গত শুক্রবার আমার ছোট খালু তার পুরো পরিবারসহ এসেছিলেন প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে যোগ দিতে। পুরো পরিবার বলতে ওনার মা, আমার খালা, তাদের ৭বছর বয়সী মেয়ে শ্রেয়া এবং ৪বছরের ছেলে শ্রেষ্ঠ। পিচ্চি দুইটার গালে লেখা ছিল “ফাঁসী চাই” আর হাতে ছোট্ট একটা প্ল্যাকার্ডে রাজাকারের ছবি। তো সেদিন শ্রেয়ার সাথে ঘুরার দায়িত্ব ছিল আমার কারণ একেবারে ছোটবেলা থেকেই শ্রেয়ার সবচেয়ে প্রিয় ভাইয়া আমি। আর কয়েক মাস পরপর ঢাকা আসা হয় বলে সে আমার সঙ্গ একেবারেই ছাড়তে চায় না।
যেহেতু ওইদিন বেশ খানিকটা সময় তার সাথে ছিলাম, তাই একটা ছোট বাচ্চার চোখে এই সমাবেশ কিংবা আন্দোলন কিভাবে ধরা পড়েছে তা দেখার অভিজ্ঞতাটা ভালই হয়েছে। যতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি, তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
প্রথমদিকে এত মানুষ দেখে শ্রেয়া-শ্রেষ্ঠ দুইজনেরই মনেহয় ধারণা ছিল তারা পহেলা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবসের মত কোন উৎসব উদযাপনে এসেছে। কিন্তু শাহবাগ ফুট ওভারব্রিজের নিচে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো মাত্র যখন চারপাশ থেকে লোকজন তাদের ঘিরে ধরলো, এমনকি ২৫-২৬বছরের একটা ছেলে শ্রেষ্ঠকে অনেকক্ষণ বুকে চেপে ধরে পরে তার পা ধরে সালাম করে বললো “তোমাদেরকে আমাদের পাশে দেখলেই আমাদের সব ক্লান্তি চলে যায়, রক্ত আবার গরম হয়ে যায়। তোমাদের পা ধরে ১০০বার সালাম করলেও কম হয়ে যায় ভাইয়া” তখন কথাগুলোর অর্থ না বুঝলেও দুইজনই আন্দাজ করে নিল এখানে সিরিয়াস কিছু একটা হচ্ছে।
শ্রেয়াদেরকে চারুকলার সামনে নিয়ে গেলাম। চারুকলার দেয়ালে রাজাকারের ক্যারিকেচার দেখে শ্রেয়ার মাথায় প্রথম প্রশ্নটা আসলো দেয়ালের ‘কার্টুন’টার সাথে তার হাতের কার্টুনটা মিলে গেল কিভাবে?
-এগুলো কে ভাইয়া?
-এগুলো সব রাজাকার।
-রাজাকার কি?
-যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় চেয়েছে আমরা যেন বাংলাদেশ না হতে পারি। যারা চেয়েছে আমরা পাকিস্তান থেকে যাই।
-রাজাকাররা কি পাকিস্তানী?
-না রে গুল্লু, রাজাকাররা বাংলাদেশের।
-ওরা বাংলাদেশে থেকেও বাংলাদেশ চায়নি?!?! (চূড়ান্ত কনফিউজড প্রশ্ন)
-না, ওরা বাংলাদেশে থেকেও বাংলাদেশ চায়নি। ওরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মেরে ফেলত, ছোট-ছোট বাবুদেরকে মেরে ফেলত, মানুষের বাসায় ঢুকে ওদের মেরে ফেলে সব জিনিসপত্র নিয়ে যেত।
-ওরা তাহলে খুব খারাপ, ওদেরকে জেলে আটকে রাখা উচিৎ।
-ওদের জেলে আটকে রেখে কি হবে? ওরা তো জেলে বসে আরাম করে ভাত খাবে, টিভি দেখবে। কোন কষ্টই হবে না, তারচেয়ে ওদের ফাঁসী দেওয়া উচিৎ।
-ফাঁসী কি ভাইয়া?
তখন আমি ওকে ঘুরেফিরে একটা প্রতীকী ফাঁসীমঞ্চের সামনে নিয়ে বুঝালাম ফাঁসী কি। চারুকলার দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পেপার-কাটিং, ছবি দেখিয়ে বুঝালাম রাজাকাররা কিভাবে মানুষ মেরেছে আর এজন্যই তাদের ফাঁসী হওয়া উচিৎ।
এরপর তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার ওভারব্রিজের নিচে নিয়ে আসলাম সেখানে ভিড় একটু কম ছিল দেখে। আমাদের সামনেই একজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিফর্ম পড়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা হাতে। শ্রেয়া অনেকক্ষণ পতাকাটা দেখে জানতে চাইলো এটা কিসের পতাকা, এই পতাকা কোথায় কিনতে পাওয়া যায়।
আমি উত্তর না দিয়ে ওকে সেই প্রৌড় মুক্তিযোদ্ধা কাছে নিয়ে গেলাম। তিনিই তাকে বুঝিয়ে দিলেন এটা কার পতাকা, মুক্তিযোদ্ধা কারা। এরপর শ্রেয়া আমাকে যে কথাটা বললো তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।
“আমি কি ওনাকে (মুক্তিযোদ্ধা) সালাম করবো না স্যালুট দিব?”
ওর এই কথায় ওইদিন প্রথমবারের মত বড় একটা ধাক্কা খেলাম। মনে আছে, ছোটবেলায় আমারও কতবড় একটা ফ্যাসিনেশন ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সামনে থেকে দেখার, কিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতাম, সামনে পড়ে গেলে তাদের স্যালুট দিয়েই উল্টোদিকে দৌড় দিতাম।
আমার শৈশবে তারাই ছিলেন আমার সুপারহিরো, তাদের বীরত্বগাঁথা আম্মা-আব্বার মুখে এত শুনেছি যে আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানেই ছিল পৃথিবীর বাইরের কোন জগতের মহাপুরুষ। তাদের ব্যাক্তিত্বের ছটায় কেন জানি মৃয় হয়ে যেতাম, তাদের দূর থেকে দেখে তাদের মত হওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তাদের ব্যাক্তিত্বের সামনে দাঁড়াতে সংকুচিত হয়ে যেতাম। কই গেল আমার সেই শ্রদ্ধা, কেন মিইয়ে গেল আমার সেই অনুভূতিগুলো? শ্রেয়া বলার আগেই কেন ছোটবেলার মত আমি শাহবাগের সেই মুক্তিযোদ্ধার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম না, ওনাকে স্যালুট দিলাম না? শ্রেয়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে দুই ভাইবোন একসাথে সেই মুক্তিযোদ্ধা চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করে ছোটবেলার মতই কোনভাবে দৌঁড়ে পালালাম লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য। ঠিক তখনই শ্রেয়া দিনের দ্বিতীয় বোমটা ফাটালো আমার উপর,
“রাজাকাররা কোন দল, আওয়ামী লীগ না বিএনপি?”
শ্রেয়ার এই প্রশ্নের জবাব কি দিব ভেবে যখন তার মত বাচ্চাকে রাজনীতি কিভাবে বুঝাব ভেবে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন আমাকে উদ্ধার করলেন ছোট খালু।
“রাজাকারের কোন দল নেই শ্রেয়া, রাজাকাররা আওয়ামী লীগও না, বিএনপিও না।
ওরা শুধুই রাজাকার। আর যদি ওদের দল কি সেটা জানতে চাও, তাহলে ওদের দলের নাম জামাত”।
-“ও আচ্ছা, জামাত। ”
শ্রেয়ার উত্তর শুনে বুঝলাম জামাত নামের দলের নামটা সে আগেই শুনেছে টিভিতে, তার পরিচিত গণ্ডির মধ্যে পড়েছে।
আপনারা যারা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আছেন, সংহতি প্রকাশ করেছেন কিংবা যারা এখনো আসেননি আপনার আশেপাশের বিক্ষোভস্থলে, তাদের আমি অনুরোধ করবো আপনাদের বাসায় কিংবা আশেপাশে কোন ছোট বাচ্চা থাকলে তাদের আপনার সাথে সমাবেশে নিয়ে যান, তাকে নিয়ে স্লোগান দিন, কি কারণে এই আন্দোলন হচ্ছে তা বুঝিয়ে বলুন।
আপনার হয়তো মনে হতে পারে ছোট বাচ্চারা এসবের কি বুঝবে, কিন্তু আসলে ওরা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি বুঝে। আমাদের প্রজন্মকে বয়স্করা ডিজুস/ ফেসবুক জেনারেশন বলে অবজ্ঞা করতো, বলতো মৌজ-মাস্তি ছাড়া দেশের জন্য কোন কাজ আমাদের প্রজন্ম করতে পারবে না। আমরা তাদের ভুল প্রমাণিত করেছি, দেখিয়ে দিয়েছি ছোটবেলায় আমাদের মস্তিষ্কে স্বাধীনতার চেতনার যে বীজ তারা রোপণ করেছিলেন, তা আজ ফল দিতে শুরু করেছে। আজ আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম আমাদের নিয়ে গর্বিত। তাই এখন আমাদের পালা আমাদের পরবর্তী “ডোরেমন প্রজন্ম”- এর মাথায় বীজ বপন করার।
সময় দিন, সেই বীজের পরিচর্যা করুন নিয়মিত, এই বীজ থেকেও আগামীতে ফল পাবেন- গ্যারান্টি দিয়ে বলছি!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।