আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসুন, অহেতুক ম্যা-ম্যা না করে মে' দিবস পালন করি নিজের ঘরে!

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।

জাতি হিসেবে আমরা বেশ দিবস প্রিয়। এই দিবস, সেই দিবস পালনে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। মজার ব্যাপার হলো, আসল উদ্দেশ্য দিবস পালনে নয়। এসব দিবস আমাদের গলাবাজি করার এক একটি উপলক্ষ্য তৈরী করে।

এরকম এক একটা দিবস আসে। আমাদের সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা সভা-সেমিনার করেন; পরদিনের পত্র-পত্রিকায় কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা-বিবৃতি প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে টিভিওয়ালা-পত্রিকাওয়ালাদের তো পোয়াবারো। দিবসের চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান (নতুন ট্রেন্ড "টক শো") করা যায়; ক্রোড়পত্র বের করা যায়।

দর্শক-শ্রোতা (প্রচলিত অর্থে কাটতি) বাড়ে। অন্যদিকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলোর সিএসআর (Corporate Social Responsibility) মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গদগদ মার্কা বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে ভরে ওঠে টিভির পর্দা কিংবা পত্রিকার পাতা। এবার, আজকের পালিত দিবসটির সাথে উপরের কথাগুলোকে মিলিয়ে নিন। কোন পার্থক্য পাচ্ছেন? পাবেন না! সবই সূত্র মোতাবেক চলে! সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে ফেনা তুলে ফেলা, পত্রিকার পাতায় বড় বড় ছবি আর বিজ্ঞাপণে ভরপুর করে তোলা- সবই হয়েছে আজ।

নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখতে গেলে এর বাইরে যাবার কোন উপায়ই নেই। হ্যাঁ,আজ ছিল মে' দিবস। মিডিয়ার কল্যানে এ দিবসের ইতিহাসের নাড়ি-নক্ষত্র সবার জানা হয়ে গেলে ও একটু সংক্ষেপে আলোকপাত করি। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বন্ধুর পথে এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৮৮৬ সালের এইদিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে যে রক্তক্ষয়ী ধর্মঘট পালিত হয়, তার স্মরণেই এই দিবস পালন।

আমরা সবাই সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় যেভাবেই হোক- এই দিবসের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করি-মালিকপক্ষকে একেবারে তুলোধুনো করে ছাড়ি। যাঁরা লিখতে জানেন তারা তো ব্লগের বারান্দা ভাসিয়েই দিয়েছেন পোষ্ট আর মন্তব্যে। রেগে উঠে, বলতে পারেন, এতে আমার আপত্তি কোথায়, বাপু? তাহলে বলি। এ দিনটাতে সব চেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমরা কেউই কিন্তু নিজেদের দিকে একটিবারের জন্য ও ফিরে তাকাই নি। আপন আয়নাতে মুখটাকে একবারের জন্য ও তুলে ধরি নি।

আমার আপত্তিটা সেখানেই। ২০০৬ সালে প্রবর্তিত আমাদের দেশের শ্রম আইনে বলা হয়েছে, "শ্রমিক" অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি তাহার চাকুরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠান বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, প্রধানতঃ প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভূক্ত হইবেন না। এবার, বলুন তো আমার-আপনার পরিচিত কে কে এই সংজ্ঞার ভেতরে পড়ে? কল-কারখানায় যারা মাসিক মজুরিতে কাজ করে ওদের জন্য তা ও কিছু সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু, আমার বাসার কাজের বুয়াটা। ওকে কি ছুটি দিয়েছি আমি? দিলে রান্না করবে কে? না খেয়ে মারা যাবো নাকি! বাড়ির ড্রাইভার-ও কি আজ ছুটি পেয়েছে? অন্যদিন পেলেও আজ তো পাবেই না! মে' দিবসের সকালে পাবলিক গাড়ি চলবে না, অতএব, নিজের গাড়ি ছাড়া বেরুবো কী করে? ড্রাইভার ছাড়া কি চলা যায়? আর বাড়ির দারোয়ানটা! ওকে ছুটি দেবার তো প্রশ্নই আসে না! বন্ধের দিন।

কতলোক আসবে-যাবে। বিকেলে হয়তো পুরো পরিবার বাইরে কোথাও ঘুরতে বেরুবো। ও না থাকলে বাড়ি পাহারা দেবে কে? কথাগুলো কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। ওদেরকে ছাড়া চলা যায় না। তাহলে উপায়? তাও আছে।

ঐ শ্রম আইনেই বলা আছে, [ধারা ১০৮(১)] " যে ক্ষেত্রে কোন শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানে কোন দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি অধিক কাল কাজের জন্য তাহার মূল মজুরি ও মহার্ঘ্যভাতা এবং এডহক বা অন্তবর্র্তি মজুরি দ্বিগুণ হারে পাইবেন। " আমরা কি আসলেই তা করি? তার পরেও ছোট্ট একটা সুযোগ আছে ওদের জন্য। ধারা ১০৪-এ ক্ষতিপূরণমূলক সাপ্তাহিক ছুটির কথা বলা হয়েছে যাতে বঞ্চিত ছুটির দিনগুলোর পরিবর্তে অন্য কোনদিন তাকে সমান সংখ্যক দিন ছুটি দেয়া যায়। নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখি, এর কতটুকু পালন করি। অতএব, নিজের দিকে তাকিয়ে আমাদের আজ আসলে আত্মসমালোচনা করা উচিৎ।

আমরা নিজেরাই কত শ্রমিকের অধিকার হরণ করে চলেছি নিত্যদিন! সবশেষে, একটা কথা না বললেই নয়। আর তা হলো আমাদের চলমান শ্রমিক আন্দোলন গুলোর অবস্থা। সব সময়ই দেখি এতে মালিক আর শ্রমিককে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলে। এটি কেমন কথা! মালিক-শ্রমিক দু'পক্ষই এদেশের উন্নয়নের সমান অংশীদার। "তুমি আমার অধিকার মেরে খাচ্ছ আর তুমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছ"- এ রকম মানসিকতা বিদ্যমান থাকলে কার অধিকার কতটুকু আদায় হবে তা জানিনা, তবে সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা (Maximum Efficiency) যে, কখনোই আদায় হবে না তা নিশ্চিত।

সুযোগ পেলে কিন্তু শ্রমিক নেতারা মালিকের সাথে আঁতাত করে টু-পাইস কামিয়ে নিতে একটুও কসুর করেন না। এক্ষেত্রে আমি মহানবীর (স) দু'টি বাণী আপনাদের স্মরণে দিতে চাই। মালিক পক্ষকে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছেন, (১) "এরা (শ্রমিকরা) তোমাদের ভাই, আল্লাহ এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহতায়ালা যে ব্যক্তির ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, তার উচিত সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তা পরাবে, আর যে কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়, সে কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেবে না। আর যদি কষ্ট দেয় তাতে নিজেও তাকে সাহায্য করবে।

" (২) "শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও। " আবার, শ্রমিককেও তিনি বলে দিচ্ছেন, "সেই উত্তম আমানতদার যে মালিকের সম্পদকে হেফাজত করে। " বলুন, মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে এর চেয়ে উত্তম রূপে কিভাবে আর অধিকার আদায়ের কথা বলা যায়? সমস্যা হলো, আমরা ভালো কিছুই মানতে চাইনা। শুধু খারাপ কিছু দেখতে পেলেই লাফ দিয়ে উঠি। ধন্যবাদ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।