গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। এই বিভৎস গরমে বৃষ্টি কতটা প্রশান্তি হয়ে উঠতে পারে তা নিশ্চই সবাই বুঝে গেছে।
তাছাড়া আমার মনটাও বেশ কদিন ধরে ভালো যাচ্ছিল না। বৃষ্টি আমাকে যেনো আরও বিষন্ন করে দিচ্ছিল। আর একটি দুঃসংবাদ আমাকে আরও বিমর্ষ করে তুলছিল।
ঠিক সেসময় আবার বৃষ্টির সাথে গাছের-মাটির মধুর গন্ধ আমাকে আবেগে ভরিয়ে দিচ্ছিল।
বারান্দায় বসে কালি ও কলম পত্রিকা উল্টাচ্ছিলাম একটি বৃষ্টি ঘটিত কবিতার জন্য। যা মনটাকে শান্ত করে দিতে পারবে। তেমন কবিতা চোখেই পড়ছিল না।
হঠাৎ চোখে পড়লো রেজাউদ্দিন স্টালিন নামে এক কবির কবিতা।
নাম হচ্ছে, "স্বপ্নমৃত্যু সম্পর্কজনিত"।
আকাশ খুব নীল থাকলে গান শুনতে ভালো লাগে
নীলাকাশের সাথে গানের কি সম্পর্ক
কড়া চায়ের মতো রোদ উঠলে
অসহায় পথের কথা পড়ে
রোদের সাথে পথের কি সম্পর্ক
লাইনগুলো সত্যিই মনটাকে আনচান করে তুলে। মনটাকে আরও মুচড়ে তোলে। আকাশের নীলের গভীরত্ব সত্যিই গান গাইয়ে তোলে মনের ভেতরে। কিন্তু আকাশের সাথে গানের সম্পর্ক কি হতে পারে! কেনো আকাশ দেখলেই গান গেতে কিংবা শুনতে ইচ্ছে হয়?
এরপর কবি লিখেছেন,
প্রিয় কোনো ফুলের গন্ধ নাকে এলে
শৈশবের সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে
ফুলের সাথে সন্ধ্যার কী সম্পর্ক
ঘন মেঘ করে বৃষ্টি এলে
মৃত্যুর কথা মনে হয়
মেঘের সাথে মৃত্যুর কী সম্পর্ক
তাহলে গান কি আকাশের মতো নীল
পথ কি রোদের মতো প্রচন্ড
ফুল কি সন্ধ্যার বিষন্ন
মেঘ কি মৃত্যুর বার্তাবাহী
জীবন কি অনুভূতির আকর, অনিবার্য কোনো উপাত্ত
অনুভব স্বপ্নের অধিক নাকি আকাঙ্খার
মানুষ কি স্বপ্নে বাঁচে, নাকি সংগ্রামে
জীবিতজনের মনে মাঝে মাঝে মৃত্যু উঁকি দেয়
মৃত্যু কি স্বপ্নের প্রতিদ্বন্দ্বী নাকি জীবনের
স্বপ্নের মৃত্যু হলে মানুষ কিসে বাঁচে।
চমৎকার সব লাইন। তবে মনের প্রশান্তির চেয়ে মনে বিষন্নতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মনের মাঝে জোড়ো করে হাজারো প্রশ্ন। তবে আমি তো প্রশ্নের থেকে মুক্তি চাই। আমি সকল কিছুর উর্ধ্বে থেকে বের হয়ে চলে যেতে চাই অজানায়।
রাত ২ টায় দম বন্ধ লাগছিল। বাতাস তখন একদম ঠান্ডা। বের হয়ে গেলাম রাতের ঢাকার রাস্তায়। পিচ ঢালা রাস্তাগুলোর পিপাসা দেখলেই বোঝা যায়। কারণ, রাস্তা দেখলে বোঝার উপায় ছিল না যে এখানে কয়েক ঘন্টা আগে বৃষ্টি নেমেছে।
নীরব অন্ধকার রাস্তার ফুটপাতে শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন কিছু মানুষ। হঠাৎ হঠাৎ সাঁই সাঁই করে গাড়ী যাচ্ছে। রাতের ঢাকা এভাবে কখনও দেখা হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করছিলাম বিষন্নতাকে। রাতের ঢাকা যেমনই নিরব দিনের ঢাকা ঠিক ততটাই উন্মাদ।
রাতের ঢাকা ঠিক যেনো রহস্যময় নারীর মতো। আর দিনের ঢাকায় কোনো রহস্য নেই। একদম বেশ্যা।
মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠে বসেছিলাম। একটি সিগারেট ফুকতে ফুকতে কেনো যেনো কান্নায় ভেঙে পড়ছিল সব কিছু।
তার হঠাৎ কোথা থেকে একটি হিমেল বাতাস বয়ে গেলো। সিগারেটটা তখন শেষ। আরেকটি ধরালাম। মনটা খুব হালকা লাগছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব পাহাড় যেনো এই হিমেল হাওয়ার ধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
তখন....ঠিক তখন আমার পছন্দের লাইনগুলো আবৃত্তি করে চললাম।
এই মনোরম মনোটনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ী বুঝি ছাড়ি যায়। ' আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদ বর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরী এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতকাল, কোনদিন নয়।
বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাত্রে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টি ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।
[আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের- নিরুদ্দেশ যাত্রা]
মনে মনে ভাবলাম। এর চেয়ে প্রশান্তিময় কবিতা হতে পারে না। যদিও লাইনগুলো গল্পের। কিন্তু গল্পের লাইনগুলোকে ইলিয়াস দিয়েছেন কবিতার মর্যাদা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।