আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুরআনের ভাষাশৈলী



আল-কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন একজন ব্যক্তির উপর নাযিল হয়েছে যার কোন অক্ষরজ্ঞান ছিল না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করেই এমনটি এই জন্য করেছেন যাতে প্রমাণিত হয় যে, এ গ্রন্থটি এমন চমকপ্রদ আলংকারিক ভাষা ও শৈলী বহন করে যা কোন নিরক্ষর লোকের ব্যক্তিগত ভাষা হতে পারে না। যে সময় কুরআন নাযিল হয়, সে সময় আরবে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের অভাব ছিল না। কিন্তু তারপরও আল্লাহ যখন কুরআনের অনুরূপ কুরআন সৃষ্টির জন্য চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করলেন; তখন এসব কবি-সাহিত্যিক অপারগতা প্রকাশ করে বলল; ‘লাইসা হাযা মিন কালামিল বাশার’ (এটা কোন মানব রচিত বাণী নয়)-এর ভাষা, রচনাশৈলী ও বিন্যাস পদ্ধতি উঁচু মানের। এ গন্থে উঁচু স্তরের শিল্পকলা বিদ্যমান, যা কুরআনের বিশেষ কোন অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা কুরআনে তা সমভাবে বিস্তৃত।

কুরআনের সাহিত্যশৈলী মানবরচিত সাহিত্যশৈলীর আওতায় পড়ে না। মানবরচিত সাহিত্যশৈলীতে যেমন গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও পৌরাণিক কাহিনী লক্ষ্য করা যায় কিন্তু কুরআন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মি· বেল-এর মতেঃ ‘কুরআনে মুহাম্মদ (স) কে একজন কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না বরং তাঁর কাজ ছিল আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ জন্যেই কুরআনের ভাষা যতটা না শিল্প-সৌন্দর্যমন্ডিত, তার চেয়ে বেশি উপদেশমূলক। ’ যুগে যুগে আরব সাহিত্যিক ও ভাষাবিদগণ কুরআনের ভাষা ও সাহিত্যশৈলী সম্পর্কে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছেন।

তাঁদের মতে, কুরআনের ভাষা ও সাহিত্যশৈলীর কোন তুলনা নেই। এটি শাশ্বত ও চিরন্তন মুজিযা, যার চ্যালেঞ্জ সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। রাসূল (স)-এর প্রতি আল্লাহর সম্ভাষণে আরেক ধরনের ভাষাশৈলী পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহর বাণীঃ ‘ইয়া আইয়্যুহাল মুযযাম্মিল’ (হে চাদরাবৃত রাসুল!) (আলকুরআন, ৭৩:১) ‘ইয়া আইয়্যুহাল মুদ্দাস্‌সির’ (হে বস্ত্রাবৃত রাসুল!) (আলকুরআন, ৭৪:১) এ আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসুলকে যথাক্রমে ওহে চাদরাবৃত ও ওহে বস্ত্রাবৃত হিসেবে সম্ভাষণ করেছেন। সাধারণ কবি-সাহিত্যিকগণ নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপরই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন।

খুব কম কবি-সাহিত্যিকই আছেন যারা এই সীমা অতিক্রম করতে পারেন। যদি কেউ চেষ্টাও করে থাকেন, তবে তা তাঁর নিজস্ব বিষয়ের তুলনায় ততটা মানসম্পন্ন হয় না । অন্যদিকে কুরআনের সাহিত্যিক মান এ সীমাবদ্ধতার সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। বিভিন্নমূখী এমনকি পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয়ের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ আলকুরআন, যেখানে প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনাশৈলী সাহিত্যের মান বিচারে সমমানের। কুরআনের উন্নত ভাষা ও সাহিত্যশৈলীর উৎকর্ষ তথা সাহিত্যে সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কুরআন অবতীর্ণের সমসাময়িক সময়ে আরবের কাফির মুশরিকগণ কখনও কুরআনকে কাব্য, আবার কখনো যাদু বলে আখ্যায়িত করতো।

শৈল্পিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়েও কাফির মুশরিকদের অনেকেই হেদায়েত গ্রহণ করেনি। আবার অনেকে দ্বিধাহীন চিত্তে দাখিল হয়েছেন পবিত্র ইসলামে। হযরত ওমর (রা) নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, ‘যখন আমি কুরআন শ্রবণ করলাম তখন আমার মধ্যে এক ভাবন্তর সৃস্টি হলো, যার কারণে আমি কাঁদতে লাগলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম’। ওয়ালিদ বিল মুগীরা বলেছেনঃ ‘কুরআনের মধ্যে যাদুকরী প্রভাব বিদ্যমান, তোমরা কি লক্ষ্য করনি কিভাবে কুরআন একজন মানুষকে তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে পৃথক করে দেয়? মুমিনগণ কুরআন পাঠ করার পর যে প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কুরআনেই বলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘কুরআন পাঠে তাদের লোম কাটা দিয়ে ওঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের শরীর ও মন আল্লাহর যিকিরে একাকার হয়ে যায়’।

কুরআন সম্পর্কে তাদের এ ধরনের মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে আজও একটি প্রশ্ন জাগে যে, কুরআনে ভাষা ও সাহিত্যশৈলী কেন এতো মনোহর? এট কি আল-কুরআনের অনুপম সাহিত্যশৈলীর কারণে না অন্য কিছু? গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনের প্রতি এই আকর্ষণ কেবল মহান আল্লাহ তাআলার ভাষা ও সাহিত্যশৈলীর উৎকর্ষের কারণেই। আল কুরআনের বাচন-ভঙ্গি, শব্দচয়ন সর্বোপরি বক্তব্য প্রকাশের স্বচ্ছতা ও চমৎকারিত্ব সম্পর্কে মনীষী মেল বলেন, ‘এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, কুরআনের ভাষা, স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্যের দিক দিয়ে চূড়ান্ত সোপানে উন্নীত। মুহাম্মদ (স) কুরআনের অলৌকিকত্ব দিয়ে নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করতে পেরেছেন। বড় বড় ব্যক্তি ও পণ্ডিতদের তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। হাজার হাজার মানুষ সে যুগে কুরআনের ভাষা ও শৈলীর বিপরীতে চমকপ্রদ কিছু সৃষ্টি করে বিজয়ী হতে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিল।

কিন্তু কুরআন তাদেরকে মাত্র একটি আয়াত বা সুরা রচনা করতে চ্যালেঞ্জ করেছিল। জবাবে তারা নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ও নীরব ছিল। অন্যদিকে আলী ইবন রব্বান আততাবারীর ভাষায় ‘আল-কুরআনের ক্রটিবিহীন রচনাশৈলী ও সাহিত্যরীতি জগতের কোন ভাষায় বা গ্রন্থে মিলবে না’। আল-কুরআনের রচনাশৈলী ও সাহিত্যরীতি সম্পর্কে ইবনে জারীর আততাবারীর অভিমত হচ্ছেঃ ‘আল-কুরআনের চিরন্তন বাণী একটি অবিনশ্বর মুজিযা, যা চিরদিন অক্ষুণ্ন থাকবে। মানুষের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার দ্বারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।

কুরআনের রচনাশৈলী ও ভাষার লালিত্য এতই অসাধারণ যে, যা অন্যসব আসমানী কিতাবের গুণাবলিকে ম্স্নান করে দেয়। তদানীন্তন আরবের কত খ্যাতনামা কবি, আর যুগ যুগান্তরের কত সাহিত্যরথী ও বাগ্মীদেরকে হতবাক করে দিয়েছে। কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের সকল ধারণা ও প্রচেষ্টা একান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কুরআনের ভাষা ও সাহিত্যশৈলী সম্পর্কে জন নেইশ কি বলেন, সেটাও আমরা জেনে নিতে পারি। উইজডম অফ কুরআন গ্রন্থে তিনি লিখেন, ''The Quran is its Original Arabic dress has a seductive beauty and charm of its own couched in concise and exalted style. Its brief pregnant, sentences, often rhymed possess and expressive force and explosive energy which it is extremely difficult to convey by literal word for word translation." John Naish M.A. (oxon) D.D. The wisdom of the Quran, Oxford 1937 ফ্রান্সের ভাষাবিদ এডওয়ার্ড মোনটেট মনে করেন কুরআনের ভাষা ও সাহিত্যশৈলী অনিন্দ্য সুন্দর ও অতুলনীয়।

মানবীয় কোন সাহিত্য কর্মের সাথে এর তুলনা হয় না। তিনি বলেনঃ "All those who are acquainted with the Quran in Arabic agree in praising the beauty of this religious book; its grandeur of form is so sublime that no translation into any European Language can allow us to appreciate it". (Edward Montet, Traduction francaise du Coran, Pari 1929, Introduction, P-53) অতএববলা যায়, আল-কুরআনেরঅনিন্দ্য সুন্দর ভাষা ও সাহিত্যশৈলীর উৎকর্ষের কারণেই আল-কুরআন প্রাণবন্ত এবং আগাগোড়া চিত্তস্পর্শী। তাই কুরআন পাঠকালে পাঠকের হৃদয় ভরে যায় স্বর্গীয় আনন্দে। নিঃসন্দেহে আল-কুরআন ভাষাশৈলীর উৎকৃষ্টতম নিদর্শন। আর, এই মহাগ্রন্থে বিধৃত প্রতিটি শব্দ ও বাণীর আবেদন মানবজীবনে চিরকালীন এবং সর্বব্যাপী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।