আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আটলান্টিকের পাড়ে কিছু ইলিপটিকাল উন্মাদনা (১ম পর্ব)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

আটলান্টিকের পাড়ে দাড়ানো ইউরোপের এক দ্বীপদেশ আয়ারল্যান্ড। এদেশে আসার পর এ জাতির রাগবীর প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা আমাকেও ধীরেধীরে নাড়া দেয়। উঠতে বসতে, রাস্তাঘাটে, বাসে-প্রান্তরে এদের রাগবী প্রীতি বেশ দারুন লাগে। উপবৃত্তাকার তথা ইলিপটিকাল শেইপের একটা বল যে কত উন্মাদনার সৃষ্ট করতে পারে, সেটা এখানে না আসলে হয়তো জানা হতো না। ছোট ছোট বাচ্চাদের টি-শার্টে লেখা দেখেছি - “টু ইয়াং, কান্ট প্লে রাগবী ইয়েট!”।

একদিন বড় হলে তারাও খেলবে, সেটারই যেন আগাম হুমকি। গিফট শপগুলোতে গেলে দেখা যায় দুটো জিনিসের খুব চল – ক্যালটিক মিউজিক/প্রোডাক্ট আর রাগবী সংক্রান্ত পোশাক। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাগবী ক্লাব হচ্ছে এখনও বর্তমান এমন ক্লাবগুলোর মধ্যে পৃথিবীর যেকোন ধরনের ফুটবলের সর্বপ্রাচীন ক্লাব। মাঝে মাঝে ওদের প্র্যাকটিস দেখি। তিব্র শীতে যখন কাঁপতে থাকি, তখন ওরা টি-শার্ট আর শর্টস পরে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়! রাগবী যেন এদের কাছে অন্যরকম অনুভুতি, আর যারা খেলে তারাতো রীতিমত একেকটা অমানুষ! যাইহোক, ২০০৭ সনে ডাবলিন আসার পর কিছু টুকটাক জিনিস কেনার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল।

টু-ইউরো শপে গিয়ে কেনাকাটা করার সময় একটা বিশাল সাইজের মাগ খুঁজছিলাম। একটু ঘাটাঘাটির পর একটা মনের মত সাইজ পেয়েও গেলাম। তড়াহুড়ার মধ্যে ছিলাম, তাই কেনার সময় কি লেখা ছিল সেটা লক্ষ্য করিনি। পরদিন সকাল বেলা দুধ ভর্তি মাগ হাতে নিয়ে দেখি লেখা - আইরিশ রাগবী। সেই থেকে শুরু।

আমার আয়ারল্যান্ড জীবনের দিনগুলোর সূচনা হতে লাগলো রাগবীর 'গুড মর্নিং' উইশ দিয়ে। তারপর ধীরেধীরে রাগবীর নিয়মকানুন শেখা শুরু করলাম। ২০০৮ এর সিক্স ন্যাশনস চ্যাম্পিয়ানশীপও ফলো করতে শুরু করি। সিক্স নেশনস হচ্ছে রাগবীর ইতিহাসে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিযোগীতা; এবার ছিল এর ১১৫তম আসর। ১৮৮৩ সনে যখন চার হোম নেশন অর্থাৎ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসকে নিয়ে এর সূচনা হয় তখন নাম ছিল হোম ন্যাশনস চ্যাম্পিয়ানশীপ, পরে ১৯১০ সনে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দল সংখ্যা পাঁচ হয়ে হয় ফাইভ নেশন্স চ্যাম্পিয়ানশীপ এবং ২০০০ সনে ইটালী আসার পর হয় সিক্স নেশনস চ্যাম্পিয়ানশীপ।

উল্লেখ্য যে এই প্রতিযোগীতাকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশীপ হিসেবেও দেখা হয় যেহেতু এখানে ইউরোপের সেরা ছয়টি দল খেলে। বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয় যাবার পথে তখন ফ্রি পত্রিকাগুলোর খেলার পাতায় নিয়মিত চোখ রাখতে শুরু করি। মূল সংবাদ ছাড়াও রাগবীর পাতা খুলে টুকিটাকি সংবাদগুলোও গিলতে লাগলাম। আইরিশদের অবস্থা তখন চরম শোচনীয়। শুধু আয়ারল্যান্ডই নয়, ওয়েলসের তিব্র দাপটে অন্য দলগুলো ছত্রখান হয়ে যাচ্ছিল।

সে বছর ওয়েলস অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান তথা গ্র্যান্ডস্লাম এবং অন্য তিন হোম নেশনকে পরাজিত করার গৌরব তথা ট্রিপলক্রাউন সহ চ্যাম্পিয়ান হয়। ওয়েলসে যখন শ্যাম্পেনের বন্যা, অন্য দেশগুলোতে তখন কবরের নিরবতা। রেকর্ড বলে রাগবীতে ইউরোপের সবচেয়ে দাপুটে দল ইংল্যান্ড। অথচ বাস্তবে খেলার মাঠে সেটার লক্ষন দেখা যায়নি। এমনিতে ইংলিশ মিডিয়া তোলার সময় অনেক উপরে তোলে, কিন্তু লবন লাগানোর সময়ও তারা ওস্তাদ।

ইচ্ছা মত ইংলিশ টিমের সমালোচনা শুরু করে দেয়। ওদের দেখাদেখি আইরিশ মিডিয়াও শুরু করলো। পত্রিকার পাতায় প্রতিটা খেলোয়াড়কে ধরেধরে ছেলা হচ্ছিল। আহারে বেচারারা। একেক জনের বিধ্বস্ত ছবি ছাপাতো।

যেন ভগ্নদশা আইরিশ রাগবী শেক্সপিয়ারের একেকটা ট্র্যাজেডী হয়ে ফিরেফিরে আসতে লাগলো। তারপর এলো ২০০৯। ৭ ফেব্রুয়ারী ইংল্যান্ড এবং ইটালীর খেলা দিয়ে শুরু হলো এ বছরের আসর। লীগ ভিত্তিক অনুষ্ঠিত এই প্রতিয়োগীতায় সব দল সবার সাথে একবার করে মোকাবেলা করে। তারপর যে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকে সে চ্যাম্পিয়ান হয়।

অপরাজিত থাকতে পারলে বাড়তি গৌরব গ্র্যান্ডস্লাম আর অন্য সব হোম নেশনকে হারাতে পারলে ট্রিপলক্রাউন। আয়ারল্যান্ড প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সকে হারায় ৩০-২১ পয়েন্টে, আর দ্বিতীয় ম্যাচে ইটালকে ৩৮–৯ পয়েন্টে। আইরিশ মিডিয়ার মুখে খানিকটা হাসি ফুটে উঠলো। এবার হয়তো তাদের দল কিছু করতে পারবে, প্রত্যাশার পারদ অনেকটা এ পর্যায়ে তখন। ২৮ ফেব্রুয়ারী ডাবলিনের কর্ক পার্কে ছিল ইংল্যান্ডের সাথে খেলা।

উপচে পড়া জনতার ভীড়ে সেদিন ডাবলিন ছেয়ে গিয়েছিল। বাসে করে সিটি সেন্টারের যাবার সময় শ্যালবার্ন হোটেলের সামনে আয়ারল্যান্ড দলের বাসকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। খানিক পরেই হয়তো খেলোয়াড়রা মাঠে যাচ্ছিল। নিজের অজান্তেই মনেমনে প্রার্থনা করলাম, ওরা যেন আজ যেতে। তিব্র উত্তেজনাপূর্ন সে খেলায় ১৪-১৩ পয়েন্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আয়ারল্যান্ড সেদিন আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ান হবার পথে।

১৪ মার্চ সিটি সেন্টারে সুপারম্যাক রেস্টুরেন্টে একটা মিল নিয়ে বসলাম স্কটল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ডের খেলা দেখতে। খেলাটা হচ্ছিল স্কটল্যান্ডের রাজধানী শহর এডিনবরায়। স্কটিশ ফ্যানে পুরো মাঠ ছেয়ে গিয়েছিল। ফ্যানদের চিৎকার আর স্কটিশ দলের আক্রমনে আইরিশরা বারবার ভেঙ্গে পড়ছিল। সুযোগটা কাজেও লাগালো তারা।

চোখের পলকে খেলায় লিড নিয়ে ফেললো। তারপর সেই লিড ধীরেধীরে বড় করার পালা। ৪০ মিনিটের প্রথমার্ধ শেষ হলে আয়ারল্যান্ড পিছিয়ে থাকলো ৯-১২ পয়েন্টে। কিন্তু খেলার দ্বিতীয়ার্ধ যখন শুরু হলো তখন দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করলো। আয়ারল্যান্ড ক্রমেই চড়াও হতে লাগলো আর পয়েন্ট আদায় করতে শুরু করলো।

স্কটল্যান্ড ১২ থেকে ১৫ পর্যন্ত যেতে আয়ারল্যান্ড ৯-কে নিয়ে গেলো ২২-এ। ফলে ৮০ মিনিটের লড়াই শেষ হলো ২২-১৫তে আয়ারল্যান্ডের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। আর মাত্র একটা খেলা বাকি; এটা জিততে পারলেই আয়ারল্যান্ড এবারের আসরের চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবে; সাথে ৬১ বছর পর গ্র্যান্ডস্লাম এবং বাড়তি যোগ হবে ট্রিপলক্রাউনও – অবস্থাটা যখন এরকম তখন খোদ আইরিশরাও ভরসা পাচ্ছিল না। কারন শেষ লড়াইতে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ান ওয়েলসের বিপক্ষে নামতে হতো আইরিশ দলকে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফে। কাকতালীয় ভাবে এবারের আসরের শেষ ম্যাচটাই হয়ে গিয়েছিল অনেকটা ফাইনালের মত।

ওয়েলসকে একমাত্র পরাজয়টা উপহার দিয়েছিল ফ্রান্স, যা তাদের পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছিল। ফলে তাদের জন্য হিসেবটা ছিল এরকম - চ্যাম্পিয়ান হতে হলে জিততেই হবে এবং সেটা ১৩ পয়েন্টের ব্যবধানে। দলটা যখন ওয়েলস তখন সেটা একেবারে অসম্ভবও নয়। অন্তত একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ন ম্যাচ হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম। নাফিস এবং ধ্রুবকেও বললাম ২১ মার্চ যেন ফ্রি থাকে, আমরা এক সাথে খেলা দেখবো।

তারপর শুরু হলো প্রতিক্ষার পালা। একটা একটা করে দিন কেটে অবশেষে এসে দাড়ালো ২১ মার্চ; মহার্ঘ্য সময়! (চলবে) ২২ মার্চ ২০০৯ ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।