আমি দেশকে ভালবাসি,তুমি যদি দেশকে ভালবাসো তোমাকেও ভালবাসি। হজ্ব একটি দৈহিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদত। এতে যেমন আছে দীর্ঘ সফর ও বিশেষ স্থানে বিশেষ আমলের অপিরিহার্যতা তেমনি আছে গভীর রূহানিয়ত ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের বিষয়। আল্লাহর ঘরে হাজিরি মুমিন জীবনের পরম সৌভাগ্য। ঐ পুণ্যভূমিতে পৌঁছে বান্দা তার রবের উদ্দেশ্যে নিজের আবদিয়ত ও দাসত্বের এবং ইশ্ক ও মহববতের প্রমাণ দিবে।
আল্লাহর শিআর ও নিদর্শনাবলীর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করবে। নিজের জাহের ও বাতেনকে ইবরাহীম খলীলুল্লাহর রঙে রঙিন করার অনুপ্রেরণা অর্জন করবে এবং ঐ পবিত্রভূমির নূর ও নূরানিয়াত দ্বারা নিজেকে আলোকিত করবে-এটাই তো হজ্বের দর্শন ও তত্ত্বকথা।
বায়তুল্লাহ অভিমুখে হজ্বের সফর তো ইবাদতের সফর। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সফর। তাই আল্লাহর যে বান্দা হজ্বের নিয়ত করে তার অবশ্যকর্তব্য এই ইবাদতের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা।
এক্ষেত্রে জাগতিক প্রস্ত্ততির চেয়ে বেশি প্রয়োজন রূহানী প্রস্ত্ততি। কারণ যে ইবাদত ইখলাস ও তাকওয়ার সাথে এবং সুন্নাহ-সম্মত পন্থায় আদায় করা হয় তা কবুলিয়তের অতি নিকটবর্তী হয়ে যায়। তাই শুধু হজ্ব নয়, নামায-রোযা, যাকাত-সদকাসহ সকল ইবাদতকে জাহের-বাতেন উভয় দিক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের অনুরূপ করার চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
কিন্তু ধরুন, হজ্ব উপলক্ষে যদি শুধু বৈষয়িক প্রস্ত্ততির চিন্তা করা হয়, রূহানী বা আত্মিক প্রস্ত্ততির কানো প্রয়োজনই বোধ করা না হয় তাহলে তো প্রচুর অর্থ ও দীর্ঘ সময় ব্যয় করে যেভাবে যাওয়া হয় সেভাবেই ফিরে আসতে হবে।
বাস্তব জীবনে হজ্বের কোনো প্রভাব প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হবে না।
এটা ঠিক যে, হজ্বের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা, বৈষয়িক প্রস্ত্ততি নেয়া সম্পূর্ণ জায়েয বরং প্রয়োজন পরিমাণ প্রস্ত্ততি তো আবশ্যক এবং শরীয়তের নির্দেশ। উপরন্তু শরীয়তে ঐসব লোকের নিন্দা করা হয়েছে, যারা তাওয়াক্কুল ও তাকওয়ার নামে হজ্বের সফরে প্রয়োজনীয় পাথেয় না নিয়েই চলে যেত এবং সেখানে মানুষের নিকট ভিক্ষার হাত প্রসারিত করত। তবে বৈষয়িক প্রস্ত্ততির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভালোভাবে হজ্বের আহকাম ও মাসায়েল শেখা এবং নিজের হৃদয় ও অন্তরকে হজ্বের কল্যাণ ধারণের উপযোগী করা।
কুরআনে কারীমে তাকওয়ার পাথেয় অর্জনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وتزودوا فان خير الزاد التقوى، واتقون يا اولى الالباب.
(তরজমা) হজ্বের সফরে তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা কর, বস্ত্তত তাকওয়াই উৎকৃষ্ট পাথেয়।
হে জ্ঞানী লোকেরা তোমরা আমাকে ভয় করে চল। -সূরা বাকারা (২) : ১৯৭
স্মরণ রাখা উচিত, হজ্ব হল পুরো জীবনের আমল। পুরো জীবনে একবারই হজ্ব করা ফরয। তাহলে যে হজ্ব পুরো জীবন ব্যাপী পরিব্যপ্ত তার প্রভাব তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকতে হবে। তাহলে হজ্বকে প্রথাগত হজ্বের চেয়ে জীবন্ত হজ্বে পরিণত করার চেষ্টা করা কি অবশ্য কর্তব্য নয়? এই প্রচেষ্টা ও সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারাটাই তো হজ্ব কবুল হওয়ার অন্যতম বড় আলামত।
আর আল্লাহ তাআলার রহমত, মাগফিরাত ও জান্নাতের ওয়াদা তো মকবুল হজ্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সকল ইবাদতের মতো এই ইবাদতেরও প্রাণ হচ্ছে ইখলাস। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হজ্ব করা। লৌকিকতা, সুনাম-সুখ্যাতি, হাজী উপাধী লাভ ইত্যাদি যে কোনো দুনিয়াবী স্বার্থ ও উদ্দেশ্য থেকে এই আমলকে মুক্ত রাখা অতি জরুরি। ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
واما امروا الا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء
(তরজমা) তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর ইবাদত করতে তার আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্টভাবে। -সূরা বায়্যিনাহ (৯৮) : ৫
হজ্ব ও উমরা সম্পর্কে তো আল্লাহ তাআলা আরো বিশেষ ঘোষণা দিয়েছেন-
واتموا الحج والعمرة لله
(তরজমা) আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্ব ও উমরা পরিপূর্ণরূপে পালন কর। -সূরা বাকারা (২) : ১৯৬
জুনদুব আল-আলাকী রাহ. হতে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من يسمع يسمع الله به ومن يرائي يرائي الله به.
যে ব্যক্তি লোকসমাজে প্রচারের উদ্দেশ্যে নেক আমল করে, আল্লাহ তাআলা তার কর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো সৎকাজ করে, আল্লাহ তাআলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের মাঝে প্রকাশ করে দিবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৮৭
এজন্য হজ্বের সৌভাগ্যলাভকারীদের উচিত, আল্লাহ তাআলার নিকট রিয়ামুক্ত হজ্বের জন্য দুআ করতে থাকা।
এ তো স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও শিক্ষা। আনাস রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পুরাতন বাহন এবং চার দিরহাম বা তার চেয়ে কম মূল্যের একটি পশমী বস্ত্রে হজ্ব করলেন, তখন তিনি এই দুআ করলেন-
اللهم حجة لا رياء فيها ولا سمعة
হে আল্লাহ! আমার হজ্বকে রিয়া ও খ্যাতির আকাঙ্খমুক্ত হজ্বরূপে কবুল করেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৯০; শামায়েলে তিরমিযী, ৩৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১৬০৫৩; সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫১৮
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রাসূলের সুন্নত ও আদর্শ মোতাবেক হজ্ব করার তাওফীক দান করুন।
লেখক:আনসারুল্রাহ হাসান,মাসিক আলকাউসার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।