সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...
অতিথের দিকে একটু তাকালেই খুব কষ্ট হয়। যেমন,সাবকে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত শাসনের চার বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সরকারের ১০০ দিনের কাজের বয়ান দিয়ে যে বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন তাতে একটা আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল । নতুন শতাব্দির সঙ্গে তাল মেলাতে তথ্য প্রযুক্তির উতকর্ষ সাধন, বিশ্ব মানুষের সঙ্গে তাল মিলতে ভাষা শিক্ষার জন্য জেলায় জেলায় ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব স্থাপন সহ হরেক রকম প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। ওই স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার আমলের কলঙ্কময় শুরুটা আড়াল করতে পারেননি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে নারকীয় উল্লাসের কথা তার বক্তৃতায় স্থান পায়নি। বক্তৃতার উপসংহারে এসে তিনি বরং দাবী করেছেন, বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ ঘটবে জোট শাসনে।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ চার বছরে কী রূপ নিয়েছে সে সম্পর্কে আমি সহ দেশের আরও বিশিষ্টজন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছেন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিবরণ আমরা পাই অধ্যাপক ড· হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইতে।
এর জন্য তাকে শেষ পর্যন্ত জীবনও দিতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অনেককে কারাবাস করতে হয়েছে। কেউ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন, বিদেশী সাংবাদিকরা বহিষ্কৃত হয়েছেন। তাদের সাশন আমলে দেশের ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু বা আদিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের মানসিক অশান্তি ও বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন বেড়েছিল বহুগুণে।
কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই নয়, সংখ্যাগুরু মুসলমানরাও নিরাপদহীন জীবন যাপন করছেন। রর্গা পূজায় সরকার বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল। তার মধ্যেও প্রতিমা ভাংচুর ও মন্দির ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। সরকারের নিরাপত্তা প্রহরায় পূজা উতসব পালিত হয়েছে। ঢাকা সহ দেশের প্রধান প্রধান পূজা মন্ডপে সাধারণ পুলিশ প্রহরার পাশাপাশি র্যাব, চিতা, কোবরা, আর্মড ব্যাটালিয়নের পাহারা ছিল।
কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরকেও রমজান মাসের প্রথম জুমা পুলিশ প্রহরায় আদায় করতে হয়েছে। জুমার পরদিন প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদচিত্রে দেখা যায়, নিরাপত্তা বাহিনীর উচানো সঙ্গীনের নিচে নামাজ পড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। শান্তির ধর্ম ইসলামকেও পুলিশ প্রহরায় পালন করতে হয়। এর কারণও গত ৫ বছরের বিএনপি-জামাত-জোটের দুঃশাসন। এই ৫ বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সমাবেশ, সিনেমা হল, সাংস্ড়্গৃতিক অনুষ্ঠান, মসজিদ, মাজার শরীফ, ওরস শরীফে বোমা হামলা হয়েছে।
পাকিস্তান বা অন্যান্য দেশের মত শিয়া-ছুন্নী বিরোধ আমাদের দেশে নেই। বিরোধাত্মক সম্পর্ক নেই বিভিন্ন তরিকার মধ্যেও। এ দেশের ইসলামের বিভিন্ন তরিকার মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা রয়েছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মমত চর্চার ক্ষেত্রেও পরমতসহিষ্ণুতা রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম পালনের শান্তিময় পরিবেশ অনেকখানী বিঘ্নিত হয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে গত বছরের রোজা-পূজায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায়।
এর কারণ হচ্ছে, ১৭ আগষ্ট দেশব্যাপী একযোগে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। তারপর আবার ৩ অক্টোবরের ঘটনা। বিএনপি-জামাত-জোট সরকার ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া গ্রেনেড-বোমা হামলার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি বা ব্যর্থ হয়েছে অথবা করতে চায়নি। সব তদন্তই মাঝপথে থেমে গেছে অথবা ফাইল চাপা পড়ে আছে। এমনকি ইন্টারপোল, স্ড়্গটল্যান্ড ইয়ার্ড, এফবিআই বাংলাদেশে তদন্ত করতে এসে রিপোর্ট চেপে গেছে অথবা রহস্যজনক কারণে তা জন সমক্ষে প্রকাশ না করেই চলে গেছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অপরাধ তদন্তে বিশ্বমানের দক্ষতা কি তাদের নেই ? ১৭ আগষ্টের বোমাবর্ষণ যদিও কোন গোপন ব্যাপার ছিল না। বোমাবাজরা প্রকাশ্যেই তাদের ল্ক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২১ দিন নিরব থাকলেও প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে সক্রিয় হতে হয়েছে। এই অভিযানে যারা ধরা পড়েছে তাদের আসল পরিচয়ও পাওয়া গেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা গত ৫ বছরে জঙ্গিবাদের পর্যায়ে যে রূপ নিয়েছে তারই বিস্তৃত বিবরণ বেরিয়ে এসেছে ধরা পড়া ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিতে।
দেশে ও বিদেশে এসব জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের নামে কাজ করলেও তারা যে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব তথ্যই বেরিয়ে এসেছে প্রতিদিনের অভিযানে।
ওই অভিযানের মধ্য দিয়ে আরও দেখা গেছে, যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের শতকরা ৪০ ভাগেরই জামাত-শিবিরের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। জামাতের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীদের আস্তানায় এসব জঙ্গিদের ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল তাই নয়, বিএনপি’র মন্ত্রীরাও যে ওইসব জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন সেসব তথ্যও বেরিয়ে এসেছে গ্রেফতারকৃতদের দেয়া স্বীকারোক্তিতে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চার বছরের শাসনের কথা বলতে গিয়ে ১৭ আগষ্টের বোমা বিস্ফোরণের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের ব্যর্থতা কিছুটা স্বীকার করে নিয়ে ওইসব ঘটনাবলী সম্পর্কে সরকারের দায়কে হালকা করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার সরকারের রাজনৈতিক দায়টা স্বীকার করতে পারেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে গত চার বছরে দেশ, জাতি ও জনগণের নিরাপত্তা বিনষ্টকারী এই জঙ্গিবাদী অপতৎপরতার বিস্তৃতি ঘটেছে সেদিকে কিছুমাত্র না গিয়ে তিনি অতীতের মতোই আবার বিরোধী দলীয় রাজনীতির ওপরই এর দায় চেপেছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেছেন, তার সরকার ক্ষমতায় এসে বোমাবাজীর কালচার ও বোমা যুগের অবসানের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিরোধী দলের হরতালসহ রাজনৈতিক কর্মকান্ডকেন্দ্রীক বোমাবাজী এসব বোমাবাজীকে উতসাহিত করেছে।
কিন্তু ১৭ আগষ্টের বোমাবাজী ও আওয়াজের মধ্য দিয়ে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার যে রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল সেটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে কি ? প্রধানমন্ত্রী সেই রাজনীতিকে এড়িয়ে গেলেন কেন তার ওই বক্তৃতায় ?
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, চোখ বন্ধ করলেই কি প্রলয় বন্ধ হবে ? প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি-জামাত-জোট সরকার গত চার বছরে যে রাজনৈতিক নীতি অনুসরণ করেছেন সেটাই বিকশিত হয়ে জঙ্গিবাদে রূপ নিয়ে দেশজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা বিএনপি-জামাত-জোট শাসনের সাফল্য না ব্যর্থতা সেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা তার দলের নেতা-কর্মীরা ভাববেন কিনা সেটা তাদের ব্যাপার কিন্তু দেশের জনগণকে ভাবতে হবে। কারণ ওইসব ঘটনা বাংলাদেশে তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব, প্রশাসন, সংবিধান, নির্বাচন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেই যে চ্যালেঞ্জ করছে, সেই সত্যকে অস্বীকার করা কতটা যৌক্তিক ?
সরকার জাতীয় প্রবৃদ্ধি কতটুকু অগ্রগতি অর্জন করেছে, সাধারণ শিক্ষার মান উন্নয়নে, নকল প্রতিরোধে, কৃষির বিকাশে, শিল্পায়নে, ভূমি সংস্ড়্গারে, বেকারত্ব অবসানে, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রায়, মাগুরছড়া-টেংরাটিলার তিপূরণ আদায়ে, জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশে অথবা নারী শিক্ষায় কী সফলতা অর্জন করেছে, জ্বালানী তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে কিনা, স্বাস্থসেবার মান কোন পর্যায়ে রয়েছে-এ নিয়ে সফলতা-বিফলতার বিচার জনগণ তাদের প্রাত্যাহিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করেন এবং করছেন। এসব ব্যাপারে জনগণের মন্তব্য কী ট্রেনে-বাসে অথবা লঞ্চে, বাজার করতে আসা মধ্যবিত্ত, গরীব মানুষ, শ্রমজীবি-কর্মজীবি, শ্রমিক, কৃষক-খেতমজুর-দিনমজুর, রিক্সাচালক, বিভিন্ন পেশাজীবিসহ সাধারণ মানুষের সরব ক্ষোভ আলোচনায় সেটা বোঝা যায়। জনগণের এই ক্ষোভ আর কষ্টের কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে না পৌছায় এবং তিনি যদি কথিত সাফল্যের কল্পকাহিনীতে বুঁদ হয়ে আবারও মতাসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাহলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, অতীতের সরকারে যারা ছিলেন তারাও একই ভূল করেছিলেন এবং পরিণতিতে তার খেসারত দিয়েছেন।
আবারও যে কথা বলা দরকার তা হচ্ছে, যে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং ভয়াবহ বিস্তৃতি ঘটেছে তার খেসারত শুধু বিএনপি’কে নয়, দেশ ও জাতিকে দিতে হচ্ছে এবং হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।