পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
মাংসের কারবার, মাংসের কারবারী -১
বাংলাদেশে যারা খোলামেলা পরিবেশে ন্যাচারাল খাবার দাবার খাইয়ে হাঁস, মুরগী , এমন কি শুকর পালন করবেন , তারা কোন দিন এইসব ফ্লু এর জন্ম দেবেন না । পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন , বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক থাকলেই হলো । কিন্তু যখনই এর ভিতর ঢুকে পড়ে অতি দ্রুত অনেক মুনাফা করার লোভ আর অনৈতিক, পাশবিক আচরন --- তখন মহামারী লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে আসে । হাজারে লাখে শুধু শুকর কেন , যে কোন প্রানীই যখন শুধু মাংসের বাজারে বিক্রি হওয়ার জন্য বদ্ধ খামারে ধুকে ধুকে মরে , তখন এম আর এস এ , এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুদের জন্ম হয়। শুকররা নিজেরাও কি এই পাশবিক লোভের শিকার না? নিচে দেখুন ঃ
মুরগীর ফার্মিং এর ব্যাপারে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা বলি ।
আমাদের বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছিলো জাহানারা । বিয়ের বয়স হলে বিয়ে দিয়ে সংসারসহ গ্রামের বাড়িতে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোরে । আয় বাড়ানোর স্বাভাবিক প্রনোদনা থেকেই জানু (জাহানারা) কোন এক এন জি ওর কাছ থেকে মুরগীর বাচ্চা পালন ও বড় করার জন্য ঋণ নেয়। কয়েক দিন পরে জিজ্ঞেস করলাম , কি ব্যাপার ? আয় কেমন বাড়লো ? বলতে না বলতেই জানুর মুখ ঝামটা আর বকাবকি শুরু হয়ে গেলো । আয় বাড়াতে গিয়ে বেচারি আরো গরীব হয়েছে ।
গল্পটা হলো এই রকম । মুরগী পালনের জন্য ঋণ দেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু ঋণ গ্রহীতা নিজের ইচ্ছে মত মুরগী কিনতে পারবে না । বাচ্চা নিতে হবে ঐ এন জি ওর কাছ থেকেই । নইলে ঋণ পাবে না। সেই বাচ্চা দেশী মুরগীর মত হাটে মাঠে ঘুরে খেতে পারে না ।
অতি দুর্বল । জানুর মতে , দেশী মুরগী একটা ঠোকর দিলেই মরে যায়। এমনি কাবু। তো তাকে এখন ঘরে বসিয়ে খাওয়াও। বিশেষ খাবার কিনতে ঐ সেই এনজিও ।
সাথে প্রতি সপ্তাহে ইঞ্জেকশন দিতেই হবে, নইলে রোগ হয়ে ফুট্টুস । তার মানে ঋণের পুরো টাকাটাই খরচ হয়ে যাচ্ছে এন জি ও কর্তৃক সরবরাহকৃত মুরগীর বাচ্চা, খাবার, ওষুধ আর ইঞ্জেকশনের পিছনে। শেষে ঘটনা দাঁড়াইলো , কয়েকটা বাচ্চা মরে যাওয়ার পরে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ভেটেনারি ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়েও সব কটাকে বাঁচানো তো যায়ইনি, জানুকে অন্য জায়গা থেকে ধার করে এনজিওর কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে ।
এই হলো মহাজনী সুদের ব্যবসার মাইক্রো ফাইন্যান্স , ডেভেলপমেন্ট আর তার সুফল !
এর পরের গল্প বহু বছর পরে সাভারে। ব্র্যাকের ট্রেনিং সেন্টারের পাশে ( টি এ আর সি - টার্ক ) তাদের নিজস্ব মুরগীর ফার্ম ছিলো ।
আমাদের খাদ্য সরবরাহ হতো সেখান থেকেই । মুরগী গুলো খেয়ে মজা নাই । (এইটা ফার্মের মুরগী , দেশী মুরগীর ব্যাপারে সকলেই স্বীকার করবেন। ) কিন্তু আমাদের আরো বড় সমস্যা ছিলো মাছি আর গন্ধ । অকল্পনীয় সেই গন্ধ আর লাখে লাখে মাছি রাস্তা পেরিয়ে , বন্ধ ঘরের জানালা ফুড়ে নাকে এসে এমন ধাক্কা মারতো , ঘুমানো অসম্ভব ।
দূর থেকেই যদি এই অবস্থা , ভেতরে কি হইতে পারে আমি কল্পনাও করতে চাই না । আমি জানি না এই গন্ধ কিসের ছিলো । ওষুধের , খাবারের নাকি বিষ্ঠার । কিন্তু ঐ অতি স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি ফার্মে মুরগী , হাঁস কিংবা শুকর আসলে কি ধরনের অস্বাভাবিক , অসহনীয় পরিবেশে বাস করে । হাটে , মাঠে , উঠোনে চরে বেড়ানো প্রানীদের সাথে এদের জীবন এর কোন মিল নেই ।
আসলে, জীবন বলেই কিছু নেই ।
কিন্তু কি ভাবে এর অবসান সম্ভব ? অনেকেই টাকার দোহাই দেন । এই পদ্ধতিতে প্রাণির চাষ ছাড়া নাকি খরচ বড্ড বেড়ে যাবে । কথা আসলে সেটা নয় । এই রকম অতি মুনাফার লোভে শেষ পর্যন্ত খরচ কমে না, বরং বাড়ে শত সহস্র গুণে ।
সে খরচ সব সময় টাকায় পরিমাপ সম্ভব না । আপনি কি ভাবে খরচ কমাবেন পরিবেশ ধ্বংস করে, মানুষ মেরে , নতুন মহামারী সৃষ্টি করে ? চিংড়ি খামারের কথা মনে পড়ে ? দ্রুত লাভ আর অতিরিক্ত টাকার নেশায় সমুদ্র উপকূল্বর্তী দেশ গুলো এক সময় লবনাক্ত পানি ঢুকিয়ে চিংড়ির যথেচ্ছ চাষ করেছে । তারপর? বছর ঘুরে ফলন কমতে কমতে এক সময় দেখা গেলো কোম্পানি পাততাড়ি গুটিয়েছে , চাষ বাসের জমি শেষ , উপকূলের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে মাছের ন্যাচারল রিসোর্স শেষ , কোরাল রিফ ধ্বংস । আমরা কি এনিমেল ফার্মিং এর বেলাতেও ঐ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো ?
একমাত্র কঞ্জুউমার সোসাইটি এবং রাষ্ট্রীয় চাপই পারে এই সব জঘন্য মুনাফাখোরদের মাজা ভেঙে দিতে । আশা হারাবেন না ।
জ়ি এম ফুডের কোম্পানিও অনেক শক্তিশালী ছিলো । মানুষ প্রত্যাখান করেছে বলে জেনেটিকালি মডিফায়েড ফুড গ্রাস করতে পারেনি বিশ্ব বাজার । এই সব পাশবিক এনিম্যাল ফার্ম গুলোও জেনেটিকালি মডিফায়েড ভাইরাস , ব্যাক্টেরিয়ার জন্মস্থান । যাদের বিরুদ্ধে কোন ওষুধ হয়ত আর কাজ করবে না । ভ্যক্সিন তো নয়ই ।
ভ্যাক্সিনের কথা ডাহা মিথ্যাচার। ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যই হলো সে কিছুদিন পর পর নিজের জেনেটিক মেক আপ বদলে ফেলে । ফলে, ভ্যাক্সিন নিয়ে কোন লাভ নেই। পরিবর্তন হয়ে গেলে নতুন ভাইরাস , ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন কাজ করবে না , কেবল পেট মোটা ওষুধ কোম্পানির পেট মোটা করবে। এখন দরকার , মহামারীর বিরুদ্ধে যেই সব ওষুধ এখনো কাজ করতে পারে, তার পেটেন্ট খুলে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
কনজিউমার, সিটিজেন, ভোটার এবং মানুষ হিসেবে আমাদের পক্ষে এভাবেই আগানো সম্ভব। প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে পণ্য বর্জন এবং পণ্য চিহ্নিত করতে নির্দিষ্ট মার্কা ব্যবহারে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা। নিজের দেশ বাংলাদেশে কয়েকটা ফার্ম সময় করে দেখে আসা । চাপের মুখে বাধ্য না করলে পরিবর্তন হবে না।
পাশাপাশি দুটো উদাহরন দিয়ে আজকের মত শেষ করি ।
পাশবিক লোভ আর লালসা কোন পর্যায়ে তার একটা উদাহরন হলো ফোয়া গ্রা । এটি একটি খাবার হিসেবে বিক্রি হলেও সোজা কথায় এটি "ইচ্ছা করে সৃষ্টি করা হাঁস ও রাজহাঁসের রোগাক্রান্ত কলিজা বা ফ্যাটি লিভার"। এই তথাকথিত খাদ্যটি প্রস্তুত করার জন্য জন্মের পর থেকেই হাঁসদের নড়তে চড়তে না দিয়ে প্রতিদিন অস্বাভাবিক মাত্রায় খাবার জোর করে গেলানো হয়। ফলে ধীরে ধীরে তারা অতিরিক্ত মেদ গ্রহনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে । লিভার আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে ফ্যাটি লিভারে পরিনত হয় ( এই রোগ মানুষের ও হয়।
বহু বছর অতিরিক্ত মেদ জমতে থাকলে ফ্যাটি লিভার পরে লিভার ক্যান্সারে পরিনত হয়) এই ফ্যাটি লিভার আহোরনের জন্য হাজারে হাজারে হাঁসকে দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার করে অসুস্থ করা হয় , তারপর মেরে ফেলে কলিজাটা বিক্রি করা হয় সুদৃশ্য প্যাকেজে ।
পেটার ওয়েবসাইটে ফোয়া গ্রা
এই হলো মানুষের লোভ । এই হলো মানুষের জিহবার লালসা । এই হলো মাংসের ব্যবসা । মাংসের কারবার ।
এই কারনেই গ্লাটনি ইজ সিন। শুধুমাত্র মানুষের মাংসের লোভকে মিটাতে এও এক রকম পাশবিক বেশ্যাবৃত্তি । আমরা তার খদ্দের । অচেতন, অন্ধ , জ্ঞানপাপী খদ্দের।
ছোটবেলায় আমার নানীকে দেখতাম ছাগল পুষতো ।
শীতকালে গায়ে দেওয়ার জন্য আমি যেই শোয়েটার পরতাম , তার জন্যও একই উলে বোনা আবরন ছিলো । আমার নিজের একটা মুরগী ছিলো । সারাদিন স্বাধীন ঘুরে বেড়াতো। সন্ধ্যে হলে আমি ওকে কোলে নিয়ে টিভি দেখাতাম। কতদিন কত যত্ন করে আদর করে নানীর গরু, ছাগল , হাঁস মুরগীকে খাবার দিয়েছি।
যেদিন স্কুল থেকে ফিরে জানলাম আমার সাধের মুরগী বাস চাপা পড়ে মরে গেছে , আকাশ বিদীর্ণ করা কান্না আমার কেউ থামাতে পারেনি। আমার সাথী মুরগী আর আমার নানী মারা যাওয়ার কষ্টে আমি সত্যি কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না , দুইজনেই আমার ভালোবাসার , দুইজনেই পরিবার । লিখতে লিখতে ঐ বোবা প্রানীটার জন্য আজকেও চোখ ভরে এলো কান্নার জলে ।
এই বাংলাদেশকে , এই বাঙ্গালী ভালোবাসাকে, এই সহজাত স্নেহ, দয়া , কোমলতাকে আমি চিনি । কেবল কথা কইতে পারে না বলে কোন অবলা জীবের প্রতি নৃশংস আচরনকে আমি চিনি না ।
আমি ঐ পশ্চিমা মাংসের ব্যবসায়ীর বিকৃত মানসিকতাকে চিনি না ।
মাংসের প্রতি মানুষের এই অন্ধ লোভের কাছে মুরগীও যা, মা-ও তাই ।
তথ্যসূত্রঃ
মেডিকেল জার্নাল ও ওয়েব সাইট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
সামহোয়ার ইন ব্লগারদের ব্লগ
ইউ টিউব
পেটার ওয়েব সাইট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।