ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়েই বিরক্ত হয়ে ওঠে সামান্থা। আগামীকাল শুক্রবার। এমন নয় যে সামান্থা জানত না যে কাল শুক্রবার, তবুও, সে হয়ত আশা করেছিল যে ক্যালেন্ডার তাকে অন্যকিছু জানাবে।
শুক্রবার দিনটাকে যে সামান্থা কী পরিমাণ ঘৃণা করে তা বলার মত না। এদিন স্কুল বন্ধ।
বাবা-মা'র অফিস বন্ধ থাকায় এদিন দু'জনই বাড়িতে থাকেন। ফলে শুক্রবার দিনটা কাটে খুব খারাপ, খুব বেশি খারাপ। প্রায় প্রতিটা শুক্রবারই ঘরের মাঝে লঙ্কাকান্ড ঘটে। বাবা-মা'র চিৎকার- চেঁচামেচি, ঝগড়া... সব মিলিয়ে বাসাটা যেন নরক হয়ে ওঠে। শনিবার আসলেই সামান্থা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
সেদিন বাবা-মার অফিস খোলা। আর রোববার থেকে তো স্কুলই শুরু হয়। সেই জীবনটাকেই সামান্থার স্বাভাবিক মনে হয়। বাড়ির বাইরে থাকলেই সামান্থার নিজেকে জীবিত মনে হয়। আর বাড়ির ভেতর-জীবন্মৃত।
মন-খারাপ-করা আরেকটা দিনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে নিতেই সামান্থা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গে মায়ের চিৎকারে। বিছানায় শুয়ে থেকেই ঘড়ির দিকে তাকায় ও। সাড়ে আটটা বাজে। সে বিছানা থেকে উঠে পড়ে।
মা কেন চিৎকার করলেন জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ওর নেই। সকাল দেখেই সে বুঝে গিয়েছে যে বাকি দিনটাও আর-দশটা শুক্রবারের মতই হবে।
খাবার টেবিলে গিয়ে একটা পাউরুটিতে একটু জেলি মাখিয়ে নিয়েই সে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। খাওয়ার পর একটা বই খুলে পড়ার চেষ্টা করে; যদিও সে জানত যে আজ কিছুতেই পড়ায় মন বসবেনা। ওর পড়ার টেবিলের সামনেই জানালা।
জানালা দিয়ে চারিদিকের দালানগুলোর ফাঁকে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। সেই জানালার দিকে তাকিয়েই সামান্থা আকাশ-কুসুম ভাবনায় মেতে ওঠে।
সামান্থার বয়স পনের কি ষোল। মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই একা-একা-বড়-হওয়া সামান্থা আর ওর বাবা-মা, এই তিনজন থাকে সামান্থাদের বাড়িতে।
আধুনিক প্রযুক্তির উপহার ওয়াশিং মেশিন...কিংবা রাইস কুকার...এসমস্ত জিনিস থাকায় দিব্যি দিন চলে যায় ওদের। বাসায় শীর্ষেন্দুর নভেল আর অ্যাভ্রিল ল্যাভিনের গানের মাঝেই সামান্থার জগতটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আর বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সাথেই নিজের জীবনটা উপভোগ করে ও। যতক্ষণ বাইরে থাকে ততক্ষণ ভালই থাকে সামান্থা। কিন্তু বাসায় ফিরলেই ও গুটিয়ে যায়।
গুটিয়ে যায় নিজের ভেতর। ঘরটাকে আর ওর আপন মনে হয় না। আর ঘরের মানুষকে মনে হয় খুব অচেনা।
তা-ও ভাল ওর নিজের একটা রুম আছে। নাহলে যে ও কিভাবে বাসায় থাকত কে জানে! মা বলে, 'খোঁয়াড়'।
হোক খোঁয়াড়, তবুও সামান্থার নিজের রুমটাকেই ভাল লাগে। বরং রুম থেকে বের হলেই নিজেকে খুব বেখাপ্পা মনে হয়। রোজকার অশান্তির মাঝে রুমটাই তো একমাত্র আশ্রয়।
আবার মা'র চিৎকার। সামান্থা দুর্ঘটনার আভাস পায়।
আগে এসব খুব খারাপ লাগত ওর। কিন্তু এখন ও নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করে। বাসায় আগে যখন তুলকালাম কান্ড ঘটত, খুব খারাপ লাগত সামান্থার, ও অসুস্থ বোধ করত খুব। অথচ যারা তুলকালাম কান্ড ঘটাচ্ছেন তারা ঠিকই কিছুদিন পর স্বাভাবিক হয়ে যেতেন। কিংবা বলা উচিত স্বাভাবিক হবার ভান করতেন।
সামান্থাই শুধু প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকত। আগে রাগ হত ওর, দুঃখ...খানিকটা অভিমানও। এখন যে কেমন লাগে সামান্থা নিজেও জানেনা। ও বোধহয় এখন কান্ত হয়ে গিয়েছে এসব দেখতে দেখতে। আবার মায়ের গলা শোনা গেল।
তারপর বাবার। সামান্থা দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আরেকটা টিপিক্যাল শুক্রবার।
বাইরের শব্দ আর নিজের ভেতরের শব্দ...সব মিলিয়ে খুব অস্থির লাগে সামান্থার। সে মেডিটেশন করার চেষ্টা করে।
চোখ বন্ধ করে কাউন্টডাউন শুরু করে, ১৯, ১৮, ১৭,১৬..... ধীরে ধীরে ধ্যানমগ্ন হয়ে যাওয়াটাকে ও উপভোগ করে খুব।
হঠাৎ কাচ ভাঙ্গার শব্দ আর চিৎকার। রক্ত-জল-করা চিৎকার। ধ্যান ভেঙ্গে যায় সামান্থার। সে বিছানা থেকে নেমে দরজা খোলে।
বাইরে তাকিয়ে দেখে বিক্ষিপ্ত ভাঙ্গা কাচের টুকরা। চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। সামান্থা দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আবার বিছানায় গিয়ে বসে।
নির্লিপ্ত থাকার কায়দাটা বোধহয় ও অবশেষে শিখে গিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।