সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!
এ বছর সরকারিভাবে হজের জন্য মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে দুই লক্ষ বিশ হাজার টাকা। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে সৌদি সরকারের সিদ্ধান্তের কারণেই এ ব্যয় বাড়াতে হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এ কারণে হজযাত্রীর সংখ্যা কমে যাবে এমন আশংকা করার কোন উপলক্ষ নেই। কারণ ধর্মীয় উম্মাদনায় অভ্যস্ত বাঙ্গালী মুসলমানরা নিশ্চিত বেহেস্ত লাভের আশায় প্রতিবছরের মতো এবারও দল বেঁধে হজে যাবে। বরঞ্চ আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এ বছর এ ব-দ্বীপ হতে আরো বেশি লোক হজে যাবে।
আবারও দল বেঁধে শয়তানকে পাথর মারবে এবং এর সূত্র ধরে পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকে সরাসরি বেহেস্তেও চলে যাবে।
এই উম্মাদ হাজীদের বেশিরভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের। সারা জীবনের সঞ্চয় পেনশন অথবা জমি বিক্রয় করে এরা হজে যায়। ভার্চুয়াল বেহেস্তের মালিক হয়ে হয়তো ফিরেও আসে। তবে অর্থাভাবে জীবনের বাকি সময়টা কাটে অসীম দারিদ্রতা ও সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে।
শুধু তাই নয়, ভাচুয়াল বেহেস্তের মালিকানা হাসিল করতে গিয়ে এরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে গিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম বঞ্চিত হয় জন্মসূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার নামক অবলম্বন থেকে।
অথচ ভাবনা ও বিশ্বাসটাকে যদি অন্যদিকে পরিচালিত করা সম্ভব হয় তবে হজের পিছনে ব্যয়িত এ অর্থ দিয়েই আমাদের দারিদ্রতাকে দূরীকরণ সম্ভব। যে পরিমান টাকা দিয়ে কোন নির্দিষ্ট এলাকার লোক হজে যায় সেই পরিমান টাকা দিয়ে ঐ অঞ্চলের বহু দরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করা কোন অলৌকিক বিষয় নয়। এটা শুধু স্বদিচ্ছার উপরই নির্ভর করে।
আর এই স্বদিচ্ছাটা তখনই মানুষের মনে জাগবে যখন ধর্মীয় আনুষ্ঠানীকতার চেয়ে মানবতাকে উর্ধ্বে রাখার শিক্ষাটা সে রাষ্ট্রীয় আচার আচরণ তথা রাষ্ট্রীয় মাধ্যম যথাঃ শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচার মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনাচারণ থেকে পাবে।
প্রতিবছর কোরবাণী ঈদের আনুষ্ঠানীকতা সম্পন্ন করতে বহুসংখ্যক গরু ও ছাগল জবাই করা হয়। নির্মমতার বিষযটিকে বাদ দেওয়ার পরও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিবেচনায় এই প্রথাটি বন্ধ হওয়া উচিত। কৃষিভিত্তিক আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় গরুর গুরুত্ব কতটুকু তা সবারই জানা। কলের লাঙ্গল বা আধূনীক যন্তপাতি প্রচলনের ফলে কৃষিতে গরুর গুরুত্ব কমে গেছে তা ভাবার কোন উপায় নেই।
দেশে অনেক দরিদ্র কৃষক আছে যারা ব্যয় কমাতে কলের লাঙ্গলের পরিবর্তে লাঙ্গল-জোয়াল ও গরুর ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয় অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও ধর্মীয় এই প্রথাটি আমাদের জন্য হানিকর। প্রতিবছর সামর্থ্যবানেরা কোরবাণী করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ গবাদি পশুর পাশাপাশি বিপুল পরিমান টাকাও নষ্ট করেন বা জলে ফেলেন। অথচ যে পরিমান টাকা পশু কোরবাণীর পিছনে খরচ হয় সেই পরিমাণ টাকা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করে দরিদ্র জনগণের দারিদ্রতা কয়েক বছরেই দূর করা সম্ভব। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
এতে দীর্ঘসূত্রিতা বা অনিয়ম হতে পারে ভাবলে তা ব্যক্তি উপায়েও করা সম্ভব। ব্যক্তি যে পরিমান টাকা কোরবাণীর পিছনে খরচ করবেন সে পরিমান টাকা দিয়ে তিনি তার পরিচিত একটি দরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে পারেন। এটি প্রতিষ্ঠার জন্যও শুধুমাত্র স্বদিচ্ছারই প্রয়োজন।
আমাদের দেশ হচ্ছে পীর, মাজার আর মসজিদের দেশ। এতো বিপুল পরিমান পীর, মাজার আর মসজিদ বোধ হয় আরব দুনিয়ায়ও দেখা যাবেনা।
সরকার রাস্তা করার জন্য জনগণের বাড়ি-ঘর নির্বিচারে ভাঙ্গার সাহস দেখালেও মাজার ভাঙ্গার সাহস কখনই দেখায়না। এই কারণেই সম্ভবতো খোদ ঢাকা শহরেই রাস্তার মাঝখানে মাজার দেখতে পাওয়া যায়। ধর্মীয় কারণের বাইরে এসব মাজারের ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যও আছে। এসব মাজারে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা পড়ে। এগুলো থেকে কারা হিস্যা পায় বা এসব টাকা কোথায় যায় তার কোন হদিস সাধারণ মানুষ জানেনা।
শুধুমাত্র মাজারের এই টাকাগুলোই যদি সরকার নিয়মতান্তিকভাবে সংগ্রহ করে এবং শহরের উন্নয়নে ব্যয় করে তবে আমার বিশ্বাস কয়েক বছরেই ঢাকা শহরটা ফ্লাইওভার দিয়ে ঢেকে দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রেও শুধুমাত্র স্বদিচ্ছারই প্রয়োজন।
দেশে এখন মসজিদ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে। সরকারি জমি, বিরোধপূর্ণ জমি, খাস জমি, অবমুক্ত জমি পেলেই মসজিদ। এ কারণেই একই এলাকায় অগণিত মসজিদ দেখা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই এসব মসজিদে বেশিরভাগ সময়ই এক কাতারের বেশি পূর্ণ হয়না। প্রাথমিক অবস্থায় ছনের বা টিনের চালা দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও দুই তিন বছরের মাথায়ই তা অট্টালিকায় পরিণত হয়। জনসাধারণের বিশ্বাস মসজিদের এই উন্নয়ন আল্লাহই করেন। বোকা জনগণকে কে বুঝাবে আল্লাহ নন, এই উন্নয়ন হচ্ছে তাদের নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায়। অবশ্য কষ্টার্জিত টাকার পুরোটাই যে মসজিদের উন্নয়নে কাজে লাগছে তাও নয়।
তার কিছু একটা অংশ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মসজিদের ব্যবস্থাপকদের পকেটেও যায়। তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল এসব মসজিদে ঈমাম-মোয়াজ্জেম হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে অর্ধ-শিক্ষিত মাদ্রাসা ছাত্ররা। ইসলামী আইন কায়েমের স্বপ্নে বিভোর এসব অর্ধ-শিক্ষিতরা সমাজে শৃংখলা কায়েমের পরিবর্তে সমাজকে বিভক্ত করতেই বেশি ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক বছরে জিএমবি সহ অন্যান্য যে ধর্মীয় উগ্র শ্রেণীগুলোর উত্থান ঘটছে তাতে যে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এসব মসজিদের ঈমাম-মোয়াজ্জেমদের ভূমিকা রয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
অথচ এসব মসজিদ প্রতিষ্ঠার পিছনে জন-সাধারণ যে পরিমান টাকা খরচ করছে তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করে জনকল্যাণে ব্যয় করতে পারলে দেশের দারিদ্রতা দূরীকরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ কার্যক্রমটি রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবেও করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য আমাদের সরকারগুলো নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচীগুলোর সিংহভাগই প্রণীত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর সদয় নির্দেশনায়। বলাবাহুল্য, এসব কার্যক্রমের সবই ব্যর্থতার রূপ নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দাতাগোষ্ঠী আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে তা চিন্তা করাও বোকামী।
তারা শুধু তাদের নিজেদের উন্নত ঘটাবে।
আমাদের অবস্থার পরিবর্তন আমাদের নিজেদেরই করতে হবে এবং আমরা তা করতেও সক্ষম। আমাদের যা সম্পদ আছে তার মাধ্যমেই তা সম্ভব। প্রতিবছর ধর্মীয় আনুষ্ঠানীকতার পিছনে আমরা যে পরিমান অর্থ নষ্ট করি কেবলমাত্র সে পরিমান অর্থ দিয়েই আমরা তা করতে পারি। অবশ্য এর জন্য প্রয়োজন আমাদের চিন্তা চেতনায় ভিন্নতা আনয়ন করে প্রগতিশীল মাত্রা যোগ করা।
ধর্মীয় আনুষ্ঠানীকতার চেয়ে মানবতাকে উর্ধ্বে রাখার শিক্ষাটা জনগণের মাঝে প্রচার করা। রাষ্ট্রীয় আচার আচরণ, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচার মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনাচারণ এ শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। 'ধর্মের চেয়ে মানবতা বড়' এই বোধ যেদিন সমাজে প্রতিষ্ঠিত সেদিন দেশে কোন দারিদ্রতা থাকবেনা। হোক সে দারিদ্রতা মননের, শিক্ষার, পারিপাশ্বিকতার অথবা অর্থনৈতিক অবস্থার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।