সাধারণত কাজ সারতে মকবুলকে তেমন বেগ পেতে হয়না। বেশীর ভাগ সময়েই তার চেহারা দেখেই আদমরা সুরসুর করে বিনা বাক্যব্যয়ে যা' কিছু থাকে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু যারা ক্ষুইরা মকবুলের চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হয়, কিংবা অতিরিক্ত ভীত হয়ে পড়ে, তাদের জন্য কিছুটা হ্যাপা পোহাতেই হয়। তবে ক্ষুরের দুই পোঁচেই কাজ সমাধা হয়ে যায়। ট্যাঁ ফো করার স্বাদ মিটতে সময় নেয় না।
দুহাতে বেড়িয়ে পড়া নাড়িভূড়ি সামলাতেই খবর হয়ে যায় নির্বোধগুলোর।
তবে আজকের দিনের কথাটা ভিন্ন।
এই প্রথম সে চুক্তিতে খতমের কাজ করতে যাচ্ছে। ছিচকে ছিনতাই করতে আর ভালো লাগে না। অনেক দিন ধরেই ভাবছে, দু একটা মার্ডার করে নাম ফাটলে, নিজেরই আড্ডা খুলে বসবে।
চেয়ারম্যানের ছেলে শাকিল যখন ঘোষদের পাড়ার সদরু মিয়াকে গুমের অফারটা দিল; সে নিতে দ্বিধা বোধ করেনি। একেতো শাকিলের হাতে থানা পুলিশ সব কেনা; তার উপর লাশটা গুম করতে চেয়ারম্যানের ইটের ভাটা ব্যবহার করতে পারছে। কোন চিহ্ন থাকার সম্ভাবনা নেই। হালখাতা খোলার ভালো সুযোগ বৈকি!
তবে কয়েকটা দিন খারাপ যায়।
যেমন আজকে।
দুই পোঁচের পরও গাধাটা তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। এদিকে, মাঠের ওদিক থেকে এক গাদা লোকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছিল। এদিকেই আসছে হয়তো। মকবুল শেষ পোঁচটা পড়লো লোকটার একেবারে কন্ঠনালী বরাবর। ফিন্কি দিয়ে ছুটে আসা রক্তে ভিজে গেলো সে অনেকখানি।
চিৎকার বন্ধ করার জন্য সে সদরুর মুখ চেপে ধরেছিল। তাতেই তার সারা শরীর রক্তে ভিজে একাকার। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ পা দাপাদাপি করলো সদরু। এরপর সবকিছু নিস্তব্ধ। ভ্যান গাড়িটা আগেই কোনায় নিয়ে রেখেছিল।
লাশটা টেনে উঠিয়ে ইটভাটার চুল্লীর দিকে নিয়ে গেলো সে। গন গনে তাপ জ্বলছে চুলার ভেতর। প্ল্যান মতো, আগেই শাকিল তার লোকদের যাত্রা দেখার জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। অন্তত আগামী এক ঘন্টা কেউ আর এদিকে আসছে না। লাশটা চুলায় ঢোকানোর আগে, শর্টের পকেট চেক করতে ভুলে গিয়েছিলো মকবুল।
তাই লাশ ছুঁড়ে ফেলার পর যখন 'খিল খিল শব্দে বাচ্চা একটা ছেলে হেসে উঠলো; এক মুহুর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে গেলো সে। এটা যে মোবাইলের রিংটোন সেটা বুঝতে দু সেকেন্ড লেগে গেলো।
হতচকিত অবস্থাতেই লোহার আংটা ধরে আবার টান দিলো লাশটা কাছে টানার জন্য। আগুন তখনও লাগতে পারেনি জামায়, সবে মাত্র কড়কড়ে হয়ে উঠছিলো রক্ত ভেজা জামা। পকেট থেকে মোবাইলটা সরিয়ে নিয়ে লাশটা আবার ছুঁড়ে দিল গনগনে আগুনের ভেতরে।
'যা, এইবার দুনিয়া ছাইড়া পলিটিক্স কর্.........!" মনে মনে একটা অশ্রাব্য গালি দিল সে।
মোবাইলটা একবার বেজেই থেমে গিয়েছিলো। আর কালক্ষেপন না করে, ভ্যানটা জায়গামতো রেখে সটকে পড়লো ক্ষুইরা মকবুল। এবার কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পালা। ডেরায় ফিরে, কাপড় চোপড় সব ধুয়ে, খাওয়া দাওয়া সারতে বসে মোবাইলের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলো সে।
ঘর থেকে বের হবার সময় আবার বেজে উঠলো মোবাইল টা!
'বাচ্চা ছেলের খিলখিল নিস্পাপ হাসি'!
শিরদাড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে আসলো যেন! মোবাইলটা এখনো অন আছে?! এত বড় ভুল সে কিভাবে করলো। দ্রুত সিমটা খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল সে পুকুরে। তারপরও মনের ভেতর একটু খুঁতখুঁত করতেই লাগলো। সে তো মোবাইলটা অফ করেই পকেটে ঢুকিয়েছিল!
যাকগে........!
রিংটোনটা আবার বেজে উঠলো তিন রাস্তার মাথায়!
বাসের জন্য দাড়িয়ে ছিলো সে।
ভাগ্যিস, আর কেউ ছিলনা।
দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। কোন নাম্বার নেই! খালি টর্চটা জ্বলে আছে। আজকালকার মোবাইলগুলোতে সিম ছাড়াই নানান কাহিনী করা যায়। মনে মনে মোবাইল কোম্পানীর উদ্দেশ্যে একটা কুৎসিত গালি দিলো সে।
এবার আর রিস্ক নিলোনা।
ব্যাটারি খুলে রাখলো।
চুড়ান্ত ভয়টা পেলো সে বাসের ভেতর। আবার রিং টোন বেজে উঠলো।
'সেই হাসিটা'!
আতংকে, তার কালো মুখটাও নীল হয়ে গেলো যেন নিমিষেই।
নিজেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রিফ্লেক্সে হাত চলে গেলো মাথার উপর।
নাহ! এবারো হয় কেউ খেয়াল করেনি অথবা ভেবেছে তার ফোন এসেছে।
সেটাই তো ভাবা স্বাভাবিক!
কিন্তু মকবুল তখন স্বাভাবিক বোধের বাহিরে চলে গেছে। ব্যাটারি ছাড়া যে মোবাইল ফোন বাজতে পারেনা, সেটা যে কোন অশিক্ষিত লোকও বুঝতে পারবে! সে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করলো। পকেটে হাত দিয়ে চেপে ধরলো মোবাইলটা। এই অভিশাপ সাথে রাখা যাবেনা।
পরের স্টপেজে পাশের লোকটা উঠে যেতেই, মকবুল জানালার ধারে চলে আসলো। বাসটা একটা কালভার্ট পার হচ্ছিলো যখন; ছুড়ে ফেলে দিলো সে মোবাইলটা জানালা দিয়ে।
স্বস্তির কারণে ঝিমুনিটা মনে হয় তাড়াতাড়িই চলে এসেছিলো।
কানে "নিস্পাপ সেই হাসির শব্দটা' যেতেই সেটা বোমা ফাটানোর মতো কাজ করলো! আবারও মোবাইল বাজছে। তার পকেট থেকে।
এবার তার মনে হলো আশে পাশের লোকগুলো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
কম্পিত হাতে পকেটে হাত ঢুকালো সে।
কিছু নেই!! শব্দ হয়েই যাচ্ছে।
আবারও পাগলের মতো পকেট হাতড়ালো সে।
কিচ্ছু নেই!! কিচ্ছু না!!
কিন্তু শব্দটা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বিকট থেকে বিকট স্বরে হেসে চলছে শিশুর কন্ঠ !!!
সে পকেট থেকে হাত বের করে চোখের সামনে ধরলো!
তার হাত থেকে মোবাইলের রিংটোনের শব্দ শোনা যাচ্ছে!
যে হাতে সে ক্ষুরের পোঁচটা দিয়েছিলো সদরু মিয়ার গলায়!
মকবুল উম্মাদের মতো হাত থেকে ছুড়ে ফেলতে চেস্টা করতে থাকে, কোন অদৃশ্য মোবাইল!! না পেরে, হাতটা কামড়ে ধরার চেষ্টা করলো আবার।
এবার শব্দটা শুরু হলো তার গলা থেকে।
আহঃ!!
আশে পাশের লোকজন কিছুই বুঝতে পারছিলোনা। কেন লোকটি অকারণে এরকম আচরণ করছে। বাসে থাকা অল্প কয়টা বিস্মিত দৃষ্টির সামনে মকবুল দুহাতে নিজ গলা টিপে ধরে।
"শালার মোবাইল! আমি মরলেও তোরে মারবো!!"
পরিশিষ্ঠ
খবর পেয়ে পুলিশ যখন নিউ সুমন বাস সার্ভিসের অফিসে আসে; ক্ষুইরা মকবুল তখনও মাথা ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে বের করতে চেস্টা করছিলো - সদরু মিয়ার মোবাইল রিংটোনের শব্দ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।