পথে নেমেছি; পথই আমায় পথ দেখাবে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তৎপরতা লক্ষ্য করেছেন সারা দেশবাসী। জঙ্গি হামলার শিকারও হয়েছেন অনেক নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী ও সরকারি কর্মজীবী। সাম্প্রতিককালে বি.ডি.আর. জাওয়ানদের হাতে বেশ 'সুপরিকল্পিত' ভাবেই নৃশংস রূপে যে হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে, তাতে মাননীয় বাণিজ্য মন্ত্রী তদন্ত কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই মন্তব্য করে বলেছেন যে এই ঘটনার সাথে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য তাঁর অপরিপক্ষ মন্তব্যে সাঁয় দিতে নারাজ হয়েছেন অন্যান্য অনেক মন্ত্রী।
তথাপি, তাঁর মন্তব্যের দরুন নতুন করে জঙ্গিবাদের আলোচনা উঠে এসেছে লীড নিউজ থেকে শুরু করে 'শুকনো কফি' সমৃদ্ধ 'টক-শো' গুলোতেও। শুরু হয়েছে নতুন পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ। জঙ্গিবাদের সুত্র খুঁজতে আবারো চঞ্চল হয়ে উঠেছে বুদ্ধিজীবি মহল থেকে পত্র পত্রিকাগুলো, চায়ের কাপে নতুন নতুন ঝড় তুলছেন, এমনকি গ্রামের সাধারণ জনগণও।
জঙ্গিবাদের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যপারটা অনেকাংশে জড়িত! কথাটা অনেকের কাছে 'আক্রমণাত্মক' মনে হলেও একেবারে আস্বীকার করার মত নয়! একথাও সত্য যে, সকল মাদ্রাসাই জঙ্গিবাদের জন্ম দেয় না। বরঞ্চ অধিকাংশ মাদ্রাসাতে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফ থেকে যে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে, তাতে জঙ্গিবাদের জন্ম দেয়া তো প্রশ্নই উঠে না, জঙ্গিবাদ ও বিশৃংখলাকে ঘৃণ্য ও ত্যাজ্যরুপেই গণ্য করা হয়।
এর পরও গুটি কয়েক মাদ্রাসা শিক্ষিত 'তালেবান' সদৃশ জঙ্গিদের কারণে কি সকল মাদ্রাসা শিক্ষিতদের ঢালাওভাবে জঙ্গি গণ্য করা ঠিক হবে?
জঙ্গিবাদের সাথে অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সম্পৃক্ত করার প্রবণতাটা শুরু হয়েছে গত পাঁচ থেকে ছয় বছর পূর্বে। এর আগে যতো জঙ্গি তৎপরতা ঘটেছে, তারা মাদ্রাসা শিক্ষিত নয় বলেই বেশি প্রমাণিত। স্বাধিনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কম জঙ্গি চর্চা হয়নি। বাকশালের কথা মানুষের এখনো মনে আছে। ঠিক তেমনিভাবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জংঙ্গিচর্চার লিষ্ট করতে গেলে বোধ হয় আমার পক্ষে আজ এই লিখা শেষ করা সম্ভব হবেনা! গত পাঁচ ছয় বছরের পূর্বেকার সময়ে যে সব জঙ্গিচর্চা হয়েছে, তারাও কি মাদ্রাসা শিক্ষিত ছিল? তার মানে কি জাতির জনকের বাকশালের সদস্যরাও মাদ্রাসা শিক্ষিত ছিল? জয়নাল হাজারী, হাজী সেলিম কিংবা ডাঃ ইকবালের বাহিনির সদস্যরাও সবাই কম বেশি মাদ্রাসা শিক্ষিত ছিল বলে কি ধরে নেওয়া যায়।
এ যাবৎ কোনো পত্র পত্রিকাতে অবশ্য এই ধরনের খবর আসেনি। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আয়ারল্যান্ডের জঙ্গি সংগঠন আই.আর.এ. এর সকল সদশ্যই খৃষ্টান, তাই বলে তো আমরা সমগ্র খৃষ্টান সম্প্রদায়কে তাদের দোষ চাপিয়ে দিতে পারি না। অতঃএব, মাদ্রাসা শিক্ষিত ভাই বোনদের এতটুকু আস্বস্ত করে বলা যায় যে কিছু কিছু জঙ্গি মাদ্রসা শিক্ষিত বলে তারা সবাই জঙ্গি খেতাব পেতে পারেন না। তাদের নাগরিক অধিকার দেওয়ার দায়িত্ব পুরোটাই সরকারের উপর যেমন রয়েছে, তেমনি তাদেরও পুরো অধিকার আদায় করার যোগ্যতা রয়েছে।
জঙ্গিবাদের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের যে সম্পর্ক উঠে এসেছে, তা একটু খতিয়ে দেখলে আরও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমতঃ যারা এইসব জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িত, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এরা বেশির ভাগই গরীব শ্রেণীর মানুষ, যাদের জীবনের অর্থ বলতে কিছুই নেই। যারা সারা জীবন ধরে তাদের এইটুকু বয়স পর্যন্ত সময়ের কোনো মানেই খুঁজে পেলনা, তাদের কাছে নিজেকে আত্মঘাতি বোমায় উড়িয়ে দেওয়াটা কতটুকুই বা চিন্তা করার বিষয় তা সহজেই অনুমেয়। দ্বিতিয়তঃ সাধারণত সমাজে যারা গরীব, যাদের কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা এবং যারা চারিদিক থেকেই অবহেলিত, তারাই তাদের ছেলে মেয়েদেরকে মাদ্রাসাতে ভর্তি করিয়ে থাকেন। ধনিদের মধ্যেও অনেকেই মাদ্রাসায় ছেলে মেয়ে ভর্তি করান, তাও যদি সন্তানটি কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, বা পঙ্গু হয়ে থাকে, কেবল তবেই আল্লাহর কাছে মান্নত করে সন্তানটিকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন।
বলতে গেলে এক ধরনের 'রিজেক্টেড' না হলে মাদ্রাসার হাওয়া গায়ে লেগে উঠেনা কারোরই। প্রকৃত অর্থে আলেম হিসেবে তৈরি করার উদ্দেশ্যে সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার মতো লোক খুব নগণ্য সংখ্যকই বলা যায়। যার কারণে ত্রিশ বছর আগেও যেভাবে মাদ্রাসা থেকে প্রকৃত আলেম তৈরি হতো, এখন আর সেভাবে আলেম তৈরি হয়না। তৃতীয়তঃ মাদ্রাসা থেকে পাশ করার পর, পাশাপাশি সেক্যুলার শিক্ষা অর্জন না করলে চাকুরির ক্ষেত্রে তার তেমন কোনো ভালো সুযোগ মিলে না। তখন বাধ্য হয়ে তাকে হয়তো ইমামতি, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, কিংবা অন্য কোনো ছোট খাটো চাকুরি নিয়ে জীবন নির্বাহের জন্য টিকে থাকতে হয়।
তার জন্যও আবার ভাল 'লিঙ্ক' বা 'মামু'র প্রয়োজন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের ভর্তি নিয়েও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এসব কারণেই মাদ্রাসা শিক্ষিতরা সমাজে নিজেদেরকে যোগ্য করে তুলতে অন্যদের তুলনায় বেশি সংগ্রাম করে আসছে, যদিও মর্যাদা পেয়ে আসছে অনেক কম। সমাজের হাজারও প্রতিবন্ধকতার মাঝে দু' একজন ঝরে পড়াটা অস্বাভাবিক তেমন কিছুই নই। আর এদের মাঝেই হয়তো কয়েকজন জঙ্গি তৈরি হচ্ছে।
এখন আমরা যদি এ গুটিকয়েক জঙ্গির কারণে পুরো মাদ্রাসা শিক্ষাটাকেই দায়ী করি, তা হবে এক মারাত্মক ভুল। সামান্য দু'একজনের ক্ষতির কারণে বৃহত্তর কল্যাণটাকে ভুলে গেলে চলবেনা আমাদের। আজ যদি কোথাও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, তা মাদ্রাসাগুলোতেই। তেমনিভাবেই, কেবল মাদ্রাসাগুলোতেই ধর্মীয় শিক্ষার হাতেখড়ি দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুলে যৎসামান্য ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়, তা ব্যবহারিক জীবনের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়, তা কেবল নাম মাত্রই বলা চলে।
যার প্রতিফলন ঘটছে আমাদের বৃহত্তর সমাজে। দিন দিন অপরাধ বাড়ছে, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। নৈতিকতার যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকাংশেই অপূরণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসকল ঘাটতি পূরণে মাদ্রাসা শিক্ষার কল্যাণমূখী ভূমিকা উপেক্ষা করে রাখলে জাতীয় সঙ্কট সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়। তাই মাদ্রাসা শিক্ষাকে জঙ্গিবাদের দায়ে নির্মূল না করে নতুন করে ঢেলে সাঁজানো যায়।
ধর্মীয় শিক্ষার উন্নত সিলেবাস প্রণয়নের পাশাপাশি আধূনিক শিক্ষারও অন্তর্ভূক্তির প্রয়োজন। তাছাড়াও মাত্র দু'বছরের 'ফাজিল'কে তিন/চার বছরের বি.এ. এর সমমান দেওয়াও ঠিক নয়। হয় চার বছরের ফাজিল ও কামিলকে বি.এ. এর সমমান করে দেওয়া যায়, নতুবা চার বছরের বি.এ. এর সমমানের জন্য ফাজিলের নতুন সিলেবাস তৈরি করে ঢেলে সাজানো যায়, এবং কামিলকে এম.এ. এর সমতূল্য এ্যাডভান্সড সিলেবাস প্রণয়ন করা যায়। এ বিষয়ে অবশ্য লেখকের চেয়ে বিজ্ঞলোকেরাই ভাল বলতে পারবেন।
জঙ্গিবাদের বিষয়টা মুসলমানদের সাথে সম্পৃক্ত করার কূপ্রচেষ্টা চলে আসছে হান্টিংটনের 'সভ্যতার সঙ্ঘাত' তথ্যের পর থেকেই।
ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত খৃষ্টান চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদ হান্টিংটনের এই থিসিসকে 'অজ্ঞতার সংঘাত' বলেই অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, পশ্চিমা সভ্যতা মুসলমান সভ্যতা সম্পর্কে এখনো অনেক জানার বাকি আছে, অনেক বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে। আর হান্টিংটং যে সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছে, তার একমাত্র কারণ ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে অজ্ঞতা। যতদিন না পর্জন্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ না জানবে, ততদিন তারা এই অজ্ঞতার সঙ্ঘাতেই নিমজ্জিত থাকবে। এখান থেকে একটা শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন মনে করি বাংলাদেশের।
আসলে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা মুসলমান হওয়া সত্বেও, ইসলাম সম্পর্কে কতটুকুইবা জানি? যা জানি, তারই বা কতটুকু মানি? আমাদের এই জানাটাকি আন্তরিকভাবি অর্জিত জ্ঞান, নাকি আমরা স্কুল বা পিতামাতার কারণে বাধ্য হয়ে জেনেছি? আমার সাথে অবশ্য অনেকেই একমত নাও হতে পারেন, জঙ্গিবাদের তৎপরতা যেসব স্থান থেকে বেশি শোনা যায়, তথা আমেরিকা এবং ভারত, তাদের মূল উদ্দেশ্যটাই ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নিধন নই কি? তার মানে কি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের যে ধূম তোলা হচ্ছে, তাও আবার মন্ত্রী দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, তার মূলে ইসলাম বিদ্বেষ নেই তো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নির্বাচিত সরকারের কাছে জনগণ জঙ্গি নিধনের নামে ধর্মশূন্য রাষ্ট্র নিশ্চয় আশা করেনা। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নির্বাচিত সরকার ও সকল বিবেকবান জনগণের কাছে একটা যুক্তিঙ্গত দাবি জানিয়ে শেষ করতে চাই। আমরা সকলেই জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি। তবে জঙ্গিবাদ নিধনের নামে আমরা রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে পারিনা। আমাদের পরিচিতি ইসলাম ধর্মকেও বিসর্জন দেওয়ার সুযোগ নেই।
তাই অজ্ঞতার সঙ্ঘাত থেকে দূরে সরে আসতে হবে, অজ্ঞতার কালো মেঘ সরিয়ে আমরা নতুন সূর্যোদয় চাই।
উৎস: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।