শিরদাঁড়া নেই, বহু শরীরেই নিজেদের মানাতে মানাতে.......
ঈদে বাড়ি এসে বিপাকে পড়লাম। অবশ্য এ এমন ধরনের বিপাক যে পাকে সবাই পড়তে চায়। হিন্দুদের সাত পাকেঁ বাধা পড়ার মতই ব্যাপার।
মা আমার জন্য মেয়ে দেখেছেন। মেয়ে সোমত্ত হলে মা-বাবাদের চুল যেমন দুশ্চিন্তায় সাদা হয়ে যেতে থাকে তেমনি ছেলে বিবাহ যুগ্যি হলে পুলকে বাবা-মায়ের চুল নতুন করে গজাতে থাকে।
আর সেই ছেলে যদি ঢাকা মেডিকেলে পড়ে তাহলে তো কথাই নেই!
গত ঈদে অর্থাৎ রোজার ঈদে মেয়ের দুজন নিকট সম্পর্কীয় আত্মীয় আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দেখে গেছেন। এবং তাদের মেয়েকে আমার সাথে গাটছড়া বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ফলশ্র“তিতে আমার গার্জিয়ানদ্বয় অর্থাৎ আমার মা ও বড় ভাইকে নিয়ে তাদের অতীব সুন্দরী ,কাচা হলুদ রঙা ফর্সা মেয়েকে দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন। সুন্দরী মেয়ে পছন্দ হওয়ারই কথা তারপর তাদের পণের পাল্লাও বেশ ভারী।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, আমাদের অঞ্চলে চিংড়ি চাষের কারণে কতিপয় বুদ্ধিমান লোক সাধারণ গরীব ধান-চাষীদের জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় একেবারে তালগাছ বনে গেছে।
আমার হবু (!) শ্বশুর এই বিরল প্রজাতির দু®প্রাপ্য সদস্য।
এই বিরল প্রজাতির ধনাঢ্য সদস্যদের মধ্যে একটা অলিখিত গোপন প্রতিযোগীতা আছে। জামাই প্রতিযোগীতা। নিজের ছেলেরা ক অর গোমাংস থাকলেও তা নিয়ে তাদের কারো মাথা ব্যথা নেই। কার জামাই কত বড় চাকরি করে ,কার জামাই ডাক্তার ,কার জামাই ইঞ্জিনিয়ার ,কার জামাই জজ-ব্যরিষ্টার ,কার জামাই সচিবালয়ে চাকরি করে তাই নিয়ে এ বিরল প্রজাতির ভাবনার অন্ত নেই।
নিজের জামাইকে যে যত বড় দেখাতে পারে সে সমাজে তত সম্মান লাভ করে। নিজের ছেলেদের বেলায় লবডংকা।
ঈদের আগের দিন রাতে মা যখন বিয়ের প্রসংগ তুললেন তখন পাশে উপবিষ্ট পিতার অবর্তমানে আমার বর্তমান অভিভাবক বড় ভাই ও ভাবী। বড় ভাইও আমার মত ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সে সরকারী চাকরি করে এবং আমার পড়াশুনার খরচ বহন করে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ,বিয়ের প্রস্তাব এসেছে বড় ভাইয়ের শ্বশুরকুলের আত্মীয়ের মধ্য থেকে। যে কারণে বড় ভাইয়ের আগ্রহটা বেশী। তবে তার স্বভাব অনুযায়ী সে এ প্রসংগে কথা বলছে খুবই কম।
বড় ভাইয়ের কারণে সরাসরি না বলতে পেরে আমি মায়ের উপর ঝাঝ দেখালাম ‘আমার এখনও পড়া শেষ হয়নি। এর মধ্যে বিয়ের কথা আসছে কেন?’
‘রেজাল্ট ভাল না হলে বিদেশের একটা স্কলারশীপ পাওয়া অসম্ভব।
’ আমি জানালাম।
‘সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে’ আমার কম কথার বড় ভাই একটা ছোট বাক্য বলে থেমে গেল যেন বাকীটা আমি হাতগুনে বুঝে ফেলব।
বাক্যের বাকীটা মা শেষ করলেন ‘ তোর বিদেশ যাওয়ার সব খরচÑখরচা হীরার বাপই দেবে তাই সে যে কয় লাখ টাকা লাগুক। ওদের একমাত্র জামাইকে ওরা বিদেশ ফেরত ডাক্তার বানাবে এটাই ওদের ইচ্ছে। ’ মা দম নেয়ার জন্য থামলেন।
ভাবী ছিল রান্নাঘরে। শুধু ঈদের কদিন এসে মাকে সাহায্য করে বলে তার বাড়াবাড়িটা একটু বেশী। মাকে রান্নাঘরের কোন কাজে হাত দিতে দেয় না।
ভাবী আমাদের সবার জন্য দুমিনিটের ম্যাগী নুডুলস দশমিনিটে তৈরী করে নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে দিতে বলল ‘তোমার মাথা খারাপ করে দেয়ার জন্য হীরার একবার দর্শনই যথেষ্ট। ’
‘ যে জিনিস দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায় তা না দেখাই ভাল।
কি দরকার শুধু শুৃধু মাথাটা খারাপ করার। ’ আমি হাসতে হাসতে বললাম। ‘তাছাড়া তুমি তো জানোই ভাবী উল্লুকের গলায় হীরার মালা শোভা পায় না। ’ কেউ হাসছে না দেখে আমি হাসি থামালাম।
‘ তোমাকে যে উল্লুক ভাবে সে নিজেই উল্লুক।
’ ভাবী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
‘ আমি নিজেকেই নিজে উল্লুক ভাবি। ’
বড় ভাই কি মনে করে , সম্ভবত সে থাকলে মা ভাবী ও আমি খোলাখুলি ভাবে ঐ মেয়ের ব্যাপারে আলাপ করতে পারব না বিবেচনা করে অন্ধকার রাতে তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট হাতে নিয়ে ‘মা আমি একটু বাজারের দিকে যাচ্ছি ’ বলে বেরিয়ে পড়ে।
মা ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস ,বেশী রাত করিস না ,তুই আসলে সবাই খেতে বসব ’বলে বড়ভাইকে তাগিদ দেয়।
ভাবী আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় ।
বিয়েও হয়েছে বছর দুয়েক। । তাছাড়া সে থাকে ভাইয়ের সাথে খুলনায়। আমি ঢাকায়। ঈদ এবং অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানেই শুধু আমাদের দেখা হয়।
এজন্য আমাদের মধ্যের জড়তা কাটেনি।
ভাবী আমার থেকে একটু দুরত্ব রেখে মায়ের পাশ ঘেষে বসে।
আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে কৌতুহল বশে জিজ্ঞেস করি ‘তোমার হীরা না মতি লম্বা কেমন?’ আমি নিজে লম্বা বলে মেয়েদের এই ব্যাপারটাই প্রথমে দেখি।
‘সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত খাটোই হয়। তবে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
হীরা যথেষ্ট লম্বা। কি বলেন মা ? আপনি তো দেখেছেন?’ সে মায়ের দিকে তাকায়।
মা হয়তো আমার পড়াশুনার তি হবে কিনা এদিকটা খতিয়ে দেখছিলেন। এজন্য থতমত খেয়ে বললেন ‘হ্যা হ্যা বেশ লম্বা। আমার চেয়েও লম্বা।
দেখতেও খুব সুন্দর। গায়ের রঙ ফর্সা। তোর সাথে মানাবে বেশ। ’ মা যে হবু ছোট বৌমার ব্যাপারে খুব খুশী তা মায়ের চোখমুখের আলোর আভা দেখে বেশ বোঝা যায়।
ভাবী উঠতে ঊঠতে বলে ‘ তোমার তো গাড়ির খুব শখ।
সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। আমিই করে দেব। তবে শর্ত একটাই। মাঝে মধ্যে আমাকে গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। ’
তাহলে ব্যাপার এটাই! ভাবীই ঘটকালির দায়িত্বটা পালন করছে।
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। যুথিকে ঈদ মোবারক জানানো। অবশ্য মনে মনে। স্বল্পভাষী যুথির সাথে অল্প-বিস্তর কথা হলেও ওকে এ ব্যাপারটা জানানো হয়নি। দেখি এবার ঈদের পর ঢাকায় যেয়ে ওকে বলতে হবে।
তবে আমার মনে হয় কিছু কিছু জিনিস না বলাই ভাল। নিজের জন্য কিছু রাখতে হয়। তো সে প্রিয়তমা হলেও। আর এবার রূপবতী রাজকন্যে হীরার চিন্তা যেভাবে আছন্ন করে আছে তাতে শ্যামলা অন্যের আশ্রিতা যুথি পাত্তা পাবে কিনা সন্দেহ। মুখে যতই বড় বড় কথা যৌতুক বিরোধী বুলি আওড়াই না কেন মনের কোনে লটারীর মতই আসা সম্পদের লোভ কার না আছে! যৌতুক বিরোধী বাতচিত তো অন্যের জন্য।
নিজের উপর অহেতুক কেন ওসব প্রয়োগ করা। তাছাড়া তারা তো আর যৌতুক দিচ্ছে না। তাদের একমাত্র মেয়ে-জামাইকে তারা উপঢৌকন দিচ্ছে। জামাইকে দেয়া মানেই তো মেয়েকে দেয়া। জামাইকে বিদেশ থেকে ডাক্তারীর উচ্চ ডিগ্রী আনানো তো মেয়ের জন্যই ইনভেস্টমেন্ট।
এতণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যুথি আমার প্রেমিকা। আমার নিধর্নী প্রেমিকা। অবশ্য সব প্রেমিকের কাছেই তাদের প্রেমিকারা ভালবাসার সম্পদে ধনী। কিন্তু হীরার প্রসঙ্গ আসার পর থেকে কেন জানি ভালবাসার সম্পদে মন ভরছে না। ভালবাসার সম্পদের সাথে সাথে অর্থসম্পদও যে জরুরী তা যেন একটু একটু করে বুঝতে পারছি।
ঢাকায় জীবনযাত্রা এত ব্যয়বহুল যে প্রতিমাসে বড়ভাইয়ের পাঠানো আড়াই হাজার টাকায় আমার কিছুই হয় না ;যদিও থাকি হলে এবং অন্যান্যদের মত সিগারেট খাই না।
সে কারণেই মাত্র একটা টিউশনি করাই যেখানে আমার বন্ধুবান্ধবেরা দুটোর নিচে করায়ই না। আর যুথির সাথে প্রেমটা আমার হয়েছে এই টিউশনি করাতে গিয়েই।
আপনারা হয়তো ভাবছেন যে যুথি আমার ছাত্রী। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
যুথি আমার কাস টু শর্মির এর ছাত্রীর একমাত্র ছোটখালা। সংসারে একমাত্র উপার্জনম ব্যক্তি পিতা মারা যাওয়ায় এবং কোন বড় ভাই না থাকায় সে তার বোনের সংসারে থাকে এবং জগু বাবুর পাঠশালা অর্থাৎ জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। সে অবশ্য এর আগে তার মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে মামার বাড়িতেই থাকত কিন্তু সেখানে মামাত ভাইদের অসদাচরণ এবং পরবর্তীতে জগন্নাথে চান্স পাওয়ায় এবং স্বল্পবেতনে অগ্রণী ব্যাংকে চাকরিরত তার একমাত্র দুলাভাই মানুষটাও ভাল হওয়ায় সে বড়বোনের সাথে ঢাকায় থাকছে।
ছাত্রী পড়াতে যেয়ে ছাত্রীর খালার সাথে প্রেম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তবে যুথিকে ছাত্রীর বাড়িতে বার কয়েক দেখলেও ওকে দেখামাত্র প্রেম এমন কোন অনুভুতি আমার মধ্যে আসেনি।
ছিপছিপ গড়নের শ্যামলা মেয়েটিকে দেখে হৃদয়ে হুলস্থুল পড়ে যাওয়ার মত কোন অবস্থা আমার হয়নি। বিশেষত যেখানে আমাদের সংখ্যা গরিষ্ট মেয়ে মেডিকেলে ফর্সা মেয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর আমাদের দেশে ফর্সা মেয়েকেই সুন্দরী বিবেচনা করা হয়।
একদিন নীলেেত মেডিকেলের বই কিনতে যেয়ে দেখি অন্য পাশের দোকানে দাড়িয়ে যুথি বেশ মোটা সাইজের একটা বই দরদাম করছে। ও আমাকে খেয়াল করেনি।
আর আগ বাড়িয়ে ওর সাথে কথা বলার মত কোন আগ্রহ আমার নেই। তবে দোকানদারের চড়া গলায় শ্লেষ্মাতক কথাবার্তা এবং যুথির মিনমিনে কন্ঠস্বর আমাকে আগ্রহী করে তোলে।
আমি এগিয়ে যেয়ে ওকে আড়াল করে ওর পিছনে দাড়াই দোকানীর চড়া কন্ঠস্বরের কারণ জানতে।
মধ্যবয়সী দোকানী যেন আমাকে পেয়ে তার নালিশ শোনানোর একজন লোক পায়।
দোকানী আমার উদ্দেশ্যে বলে ‘দেখেন তো ভাই এতগুলো বই ঘাটাঘাটি করে এত উচু র্যাক থেকে বই পেড়ে দেখানোর পর দরদাম সব ঠিক করার পর এখন উনি বলছেন বই নেবেন না।
নেবেন না তো আগেই বলতে পারতেন। তাহলে এসব ফাজলামী করার কি মানে হয়?
যুথি লজ্জায় অধোবদনের কারণে আমাকে খেয়াল করে না। সে আবারও মিনমিনে কন্ঠে বলে ‘ বললাম তো ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমি বই কেনার জন্য যে টাকাটা রেখেছিলাম সেটা ব্যাগে না ঢুকিয়ে চলে এসেছি। টাকা বের করতে যেয়ে দেখি টাকাটা আনা হয়নি।
’ সে এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে ডান পাশে তাকাতেই আমার সাথে চোখাচোখি হয়।
সে কিছুটা লজ্জিত ,কিছুটা আনন্দিত কন্ঠে বলে ‘আপনি!
দোকানী একটু ঘাবড়ে গেল। সে আমাকে সাী মেনেছিল। আর এখন আমি মেয়েটির পরিচিত জেনে সে আশাংখা করতে লাগল ঝাড়ি খাওয়ার।
কিন্তু আমি নির্বিরোধী মানুষ।
ঢোড়াসাপ!
আমি দোকানীর কাছে বইটার দাম জানতে চাইলাম। দোকানী দাম জানালে আমি ম্যানিব্যাগ থেকে টাকাটা বের করলাম। ভাগ্য আজ বেশ কিছু টাকা পকেটে ছিল!
যুথি না না করে বলল ‘আমি পরে এসে কিনে নিয়ে যাব। আপনি শুধু শুধু....’
সে বাক্য শেষ করার আগেই আমি বললাম ‘ এখন আমার টাকা দিয়ে বই কিনে নিয়ে যান। আজ বাড়ীতে গেলে টাকাটা দিয়ে দেবেন।
তাহলেও তো হলো। ’
সে কি বলবে বুঝতে না পেরে নিচু মাথা ঝাকিয়ে বলে ‘তা করা যায়।
বই কিনে আমরা নীলতে থেকে বেরিয়ে আসি। সে কোন কথা বলছে না দেখে আমিই কথা বলি ‘এখন কোথায় যাবেন? বাসায়?’
‘মানে.. হ্যা.. বাসায়। ’ সে যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে।
‘চলেন রাস্তার ওপারে যাই। ওখান থেকে বাসে উঠবেন। ’ মেয়েটাকে বাসে তুলে দেয়ার দায়িত্ব অনুভব করি।
‘ আপনাকে বোধ হয় ঝামেলায় ফেললাম। টাকাটা দিয়ে হয়তো আপনি আপনার জন্য কোন বই কিনতে এসেছিলেন।
’ যুথি এক নাগাড়ে এত গুলো কথা বলে থেমে যায় কথা বেশি বলে হয়ে গেছে বিবেচনা করে।
‘আমার বই পরে কিনলেও চলবে। আমি এদিকে প্রায়ই আসি। আপনার বোধ হয় এদিকে খুব একটা আসা পড়ে না। ’
‘ না।
কলাবাগান থেকে বাসে উঠে সোজা কলেজে চলে যাই এবং কলেজ থেকে আবার বাসায় চলে আসি। আজ বই কিনব বলে নেমে পড়লাম। ’
‘এবং বই কিনতে যেয়েই বিপত্তি। ’ আমি মেপে হাসলাম।
সে রাস্তার ওপারে যেয়ে তারপর বলল ‘ মানে ..আমি একটু ..পাবলিক লাইব্রেরী..
‘পাবলিক লাইব্রেরীতে যাবেন?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘হ্যা..মানে .এদিকে তো নামা হয় না ,তাছাড়া বান্ধবীরা বলছিল একটা বইয়ের কথা.. কিন্তু আমি ঠিক লাইব্রেরীটা কোথায় চিনি না তো যদি একটু বলে দিতেন।
‘ঠিক আছে আপত্তি না থাকলে আমার সাথে রিক্সায় উঠে পড়–ন। আপনাকে লাইব্রেরীতে দিয়ে তারপর ওপাশ দিয়েই মেডিকেলে যাব। ’
আমরা দুজনে পাশাপাশি রিকশায় বসি এবং জানিনা কোন অজানা কারণে মেয়েটিকে আমার ভাল লাগতে থাকে। আগেই বলেছি সে সুন্দরী নয় শ্যামলাবর্ণা এবং রোগাটে।
কিন্তু আমি তার সবকিছুতেই মুগ্ধ হতে শুরু করি।
সে আমার কাছ থেকে ধার নেয়া টাকাটা দিতে দেরি করে। আমি অবশ্য চাপ দেই না। কিন্তু আড়াইশ টাকার মায়া ত্যাগ করার মত মনমানসিকতা তখনও অর্জন করিনি। হঠাৎ করে ওকে আবার একদিন দুপুরে আবিস্কার করি আমাদের মেডিকেলের কলেজ চত্বরে।
যুথি আমার জন্যই অপো করছিল। আমি দু’তিনজন বান্ধবীর সাথে বের হয়ে এসে ওকে দেখে বিব্রত বোধ করি। বান্ধবীরা ও কে জানতে চাইলে আমি ওকে আমার কাজিন হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেই এবং ও জগন্নাথে পড়ে শুনে ওরা আসস্ত হয় যে ঢাকা মেডিকেলের কোন ছেলে নিশ্চয় জগন্নাথের কোন টিপিক্যাল মেয়ের প্রেমে পড়বে না। ওরা ওদের হোস্টেলে চলে যেতেই আমি কিছুটা র্ ুকন্ঠে যুথিকে জিজ্ঞেস করি ‘আপনি হঠাৎ এখানে? কোন রুগী-টুগী আছে নাকি?
সে জড়িত কন্ঠে বলে ‘ন-না। এই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।
কি মনে করে জানি নেমে পড়লাম। ও আচ্ছা আপনার টাকাটা। ’ বলে সে তার ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে আমার হাতে দিল।
টাকা তা সে যে ভাবেই আসুক,মন ভালো করার সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। আমার মন ভালো হয়ে গেল।
তাছাড়া বান্ধবীরা চলে যাওয়ায় এবং যুথি পাশে থাকায় বেশ ভালো লাগতে লাগল।
আমি বললাম ‘বাসায় যাওয়ার তাড়া আছে নাকি?
সে মৃদু কন্ঠে বলল ‘কেন?
‘না। এম্নি। কাস শেষতো ভাবলাম আপনার যদি সময় থাকে তো কোথাও ঘুরে আসা যায়। ’
যুথি হেসে সম্মতি দিল এবং ওর হাসিতে কি যাদু ছিল জানিনা ,বোধ হয় অমন সরল হাসি দেখেই আমি বুঝতে পারলাম আমার ভিতরে কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে।
একটা ছেলে একটা মেয়ের ভিতরে হঠাৎ কি দেখে যে প্রেমে পড়ে যায় সেটাই একটা রহস্য!
আমরা রিকশা নিলাম লালবাগ কেল্লা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ও কখনো লালবাগ কেল্লা দেখেনি। ও আসলে কিছুই দেখেনি। জগন্নাথে পড়া সত্বেও আহসান মঞ্জিল দেখেনি। ঢাকার কোন দর্শনীয় স্থান ওর দর্শন করা হয়নি।
লালবাগ কেল্লা দর্শন শেষে নির্জন স্থানে পা ঝুলিয়ে বসে অনেকণ কথা বললাম। অবশ্য অধিকাংশই পড়াশুনা সংক্রান্ত। তবে আমি জানি কিছুদিনের মধ্যে পড়াশুনার প্রসংগর পাঠ আমরা কাটিয়ে উঠব এবং তা বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনায় গড়াবে। কারন এ ব্যাপারে আমিই অগ্রগামী হব। আর আমার বিশ্বাস আমার এ প্রস্তাবে ওর না করার কোন যৌক্তিকতা থাকবে না।
আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি ,ওকেও আমাকে ভালবাসতে হবে।
আমি ওকে নিয়েই আমার হোস্টেল সীমানায় ফিরে এলাম এবং চাংখারপুলের বিখ্যাত ‘নীরব’ রেস্টুরেন্টে নিয়ে দুজনে দুপুরের খাওয়া নিরবেই শেষ করলাম। সংগত কারণেই বিল আমি মেটালাম। ও কোন বিষয়ে কোন রকম আপত্তি করল না। ও বোধ হয় আমার আগেই আমার মনের খবর বুঝে ফেলেছে।
মেয়েরা আগেভাগেই অনেক কিছু বুঝে ফেলে।
এরপর থেকে আমাদের রুটিন দাড়াল এরকম , যুথি জগন্নাথ থেকে কাস করেই হোক আর না করেই হোক দুপুর একটার মধ্যে মেডিকেলের ভাস্কর্যের নীচে এসে বসে থাকে। আমি কাস শেষ করে যত দেরীতে বেরোই না কেন ও বসেই থাকে। তারপর দুপুরের ঠা ঠা রোদে রিকশা নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ি দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে। ওকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে ঢাকার সব দর্শনীয় স্থান দেখানোই আমার প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে।
আর এই সব দর্শনীয় স্থান দেখার ফাকে ফাকে আমার নিজেদেরকে দর্শন করি,একে অন্যকে আবিস্কার করি। কোন কোন দিন সব কিছু দেখে শুনে আসতে আমাদের সন্ধে হয়ে যায়। তখন দুজনে একসাথেই ওদের বাসায় যাই। আমি পিচ্চিটাকে পড়াতে বসি। ওর বোন ওর দেরী করে ফেরা নিয়ে কোন কথাই বলে না।
বোধ হয় ওরা আমাদের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। ইদানীং দেখি নাস্তাও বৈচিত্র্য চলে এসেছে। আগে যেখানে রুটিন মাফিক বিস্কিট আর চা দিত এখন সেখানে লাচ্চা সেমাই ,নুডুলস ,পিঠা ,মিস্টি ইত্যাদি সম্বলিত প্লেট দেখা যাচ্ছে। এখন তো আর আমি শুধু তাদের টিচার নয়,ঘনিষ্ঠ সম্পকে আবদ্ধ হয়ে গেছি।
ঈদের দিন বিকালে বড়ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বড় ভাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বড়ভাইয়ের এক চাচাত শালা জিয়া আসে।
ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে মাইল সাতেক রাস্তা দুরে। জিয়া আমাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আমার প্রবল আপত্তিতে সে মা,ভাই ও ভাবীর সাথে কি যেন শলাপরামর্শ করে। আমি ওর হাত থেকে বাচতে তাড়াতাড়ি বন্ধুদের আস্তানায় যাওয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই মা ও ভাবীর অনুরোধে এবং ভাইয়ের আদেশ সহ জিয়ার সন্ধ্যের মধ্যে আমাকে পৌছে দেয়ার চুক্তিতে আমিও ভাইয়ের সাথে একই মোটরসাইকেলে চড়ে বসি।
ও বাড়িতে পৌছতেই আমাকে সাদর অর্ভ্যথনা,ঠাট্রার সর্ম্পকের আত্মীয়াদের রঙ্গরসিকতা এবং বয়স্কা মহিলাদের কানাঘুষায় আমার বুঝতে বাকি থাকে না যে এত পীড়াপীড়ি করে আমাকে এখানে নিয়ে আসার রহস্যটা কি!
আমাকে ঈদের সময় ছাড়া পাওয়া দুষ্কর বিবেচনা করে হীরার বাবা-মা হীরাকে নিয়ে ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে উঠেছে এবং আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে তাদের আমাকে দেখাসহ আমাকেও মেয়েটাকে দেখানোর উদ্দেশ্যে।
তবে আমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মেয়ে দেখানো হলো না। ওরাও আমার সাথে আত্মীয় হিসাবে ভালমন্দ জিজ্ঞেস সহ পড়াশুনার খোজ খবর ,বিদেশ যাওয়ার ব্যাপার এসব নিয়ে কৌতুহলী ভঙ্গিতে আলাপ করতে লাগল।
আর আমিও সাধারন ভাবে অসাধারণ হীরাকে দেখলাম।
আমার কিছু সমস্যা আছে।
কল্পনা জনিত সমস্যা। আমি কোনকিছু সমন্ধেই আগেই বেশ করে কল্পনা করি। অধিকাংশ েেত্রই দেখা যায় আমার কল্পনার জিনিসের সাথে বাস্তব জিনিসের মিল খায় না এবং আমি হতাশ হই। গতবার জানুয়ারীতে কক্সবাজার সুমুদ্র সৌকত দেখতে যেয়ে আমার একই অবস্থা। আমার কল্পনায় যা ছিল তার সাথে খুব অল্পই মিল পেলাম।
সৌকত ভর্তি গরম বালি ,টোকাই ,ফটোগ্রাফার ,হাটবারের মত জনাকীর্ন লোকসমাগম আমাকে হতাশ করল। বন্ধুরা অবশ্য বলল যে প্রায় সবারই এরকম হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম তাজমহল। কল্পনাকেও হার মানায়। কল্পনা করে কেউ তাজমহলের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
হীরাকেও আমি কল্পনায় একটা মুর্তিতে সাজিয়েছিলাম এবং যথারীতি ভেবেছিলাম ওকে দেখার পর আমার মোহভঙ্গ হবে। গ্রামের লোকজন সুন্দর বলতে ফর্সাকেই বোঝে। হয়তো দেখব রক্তশুন্যতায় ভোগা দীর্ঘকায়া কোন শ্বেতী রোগী।
হীরাকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। হীরা যথার্থই হীরা।
এক কথায় খাপ খোলা তলোয়ার। এই হেলেন যেখানেই যাবে সেখানেই একটা করে ট্রয় নগরী ধ্বংস হবে। গোটা পৃথিবী ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এরকম একটা মেয়েই যথেস্ট। এরকম সুন্দরী মেয়েদের জন্য যুগে যুগে পুরুষেরা ডুয়েল লড়ছে ,জীবন বিসর্জন দিয়েছে। আর আমি! না চাইতেই, শুধু সম্মতিতেই এরকম হুলস্থুল রূপবতীকে বিনা ডুয়েলে বিনা যুদ্ধে পেতে যাচ্ছি।
এও কি সম্ভব!
আমার তাজমহল দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে উবে গেল। আর কোথাও যেয়ে আমার কল্পনাকে হার মানানোর প্রয়োজন নেই। তাজমহল আমার ঘরেই চলে আসছে। আর আসছে গোটা সাম্রাজ্য।
মানুষ তার জীবনের কতটুকুই তার নিজের জন্যে করে? সব কিছুর মধ্যেই একটা লোক দেখানো ভাব থাকে না? আমাদের সব কিছুই তো অন্যের কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার জন্য।
গিনেজ বুকে নাম ওঠানোর জন্য এক চীনা ডাক্তার উনপঞ্চাশ দিন না খেয়ে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুধু অন্যের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব পতিপন্ন করার জন্য।
আমার মধ্যেও এই বোধটা কাজ করতে লাগল। অনন্য সুন্দরী একটা মেয়ে নিয়ে পাশে পাশে ঘুরব। সবাইকে সদম্ভে দেখাবো দেখ আমি কি পেয়েছি। তারা হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
আমি এই বিয়েতে মত দিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।