আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হজ্বের সেই দিনগুলি - ৪তম পর্ব

বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায়
হজ্বের নানা রকম প্রস্ততির সাথে সাথে একটি বিষয় সবসময় লক্ষ্য রাখা উচিত যেন কোন ক্রমেই স্বাস্থ্যহানি না ঘটে । এবং হজ্ব ফ্লাইটের আগে বিশেষ করে ১০/১২ দিন আগে থেকে সব প্রস্ততি শেষ করে বিশ্রামে থাকাটা ভাল। কারন বিমানে উঠার পর থেকে পরবর্তী সময়গুলো বেশ ব্যস্ততায় কাটাতে হয় এবং একেবারে ব্যাগ লাগেজ সহ হোটেলে না উঠা পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়া সম্ভব হয়না। আর এয়ারপোর্টে অল্প কিছু আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশ সময় লেগে যায় । কারন এসময়টা মদীনা বা জেদ্দা এয়ারপোর্টে বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রতিঘন্টায় হাজার হাজার হাজী এসে ভিড়তে থাকে ।

হজ্বের অল্প কিছুদিন আগে রওয়ানা হলে বেশ ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় হাজীদের । একে নতুন দেশ অচেনা স্থান ,গরম আবহাওয়া মানিয়ে নিতে নিতে হজ্বের মত কষ্টকর ইবাদত শুরু হয়ে যায় । ফলে অনেকে অসুস্থ হয়ে যায় । তাই সবচেয়ে উত্তম হয় হাজীরা বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ যারা তারা যদি হজ্বের ৮/১০ দিনআগেই মক্কায় পৌঁছে যায় । ফলে হজ্ব শুরু হওয়ার আগেই তারা সেখানকার আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।

এ প্রসংগে একটি কথা বলে রাখা ভাল দেশ থেকে রওয়ানা হওয়ার আগে অবশ্যই সাথে একটি ছোট আকারের ব্যাগে কিছু কিছু প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে নিয়ে রাখা ভাল এক্ষেত্রে কারও যদি কোন পূর্বের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেই রোগের ঔষধ নিতে হবে । এছাড়া সাধারনত মাথা ব্যাথা,জ্বর,পেট খারাপ ইত‌্যাদি সমস্যার জন্য সহজলভ্য ভাল ঔষধ এবং শরীরের ব্যাথার জন‌্য বিষেশ করে নিতে পারেন মুভ স্প্রে । এটি দীর্ঘক্ষন হাঁটার পরে অনেক সময় দরকার পড়ে। তাছাড়া প্রচন্ড গরমে অনেক সময় ঠোটে ঘা হয় । এইজন্য কিছু অয়েন্টমেন্ট জাতীয় ক্রীম সাথে নিতে পারেন।

একটি কথা বলে রাখা ভাল যদিও সবাই জানে যে হাজীদের জন্য সেখানে অনেক ডাক্তার সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে । কিন্ত আমি প্রয়োজনের সময় দেখেছি এই সেবা পেতে অনেকে ভুক্তভোগীর শিকার হয়। আর সৌদিআরবের ফার্মেসীগুলোতে সাধারন এই ঔষধগুলোর মূল্যে অনেক বেশী হয়ে থাকে । উদাহারনস্বরুপ আমি একটি অয়েন্টমেন্ট ক্রীম কিনি বাংলাদেশী ৬০০ টাকা মূল্যে অথচ একই ক্রীম বাংলাদেশে থেকে কিনলে খরচ হত ২৮ থেকে ৩০ টাকা। এবং বিদেশে থাকাকালীন সময়ে সন্চিত অর্থ যথাসম্ভব অপচয় কম করলে অনেক সুবিধা হয়।

অবশেষে দেখতে দেখতে চলে এল সেই মাহেণ্দ্রক্ষন । সব আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করে মাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম জিয়া আন্তজার্তিক এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে । বিকাল ৪টায় সউদিয়া এয়ারলাইন্সে আমাদের নির্ধারিত হজ্ব ফ্লাইট। সেই মোতাবেক আমরা ৩ ঘন্টা আগেই বিমান বন্দরে পৌঁছে গেলাম। সেদিন সকাল থেকে আমাদের এজেন্সী ভিসা না পাওয়ায় আমরা বেশ টেনশনে ছিলাম ।

তবে আল্লাহ এর অশেষ রহমতে যাওয়ার আগেই সেটা পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে সমস্যা বাধলো আমাদের দলে আমার মা আর আনিস ভাইয়ের পাসপোর্ট নিয়ে । ভুল করে এজেন্ট তাদের পাসপোর্ট রেখে এসেছিলো অফিসে । এদিকে সমস্ত হাজীরা যখন একে একে ইমিগ্রেশনে ঢুঁকে পড়ছিলো তখন আমরা কজন অধীর আগ্রহে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করছিলাম আমাদের এজেন্টের জন্য । অবশেষে তাকে দেখা গেলো উর্ধ্ব শ্বাসে দুহাতে দুটো পাসপোর্ট উচু করে ধরে বিজয়ীর বেশে ছুটে আসছে ।

আমরা অবশেষে ৩০ মিনিট বাকী থাকতে কোন মতে দৌঁড়ে ঢুকে পড়লাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে । এখানে আমাদের সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিলো আমার স্কুলের বন্ধু রাজু এবং তপন আমার স্ত্রীর চাচাতো ভাই । দুজন বেস্ট এয়ারে চাকুরীর সুবাদে তারা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেল প্যাসেন্জার ওয়েটিং কাউন্টারে । ইতিমধ্যে তখন শুরু হয়ে গেছে যাত্রীদের বিমানে উঠার পালা। এর মধ্যে আসরের আযানের সময় হয়ে গেলো আমরা কজন দ্রুত নামাজ পড়ে নিলাম ।

এরপর আমরা মানে আমাদের দলের সফরসংগীরা যথাক্রমে আমি ,মা ,আমার ফুপাতো ভাই ইমতিয়াজ , তার খালাতো ভাই আনিস এবং ফুপাতো ভাই সারওয়ার , বন্ধু ডাক্তার আজিজ এবং উনার আম্মা । সব মিলিয়ে পুরুষ ৫ জন এবং মহিলারা ২জন লাইন ধরে দাড়ালাম সবার শেষে । মনে মনে ভাবছিলাম শেষ পর্যন্ত জায়গা হবে কি না । বিমানে প্রবেশ করে পড়লাম আরেক বিপত্তিতে । আমরা একসাথে কোথাও জায়গা পাচ্ছিলাম না ।

অবশেষে এক স্টুয়ার্ড আমাদের কে ইকনমি ক্লাশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে বিজনেস ক্লাশে জায়গা করে দিলো। সেখানে আমরা আমাদের যার যার মাকে পাশে নিয়ে নির্বিঘ্নে বসলাম। যাই হউক সব ভাল যার শেষ ভাল আমরা ইকনমির ক্লাশের টিকিটে স্থান পেলাম বিজনেস ক্লাশে । আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের শুরুটা বেশ ভালই হল । আমরা বেশ কিছু দিক থেকে ভাগ্যবান ছিলাম ।

আমাদের দলের সিনিয়র সারওয়ার ভাই ছিলেন । যাকে আমরা ভাই বললেও ওনার বয়স প্রায় ৭০ বছর ছিল। এবং এর মধ্যে তিনি আমাদের সাথে ১৮ তম হজ্ব পালনের জন্য যাচ্ছিলেন। উনি ছিলেন তাই একজন অভিজ্ঞ গাইডের মত । এবং পরবর্তীতে সেটা তিনি প্রতি ক্ষনে ক্ষনে প্রমান করেছিলেন।

এবং তিনি না থাকলে আমাদের হজ্বের কাজগুলো এত সহজে করতে পারতামনা। আরেকদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান ছিলাম সেটা হল আমাদের আরেক সফরসংগী ডা: আজিজ ভাই যিনি ন্যাশনাল হসপিটালে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ। তিনি আমাদের সময়ে সময়ে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা সেবা দিয়ে দ্রুত সুস্থ করে তুলতেন । এমনকি তিনি অন্যরা কেউ সাহায্যর জন্য আসলে শত ক্লান্ত থাকলেও সেবা করতে দ্বিধা করতেন না । আমার দেখা ভাল মানুষগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।

যাই হউক ঠিক সময়মত আমরা কজন সফরসংগী অবশেষে বিমান যাত্রার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম । কিন্ত সময় যত ঘনিয়ে এলো আমার মা ততই অস্থির হয়ে উঠলেন কারন এটাই ছিলো তার জীবনের প্রথম বিমানযাত্রা তার ছেলেমানুষী ভয় দেখে তাকে অভয় দিচ্ছিলাম আর মনে মনে বেশ হাসি পাচ্ছিলো ,তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো একটি ছোট্ট মেয়ে যে কিনা ভীত এবং একই সাথে কৌতুহলী কি হয় এই ভেবে । এর মাঝে বিমানের একটা ইন্জিনে কি সমস্যা দেখা দেওয়াতে বিকাল ৪টা পরিবর্তে ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের বিমান ডানা মেললো সউদী আরবের পবিত্র শহর মদীনার উদ্দেশ্যে । বিমানের স্টুয়ার্ড এবং এয়ার হোস্টেসগুলো আমাদেরকে বেশ আপন করে নিলো অল্পক্ষনের মাঝে। আমাদের সাথে তাদের ব্যবহার ছিলো আন্তরিক ।

আমার মা তার মানসিক ভীতি অল্প সময়ের ভেতরে কাটিয়ে উঠে আমাকে একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে । আর আমিও বাবার ভূমিকা নিয়ে একের পর এক "কেন"জাতীয় প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছিলাম । এরমাঝে আমরা বিমানে আমরা মাগরিব এবং এশার নামাজ সীটের মাঝে বসে কোনমতে আদায় করলাম। এরই মাঝে হালকা নাস্তা এরপর ভারী ডিনার সেরে একটা হালকা ঘুম দিয়ে উঠেই দেখি জানালা দিয়ে নীচে পবিত্র মদীনা শহরের আলো ঝলমলে শহর দেখা যাচ্ছে। মনে পড়লো প্রিয় রসুলের কথা যতই ধীরে ধীরে বিমান মাটির কাছাকাছি চলে আসছিলো ততই মনের তীরে ভীর করলো অনেক স্মৃতিকথা ।

একদিন এই শহরের তপ্ত মরুর লু হাওয়ার সাথে বয়ে আসলো সিন্গ্ধ শীতল সজীব বাতাসের পরশ । সেদিনকার অধীর আগ্রহে অপেক্ষামান ইয়াসরিববাসীরা চেয়ে দেখলো ধূলায় ধূসরিত ক্লান্ত একদল নরনারী এক জোত্যির্ময় পূরুষের নেতৃত্বে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে তাদেরই শহরের পানে। সেই পূরুষ আর কেউ নয় আমাদের প্রিয়নবী বিশ্বের জন্য প্রেরিত রহমত, হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তিনি যখন এই শহরের পথ ধরে এগিয়ে চললেন বেজে উঠেছিলো কিশোর কিশোরীর হাতে দাফা । তারা গেয়ে ছিলো সেদিন আমাদের নবীজির নামে প্রশংশামূলক অনেক গান ।

আজও যেন হাজার বৎসর পূর্বের সেই গান ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে । চোখ বন্ধ করলেই যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই ইতিহাসের পাতার মাঝে । অবশেষে আমরা দীর্ঘ প্রায় ০৬ ঘন্টা বিমানযাত্রা শেষে মদীনার প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন আব্দুল আজিজ এয়ারপোর্টে আমাদের বিমান অবতরণ করলো। স্টুয়ার্ড আর এয়ারহোস্টেস কে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা একে একে নেমে আসলাম বিমানের সিড়ি বেয়ে। এরপর শুরু হল একঘেঁয়েমী লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রশনের কাজ গুলো সাড়া।

সব কাজ শেষে আমাদের বলা হল আমাদের নিজ নিজ লাগেজ গুলো বুঝে নেয়ার জন্য । আমাদেরকে বলা হল আমাদের লাগেজগুলো বাইরে নামানো আছে । এবং বাইরে এসে যে দৃশ্য দেখলাম সেটা অতন্ত্য অপমান জনক ছিলো আমাদের জন্য । বিমানের প্রায় ৪০০ যাত্রীর লাগেজ গুলো কতৃর্পক্ষ এলোমেলো ভাবে ফেলে রেখেছিলো পথের উপর। মনে একটা তৃপ্তির স্বাদ নিয়ে প্রিয় নবীজির শহরে পা রেখে ভাল লাগছিলো সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে জায়গা করে নিলো অপমান আর রাগ।

আসলেই নবীজি নেই তাই আজকের এই মদীনাবাসীরা ভুলে গেছে আল্লাহর ঘরের অতিথিদের কিভাবে বরণ করতে হয় । যা হউক কোন মতে আমরা একে একে আমাদের লাগেজগুলো খুঁজে বের করে বাসে উঠিয়ে বসলাম । আমাদের মাঝে সারওয়ার ভাই একের পর এক স্থান দেখিয়ে গাইডের মত বর্ননা করে যাচ্ছিলেন তার নিজস্ব ভংগীতে। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বাস রওয়ানা দিলো হোটেলে উদ্দেশ্যে । আমরা অবশেষে যখন হোটেলে পৌছাঁলাম তখন প্রায় রাত ১২টা বাজে ।

আমরা মালামাল হোটেলের রুমে উঠিয়ে সেদিন ঘুমাতে গেলাম । ভোরে ফজরের নামাজের সময় আবার উঠে আমরা রওয়ানা হলাম জীবনে প্রথমবারের মত নবীজীর প্রিয় মসজিদ মসজিদে নব্বীতে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে ।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।