আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাদ্য নিরাপত্তায় হাইব্রিড বীজ -শেষ হল বীজ সম্মেলন ও মেলা ২০০৯

কেউ কেউ একা

গত ২৮ এপ্রিল থেকে আজ ৩০ এপ্রিল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশ বীজ সন্মেলন ও মেলা ২০০৯। বীজ উইং, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সীড গ্রোয়ার, ডিলার এন্ড মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত এবারের মেলার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- 'খাদ্য নিরাপত্তায় হাইব্রিড বীজ'। কৃষি মন্ত্রণালয়ের 'ভাল বীজে ভাল ফসল' এই শ্লোগান বরাবরের মত এবারও ছিল। পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। বাড়ছে বিশাল এ জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা।

সে তুলনায় পিছিয়ে আছে খাদ্য উৎপাদন। আমরা পিছিয়ে রয়েছি খাদ্য উৎপাদনের সাথে তাল মিলিয়ে জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে। তাই বারবার সম্মুখীন হচ্ছি খাদ্য সংকটের। লোকসংখ্যার তুলনায় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে হয়েছে খাদ্য রায়ট। বেশিদিন আগের কথা নয়- সংবাদ সংস্থা এএফপি এপ্রিল, ২০০৮ -এর প্রথম সপ্তাহে জানিয়েছে বিশ্বে ৩২টিরও বেশি দেশে তীব্র খাদ্য সংকট চলছে, যার ফলে বিরাজ করছে গণ-অসন্তোষ।

খবরটি গারডিয়ান-এও প্রকাশিত হয়েছিল। হাইতিতে গত বছর খাদ্যের জন্য দাঙ্গা হয়ে মারা গেছে ১০ জন। মিশরসহ কয়েকটি দেশের সরকারি খাদ্য গুদামে হয়েছে লুটপাট। বিশ্বের ৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কৃষি বিজ্ঞানীদের চেষ্টার কমতি নেই।

সেরা জাতের বীজ উদ্ভাবন, রোগবালাই প্রতিরোধ, খরা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ সহনশীল ও উচ্চ ফলনশীল ফসল আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে নিরন্তর। বিশ্ব বিবেককে ভাবিয়ে তুলেছে আজকের জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা। প্রতিদিন দেশে প্রায় ৩২০ হেক্টর কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অ-কৃষি কর্মকাণ্ডে। যাতে করে ১৫ লক্ষ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হারাচ্ছে। দুতিন ফসলি জমিতে মাটি ভরাট করে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি ও শিল্পকারখানা।

বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ফলে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রশংসার দাবিদার হলেও ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১কোটি লোক দিনে তিনবেলা খেতে পারে না। তারা নীরব দুর্ভিক্ষের শিকার। খাদ্যসংকট ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিন ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২কোটি ১৭লাখ হেক্টর।

যা ১৯৮৬ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এবং ২০০৩ সালে কমে দাঁড়ায় ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ সালে ১৩কোটি এবং বর্তমানে ১৫কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, গত ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে ২কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ২কোটি ৪০ লাখই নিরঙ্কুশ দরিদ্র।

বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১১ কোটিই গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশে চালের উৎপাদন হার চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় যথাক্রমে ৪৫%, ২০% ও ২৫% কম। বাংলাদেশের মোট জমির পরিমাণ ১৪৮.৪০ লক্ষ হেক্টর যার মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ৮২.৯০ লক্ষ হেক্টর, পতিত জমি ৭.৩০ লক্ষ হেক্টর এবং বনের পরিমাণ ২৫.৯৭ লক্ষ হেক্টর। উল্লেখ্য, দেশের ৮০.৩১ লক্ষ হেক্টর নীট ফসলি জমির মধ্যে এক ফসলি, দুফসলি এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫.৮০%, ৫১.৪৫% এবং ১২.৭৫%। এক ফসলি জমিকে দু’তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব যা দেশের মোট ২৪৫.২০ লক্ষ মে. টন খাদ্য শস্যের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

(তথ্যসূত্র : বিবিএস ২০০৭) বাংলাদেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে দারিদ্র নিরসন কৌশলপত্র সর্বত্রই খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। চার ধরনের ফসল যেমন- ধান, ডাল, ভোজ্য তেল এবং মশলা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সংস্থা রাজস্ব বাজেট যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা ২০১১ সালের ভেতর বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। তাতে উৎপাদন ৮.৫% থেকে ২৫% এ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে সেচ ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিরও সুযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সেচ ব্যবস্থার কার্যকারিতার দিকে বাংলাদেশ রয়েছে পেছনের কাতারে।

এটি ভারতে ৪৯%, পাকিস্তানে ৪৯%, নেপালে ৫৮%, মায়ানমারে ৩৯% এবং বাংলাদেশে ৩০%। বর্তমানে বাংলাদেশে তা ৪০%। খাদ্য নিরাপত্তার চিত্র যখন এই তখন আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভাল বীজ। ভাল বীজে ভাল ফলন হয়। বীজই হচ্ছে কৃষির মূল উপকরণ।

ভাল বীজ ব্যবহার করলে কৃষক শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ ফলন বেশি পায়, পাশাপাশি কৃষক যদি হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে তাহলে ফলন আরও ২০ ভাগ বেড়ে যায়। হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে দেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিরাপত্তার টেকসই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে। বিশ্বে হাইব্রিড একটি প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদশের কৃষকদের ষাট দশকের দিকে সবজি হাইব্রিড বীজের সাথে পরিচয় ঘটে। নব্বইতে এসে ভুট্টা এবং নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে ধানের হাইব্রিড বীজের ব্যবহার শুরু হয়।

ফলন বেশি পাওয়ায় হাইব্রিড বীজ ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের মোট জমির ৭৫ভাগ ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে কম জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করে খাদ্য নিশ্চয়তা আনা একমাত্র হাইব্রিডেই সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশে হাইব্রিড ধান, ভুট্টা, সবজি চাষ হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে নানাবিধ হাইব্রিড ফসল আমাদের আবাদি জমি দখল করে নেবে।

হাইব্রিডের প্রচার, প্রসারের জন্য মেলায় অংশ নেয় ৩০০ এর মত স্টল। আমাদের আগামী বাড়তি জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করতে আধুনিক কৃষি উপকরণ ব্যবহারের পাশাপাশি অবশ্যই হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করতে হবে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানান, ভাল বীজ ভাল ফসল। শুধু মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করে শতকরা ৮-১০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। অত্যাধিক জনসংখ্যার ছোট্ট এ দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

আর এ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভাল বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি বিজ্ঞানীরা ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করবেন আর কৃষকরা যাতে তা সহজে এবং সুলভে ব্যবহার করতে পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তবে হাইব্রিড বীজ উৎপাদে বিদেশি কোম্পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা আমাদের জন্য সুখকর নয়। এ কার্যক্রমে বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য আমি দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। একই সাথে সহজে এবং সুলভে মানসন্মত বীজ প্রাপ্তিতে কৃষকরা যাতে কোনভাবেই যাতে হয়রানি কিংবা প্রতারণার শিকার না হন সেদিকে সংশ্লিষ্টরা তীক্ষ দৃষ্টি রাখবেন বলে আশা করি।

এক কৃষকের সাথে আলাপকালে তিনি বলে, এ ধরনের মেলা জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হলে কৃষকরা আরও উপকৃত হবে। তাদের জানার পরিধি আরও বেড়ে যাবে। কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই- হাইব্রিড বীজ নিয়ে তর্ক-বির্তক থাকবেই। তবে আমাদের দেখতে হবে হাইব্রিড বীজ আমাদের কল্যাণ বয়ে আনছে কিনা। যদি মানব জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে তাহলে আমরা অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা গ্রহণ করব।

খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কৃষি কিংবা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই যখন মূল প্রস্তাবনা, তখন বছরে ৮০ হাজার হেক্টর জমি অর্থাৎ ১% হারে আবাদি জমি হারানোর পরিণতি কি হতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়। তাই স্বল্প আবাদি জমিতে অধিক ফসল ফলানোর জন্য আমাদের হাইব্রিড বীজ এখন সময়ের দাবি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.