যা বুঝি, যা দেখি, যা শুনি এবং যা বলতে চাই
রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো মতবাদই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, ওহাবিজম তার আরেকটা প্রমাণ। আগের কিসত্দিতে বলেছিলাম সৌদিআরবের মুহাম্মদ ইবন আবদ আল ওয়াহাব (1703-92) এই মতবাদের স্রষ্টা। ইসলামের বেশ কড়া ও কঠোর এক ব্যাখ্যা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই মতবাদ। 1800 সাল থেকেই ওহাবিদের ইসলামি এই ব্যাখ্যা সৌদিআরবে জোরদার অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। আর এদের মধ্যেই মূলত: ইসলামের প্রথম শক্তিশালী মৌলবাদী আচরণ দেখা যায়।
সৌদি শাসক মুহাম্মদ বিন সৌদ ইসলামের এই কঠোর ব্যাখ্যায় দীক্ষত হন এবং একে তার রাষ্ট্রের শক্তিবলে আরো পুষ্ট করে তোলেন। অন্যদিকে এই মতবাদের প্রচারণার শক্তিতে তিনি আরবের বিচ্ছিন্ন বেদুইনদের একত্রিত করে বিভিন্ন ছোটছোট অঞ্চল দখল করে একটি বৃহত্তর রাষ্ট্র তৈরি করতেও সক্ষম হন।
1801 সালে ওহাবী মতাদর্শে দীক্ষিত সৌদিরা কারবালা আক্রমণ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পরবর্তীতে তারা মক্কা ও মদিনা আক্রমণ করে ইসলামের বিভিন্ন বড় ব্যক্তিত্ব ও ওলিদের মাজার ও কবর ধ্বংস করে। এর মধ্যে নবী মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমার কবরও রয়েছে।
মদিনায় অবস্থিত নবী মুহাম্মদের রওজাও তারা ধ্বংস করতে চেয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীতে তারা তাদের মত পরিবর্তন করে। তাদের এসব বর্বরোচিত হামলায় আরববিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 1807-এ এসে তাদের এসব কর্মকান্ডের বদলা নেন মোহাম্মদ আলী পাশা। তিনি সৌদি আমির আব্দুল্লাহ বিন সৌদকে ইসত্দাম্বুলে ধরে নিয়ে শিরচ্ছেদ করেন। বেশ কয়েকবার ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও শেষ পর্যনত্দ 1902 তে মো: আজিজ ইবন সৌদ রিয়াদ দখল করে আধুনিক সৌদি আরবের পত্তন করেন।
ইসলামের বিদ'আত ও শিরক শব্দগুলোর অর্থকে তারা প্রসারিত করে অনেক কাজকেই অনৈসলামিক আখ্যা দেয়। শিয়া, সুফি ও তরিকতের অনুসারীদেরকে তারা অভিযুক্ত করে অনৈসলামিক কাজের জন্য। সুফিদের কাজকর্মের বিষয়ে তাদের ছিল বিশেষ আপত্তি। তারা ব্যাখ্যা দেয় যে, কোনো ধরনের মিস্টিক আচার-প্রথা বা মেডিটেশনের মাধ্যমে আল্লাহ'র কাছে পৌঁছা সম্ভব নয়। শিরক শব্দটিকে অত্যনত্দ কড়াকড়িভাবে তারা আরোপ শুরম্ন করে।
তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী: ক) ইবাদত বা প্রার্থনার সময় আল্লাহ ব্যতীত নবী মুহাম্মদ বা অন্য কোনো ওলি-দরবেশের কথা স্মরণ করা শিরক। খ) পীর-দরবেশের জন্য বার্ষিক ওরস ইত্যাদির আয়োজন অনৈসলামিক। গ) কবর স্থায়ীভাবে পাকা করা অনৈসলামিক। ঘ) নবী বা কোনো ওলি'র মাজারে যেয়ে সালাম দেয়া ও তাদের ভাষায় যারা কবর পূজা করে তারা মুশরিক। ঙ) ইসলাম ধর্মের কোনো কিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কার করা বা সংস্কার করা অনৈসলামিক।
ইসলাম ধর্মে উপরের চেতনাগুলো ওহাবিজমের অবদান। তাদের আবির্ভাবের আগে কেউ কখনো এই বিষয়গুলোর এরকম কঠোর করে ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে ইবনে তাইমিয়্যার (1263-1328) আদর্শেই উজ্জীবিত ছিলেন ওহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। বলা হয়ে থাকে তারা ইসলামে প্রতিষ্ঠিত চার মাজহাবের কোনো মাজহাব মানেন না। তবে পরবর্তীকালে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব বলেছেন যে তারা হাম্বলি মাজহাবের অনুসারি এবং তারা প্রকৃতপক্ষে হচ্ছেন সালাফি।
তাদেরকে ওহাবী হিসেবে চিহ্নিত করাকে তারা অপমান হিসেবেই দেখেন। এখানে উল্লেখ্য যে মুহাম্মদের বাবা আব্দুল ওহাব একজন সুনি্ন পন্ডিত ছিলেন এবং তিনি তার এই ছেলেকে তার জন্মস্থান নজদ থেকে বহিষ্কার করেন। তার বাবা ও ভাইয়েরা তার মতবাদকে ভ্রানত্দ ঘোষণা দেন ও তার ভাই তার বইয়ের জবাবে পাল্টা বইও লেখেন।
সালাফি বলতে তারা ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের সময়কার প্রথাগুলো অনুসরণ করাকেই বুঝিয়ে থাকে। ইসলামে নানা ভ্রানত্দি ও গলদ ঢুকেছে বলে তারা মনে করে।
ওহাবীদের কাছে চিত্রকর্ম বা ফটোগ্রাফ বিদ'আত। নবী মুহাম্মদের জন্মদিন পালনকে (ঈদে মিলাদুন্নবী) তারা গর্হিত কাজ মনে করে। সৌদি রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ওহাবিজম বেশ একটা শক্তিশালী ধারণায় পরিণত হয়। রাষ্ট্রের পুলিশ যন্ত্র ব্যবহার করে তারা ওহাবী বিভিন্ন মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। তাই আজকের সৌদিআরবে ওহাবী মতবাদের বাইরে ইসলামের অন্যান্য শাখার চিনত্দাধারার কোনো প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না।
1962 তে তারা 'মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ' তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করে ওহাবী মতবাদকে রপ্তানী করার বিভিন্ন প্রচেষ্টা নেন।
ওহাবীদের জন্য একটি প্রচন্ড ভয়ের বিষয় ছিলো প্রগতি ও পরিবর্তন। তারা মনে করতো আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন আবিষ্কার-যেমন কফি'র প্রচলন, ছাপাখানার ব্যবহার ইত্যাদি তাদের ধর্মের বিশুদ্ধতাকে নষ্ট করেছে। তারা নবী মুহাম্মদের সময়কে ইসলামের স্বর্ণযুগ মনে করে এবং সে সময় ইসলামী সমাজ যে অবস্থায় ছিল তা ফিরিয়ে আনার আশা পোষণ করে। আজকের বিশ্বের ইসলামী চরমপন্থী বিভিন্ন দলগুলোর মধ্যে ওহাবিজমের প্রভাব রয়ে গেছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াতে 'আহলে হাদিস'রাই মূলত: সরাসরি ওহাবিজমের অনুসরণ করে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।