অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস
কোথায় আছে কেমন আছে মা!
ওরে তারা রাতের তারা মাকে জানিয়ে দিস
অনেক কেঁদেছি, আর কাঁদতে পারি না
জেমসের গাওয়া গানটা বেরিয়েছিলো কোনো এক ঈদ উপলক্ষ্যে। স্পষ্ট মনে পড়ছে আমি ঠিক ঈদের সকালে এলবামটা ছাড়লাম। এবং প্রথম অন্তরা শেষ না হতেই আমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারা। আমার এখনও জীবিত মা ঠিক কয়েক হাত দূরে বিছানায় বসা। কিন্তু আমি কাঁদছি।
একটু পর উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। মা হেসে বলেছিলো, কিরে পাগলা, তুই এত্ত সেনসিটিভ! আমি যখন সত্যি মারা যাবো তখন কি করবি!
উত্তরটা আমি ভেবেছি। ভেবে কোনো কুলদিশা পাইনি। আমার শুধুই মনে হয় তারে ছাড়া আমি শূন্য হয়ে যাবো। আমার সব ভরসা, সব আব্দারের তো একটাই জায়গা।
এই বুড়ো খোকাটাকে এখনও মা পালছে। বেকার বলে খোটা নেই, শুধু নফল নামাজের রাকাত বাড়ে। ছেলের সদগতির আবেদনটা দীর্ঘতর হয় প্রতি মোনাজাতে।
ক্লাস এইট পর্যন্ত আমার মা আমাকে পড়িয়েছেন। অ-আ, এ-বি-সি-ডি, আলিফ-বা'য়ে হাতেখড়ি।
আমাকে পেটে নিয়েই গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এরপর স্কুলে চাকুরী। ঘরের বউ চাকুরী করছে! শ্বশুরবাড়ীর এই নিন্দাবাদে একটাই যুক্তি দিয়েছেন- আমি পড়াশোনা শিখেছি শুধু হাড়ি ঠেলতে নয়। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মা শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত ঠায় বসে থেকেছেন হলের গেইটে। দুই পেপারের মাঝের সময়টা মেখে ভাত খাইয়ে দিয়েছেন।
আমার লাজুকতাকে অগ্রাহ্য করে দিয়ে গেছেন টিপস। হলে ঢোকার আগে মাথায় ফুঁ, বুকে ফুঁ, রাব্বি জিদনি ইলমা কতবার পড়তে হবে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন- যা বাবা।
দীর্ঘ সময় প্রবাসী এবং পেশাগত কারণেই নান্দনিক রসবঞ্চিত আমার ডাক্তার বাবার প্রভাব বলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটুকুই। বাকি সব মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার বেসিকটুকু তিনিই গড়ে দিয়েছেন তার আদলেই।
ছোটো থেকে ঘর ভর্তি রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎ। সেগুলো শেষ করার পর নিমাই-শংকর-যাযাবর-নীহাররঞ্জন। এমনকি রোমেনা আফাজও। সময় করে রেডিও সিলোন। বাকি সময় হেমন্ত-সতীনাথ-মানবেন্দ্র-সাগর সেন।
মাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছিলাম ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় এই রাত তোমার আমার গানটা শীষে শুনিয়ে। এই মার হাতে মার খেয়েছি আমি কলেজে পড়ার সময়ও। পাড়ায় একবার ককটেলের ধোয়ায় আচ্ছন্ন রাস্তা থেকে হকিস্টিক হাতে আমাকে সবার সামনে কান ধরে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়েছেন। তার বই পড়তে পড়তে গান শোনাটা এখনও ধরে রেখেছি। ওটাই টিপিকাল আমি।
এখনও রাত দশটার বেশী কোথাও থাকলে মা অস্থির হয়ে পড়েন। নাটকের মায়েদের মতো ভাত বেড়ে বসে থাকেন যতক্ষণ না খাবো। এখনও। আমার কোনো কাপড় কোনো বুয়ার হাতে দেবেন না, নিজে ধোবেন। এখনও।
নানাদের বংশে প্রচন্ড দাপুটে এই মা'টা কোথাও কোনো আত্মীয়ের বাড়ি যান না। তার স্বজন নাকি আমরাই। তার বাড়াবাড়ি রকম আগলানো ভাবে একবার ভাই বউ একটু বিরক্ত হয়েই সমালোচনা করেছিলো। বলেছিলো আপনার লাই পেয়ে সর্বনাশ হয়েছে এদের। বিব্রত মা শুধু বলেছিলেন- হয়তো ঠিকই বলেছো।
আসলে মায়ের আদর কি আমি তো জানি না, পাইনি। জন্মেই মা হারা। কিন্তু আমার মা থাকলে আমি তার কাছে যা যা চাইতাম ঠিক তাই দেয়ার চেষ্টা করেছি ওদের।
এই এখনও বাড়ির বাইরে পা দেয়ার আগে- মা আসি বলে বেরোই। কাছে পিঠে না থাকলে চেচিয়ে আবার বলি।
দূরে থাকলে কাছে গিয়ে বলি- মা আসি। তার মুখ থেকে আয় না শুনে আমি বেরোই না। কুসংস্কার হলে কুসংস্কার। কিন্তু আমার বিশ্বাস থাকে তার এই আসো আমাকে ঠিকই ফিরিয়ে আনবে তার কাছে। সেই কবচ বুলেটপ্রুফ।
এ পর্যন্ত লিখে মনে হচ্ছে কিছুই লেখা হলো না আসলে। মনে হচ্ছে আমার মাকে নিয়ে লিখতে বসলে আজ রাতেই ম্যাক্সিম গোর্কির চেয়ে বেশী চমকপ্রদ হবে তার আখ্যান। একটা সাম্প্রতিক ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। কদিন ধরেই বাড়িতে আমি আর মা। বুয়াটাও ছুটি নিয়ে দেশে।
মা ভুগছেন ভাইরালে। বার্ধক্যজনিত উপসর্গগুলো তো আছেই সঙ্গী। ডাক্তার দেখাবার সময় হয় না এই কুলাঙ্গারের। আসলে সাধ্যে কুলায় না। তাই সহপাঠীদের একে ওকে ফোন করে নিদান নিই।
সঙ্গে স্বান্তনা-ধুরো মা, এইসব ফ্লু ওষুধ খেলেও সাতদিন থাকবে। তোমার দরকার বিশ্রাম। মা'র মুখটা বেদনার্ত হয়। মাথার কাছে গত ক'দিনের শব্দজটের পাতাগুলো জমে আছে- তার একমাত্র অবসেশন। রাতভর কাজ করে ঘুম দিয়েছি।
পাশের ফ্লাটের আন্টি-ভাবীরা একটু পর পর এসে খোজ নিচ্ছেন মার। তাই নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছি। হঠাৎ কপালে খুন্তির ছ্যাকা খেয়ে উঠে বসি। খুন্তি না, মায়ের হাত। জ্বর তপ্ত শরীরে কোনো মতে বললেন- ওঠ, খাবি না বাবা? এই মারে নিয়ে আমি কি লিখবো!
জানি সব সন্তানের কাছে তার মা-ই সেরা।
আমার কাছে আমার মা। মানি মা আমার একটি দিনের একটি উইশ নয়। মা আমার গোটা জীবন, অনন্ত স্বত্ত্বা অন্তহীন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।