার আল্লাহকে সব কিছুর স্রষ্টা হিসেবে গ্রহন করেছি।
ইসলামী শরীয়তের সব বিধান, যা আল্লাহর তরফ থেকে আপনার কাছে আসবে , আমি গ্রহন করার ঘোষনা করছি।
'শেষ বিচারের দিনে আমি যেন আল্লাহর ক্ষমা পাই সেজন্য আমি আপনার সুপারিশ প্রার্থনা করছি এবং আপনি যেনো আমাকে বিস্মৃত না হন। আপনার আগমনের পূর্বেই আমি আপনাকে এবং ইসলাম সম্পর্কে আপনার বানী আমি গ্রহন করেছি এবং এ কারনে আমি আপনার প্রথম শিষ্য ও অনুসারী । আপনাকে গ্রহন করার দাবীর স্বপক্ষে আমি আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম খলিলুল্লাহর( আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম)ধর্মেও ধর্মান্তরিত হয়েছি এবং আমি এখন তার স্বর্গীয় বানীর ওপর বসবাস করছি। "
ইয়েমেনের রাজা তিব্বার
সীল ও স্বাক্ষর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।