আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্পূরক কোণ (গল্প)

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

‘ইচ্ছাকে’ আমি ‘মামা’ বলি, কারণ ইচ্ছা করার ক্ষেত্রে যেমন আমি সর্বোতভাবে স্বাধীন, মামার কাছে আবদার করার ক্ষেত্রেও স্বাধীনতাটা তেমনই। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে একটা ‘ইচ্ছামামা’কে কিছুতেই বাস্তবায়ন করতে পারছিনা, কিংবা বলা চলে, সাহসে কুলোচ্ছেনা। ইচ্ছাটাকে অবশ্য খুব উদ্ভট কিছু মনে হয়নি, খবই সাধারণ। বিজ্ঞানী আলেসেন্দ্রা ভোল্টা একবার এক পরীক্ষায় একটি ব্যাঙকে দড়িতে বেধে উলম্বভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, আমারও ইচ্ছা হয়েছে ব্যাঙের মত ঐভাবে ঝুলার; পা থাকবে উপরের দিকে, মাথা নিচে, এভাবে সারাদিন ঝুলবো; উদ্দেশ্য জীবনটাকে আয়নার প্রতিবিম্ব কল্পনা করে উল্টোভাবে বীক্ষণের চেষ্টা করা। কিন্তু একার পক্ষে এটা করা অসম্ভব, ২য় কোন ব্যক্তির সাহায্য লাগবেই, আর সমস্যাটা এখানেই, কেননা আমি নিশ্চিত- আমার এই সরল ‘ইচ্ছামামা’-টা সবার দৃষ্টিতে ‘গাজার প্রভাব’ হিসেবে আখ্যায়িত হবে।

তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ২দিন আগে পাপড়িকেই বললাম সাহায্য করার জন্য। সে বলেছে আজ আসবে; আমি সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি দড়ি নিয়ে। ঠিক ৯টা ৫৩ মিনিটে পাপড়ির ফোন এল। ফোনটা রিসিভ করে আমি চমকে গেলাম, কারণ এই কণ্ঠের সঙ্গে আমি যেন পরিচিত নই, আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নারীর কণ্ঠে কোন যন্ত্র অনর্গল কথা বলে যেতে লাগল- ‘আলভি, তুমি কি একটু নিচে নামতে পারবে?আমার রুমমেট সঞ্চিতা তোমার গেটে দাঁড়িয়ে আছে; ওর কাছে একটা চিঠি দিয়েছি, আমার না আসার কারণ তাতে লেখা আছে। চিঠিটা ভীষণ জরুরী, কারণ গতকাল রাতে জীবনের একটি চরম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই ভাবলাম তোমাকে সেটা জানানো দরকার।

তবে, চিঠিটা সাংকেতিক, পারলে মর্মোদ্ধার করে নিও তোমার সময়মত, যদিও আজকের পর এই চিঠিটা মূল্যহীন হয়ে যাবে। তুমি মর্মোদ্ধার করতে পারলেই কেবল আমাকে ফোন দিও, এর আগে ফোন দিলে যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি সেটা ঐ মুহূর্তেই বাস্তবায়ন করবো। so, be careful.’-আমি জবাব দেয়ার আগেই সে ফোন রেখে দিল; এখন তো ফোনও করা যাবেনা, কী সিদ্ধান্ত নিল সে? দ্রুত দৌড়ে নিচে গেটে চলে গেলাম। সেখানে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চেহারাটাও খেয়াল করতে পারছিনা উত্তেজনায়, মাথায় একটি প্রশ্নই ইলেকট্রনের মত ঘুরছে – কী সিদ্ধান্ত নিল, কেন নিল? স্নায়বিক চাপে মেয়েটিকে পাপড়ির গত কয়েকদিনের আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে গিয়ে তোতলামি জুড়ে দিলাম, তবুও তার কাছ থেকে যে তথ্য পেলাম তাতে আতঙ্কিত হবার মত কিছু নেই; তাহলে হঠাৎ কী ঘটল?ঝড়ের আগে প্রকৃতিতে গুমোট একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, পাপড়ির এই অতিস্বাভাবিক আচরণ কি ঝড়ের পূর্বাভাস?সময় খুবই সীমিত, সুতরাং রুমে ফিরেই চিঠিটা দেখতে হবে, এমন অস্থিরতায় মেয়েটিকে ভদ্রতাসূচক bye না বলেই দৌড় দিলাম, এতে তার কী প্রতিক্রিয়া হল আপাতত সেটিও ধর্তব্য নয়। সিড়ি ভেঙ্গে রুমে ফিরতে ফিরতে বেশ কয়েকবার চিঠিতে চোখ বুলালাম, পাঠোদ্ধার হলনা।

রুমে ফিরেও চেষ্টা করলাম, নাহ সেই একই ফলাফল, কিন্তু এর পাঠোদ্ধারের উপরই আমার করণীয় নির্ভর করছে, সুতরাং কিছুতেই হাল ছাড়া চলবেনা। নার্ভাসনেসের কারণে হয়ত পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারছিনা, এই ভেবে কফি বানাতে চলে গেলাম চিন্তাটা সাময়িকভাবে অন্যত্র স্থানান্তর করতে_ অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই পদ্ধতি বরাবরই আমার ক্ষেত্রে কার্যকরী। কফিতে মৃদু চুমুক দিতে দিতে আবার চিঠিটা খুললাম, এখন মস্তিষ্ক টাইটানিক সিনেমায় জ্যাক-রোজের সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যটির মত স্থির, এবার হযত চিঠিটা বুঝতে পারবো। প্রতিটি সংখ্যাকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণের জন্য আমি নিজে আলাদা কাগজে চিঠিটা হুবুহু লিখতে শুরু করলাম: 4, 8, 4, 2, 3, 4, 3, 1, 2, 7, 2, 5. 2, 2, 6, 1, 2, 7, 2, 5, 2, 6, 7. 8, 4, 3, 8, 5, 2, 2, 1, 4, 6, 2, 5. 2, 5, 3, 7, 2, 7, 4? 5, 1, 2, 5, 5, 4, 3, 1, 3, 7, 2, 5, 2, 5, 5, 7. 6, 7, 3, 6, 2, 2, 3, 3. 5. নিজেকে হঠাৎ নাগরদোলার আরোহী মনে হলেও, উপরের 4 আর সবচেয়ে নিচে 5 দেখে চিঠির সংকেতের ধরন সম্পর্কে ধারণা পেলাম। 4=Alvi, 5=Papri, অর্থাৎ প্রতিটি সংখ্যা একেকটি ইংরেজি শব্দ নির্দেশ করছে, আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, সংখ্যাগুলোর মাঝে কমা ব্যবহার করা হলেও একটি পর্যায়ে ফুলস্টপ আছে এবং এর পরের সংখ্যাটি ফুলস্টপ থেকে বেশ দূরবর্তী, এ থেকে ধারণা করতে পারি ফুলস্টপ পর্যন্ত একটি পূর্ণবাক্য।

কিন্তু ইংরেজিতে শব্দ আছে কয়েক হাজার, আমি সাকুল্যে জানি হাজারখানেক, এর মধ্যে থেকে কোন্ শব্দগুলো সে ব্যবহার করেছে, তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে এইভাবে অক্ষর গুণে কি শব্দ হিসেব করে কেউ? আমিতো আজই প্রথম খেয়াল করলাম, ইংরেজিতে আলভি লিখতে ৪টি বর্ণ লাগে, তাও এটা খেয়াল করেছি সাধারণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে, কারণ চিঠির শুরুতে প্রাপাকের-আর শেষে প্রেরকের নাম লেখাটা প্রচলিত রীতি। হায়, বিজ্ঞানী হাবাল স্পেনসার-স্টিফেন হকিং!মহাবিশ্ব-মহাশূন্যের জটিল সব তত্ত্ব জানো, অথচ সাধারণ এক মানবীর মনের সম্প্রসারণ-সংকোচনের ব্যাখ্যা জানোনা! প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান, চিঠির বক্তব্য আজ রাতের মধ্যেই খুঁজে পেতে হবে, পাপড়ির ‘আজকের পর এই চিঠিটা মূল্যহীন হয়ে যাবে’-কথাটির মধ্যে আগামীকাল ওর কোন ভয়ানক পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে, কিন্তু আমি কী করবো?এক্ষেত্রে, আমার বিকল্প পন্থাগুলো হয়ত কাজে লাগবে, এমন ভাবনা থেকেই ফাহিম ভাইকে ফোন করলাম- ‘হ্যালো ফাহিম ভাই, আপনি এক্ষুণি আমার ফ্ল্যাটে আসেন। দাবা খেলবো। প্লিজ ভাইয়া, কোন প্রশ্ন করবেননা বা দেরি করবেননা’। ফাহিম ভাই ভার্সিটিতে আমার ৩বছরের সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু দাবার সূত্রে বন্ধু হয়ে গেছেন অনেক আগেই।

আমাদের মধ্যে খেলা নিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা আছে :প্রতিটি ম্যাচের ফলাফল,বিশেষ বিশেষ চাল এবং ম্যাচ পরবর্তী বিশ্লেষণ আমরা লিখে রাখি, এভাবেই গত ২বছরে মোট ২৫৭টি ম্যাচ খেলেছি, ফলাফল ১০০/১০৩, বাকিগুলো ড্র। আমরা খেলতে বসলে সাধারণত মুখে কোন কথা বলিনা, পৃথিবীর সবকিছু ভুলে শুধু চাল দেখি, আর কাউন্টার চাল ভাবি_ এই ধরনের পরিবেশটাই ভীষণভাবে জরুরী শব্দরহস্য ভেদ করতে। কিন্তু আমার এখানে পৌছতে উনার একঘণ্টার মত লাগবে, ততক্ষণ অন্য উপায়ে সমাধানের চেষ্টা চালানো যেতে পারে। অবস্থার আপেক্ষিকতা বিবেচনায় ‘21’মুভিটাকে যথার্থ মনে হল, বিশেষ করে মুভিতে নায়কের জুয়া খেলায় জেতার জন্য প্রযুক্ত স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলটাতে কোন সংকেত পাওয়া যেতে পারে, এমন সম্ভাবনায় বারবার মুভির জুয়া খেলার অংশটাই দেখতে থাকলাম শুধু ; কিভাবে সে তাসগুলোকে সনাক্ত করে পাশে বসা সতীর্থের ইশারায়, এই দৃশ্যটাতে স্থির হয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ; এবার সংখ্যাগুলোতে নজর দিতেই একটা সম্ভাব্য উপায় পেলাম মনে হয় : চিঠিতে ব্যবহৃত সবগুলো 1, 2, 3 কে ক্রসচিহ্ন দিলাম। 1 এ মাত্র ২টি অর্থবোধক শব্দ হতে পারে-I এবংa; 2 এর পরিসর বেশ বড়, তবুও সচরাচর লেখাতে ব্যবহৃত শব্দ পাওয়া যায়- am, is, in, if, it, on, at, an, be, by, up, us, to, me,we, do, go ,no, so প্রভৃতি।

3 এর পরিসর এভাবে সন্ধান করা প্রায় অসম্ভব, তারপরও যে কয়েকটি শব্দ এই চিঠিতে থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে তার তালিকা করলে you,and, the, set, get, are, was, how, why, but, not, has, had প্রভৃতি আসবেই। কিন্তু 4 এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র love আর hate এর ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে পারছি। বাকি শব্দগুলো কিভাবে বুঝবো?-তার জন্য অন্য উপায় ভাবতে হবে। ফাহিম ভাই চলে এসেছেন, দাবাও চলছে পুরোদমে। তাকে এভাবে হুট করে ডাকার কারণ বেশ কয়েকবার জিজ্ঞস করলেও ‘প্লিজ ফাহিম ভাই, আজ কোন প্রশ্ন করবেননা, কাল সবকিছু জানাবো’-বলে আমি প্রতিবারই এড়িয়ে গেছি।

আজ আমাদের খেলাটা হবে কয়েকটি শর্তারোপিত হয়ে, যার সবগলোই আমার পছন্দমাফিক নির্ধারিত হয়েছে, ফাহিম ভাইও আজকের দিনটির স্বার্থে সেগুলো মেনে নিয়েছেন_ আমার এমন আচরণ নাকি তাকে বেশ কৌতূহলী করে তুলেছে, তাই আমাকে শতভাগ সাহায্য করতে তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন। শর্ত হচ্ছে: আজ ন্যুনতম ৩০ চালের আগে উনি মন্ত্রী ব্যবহার করতে পারবেননা, ঘোড়া, হাতি আর সৈন্যদিয়ে খেলবেন পুরো ম্যাচ, পক্ষান্তরে আমি ৩০চাল পর্যন্ত সৈন্যর সঙ্গে ১টি করে হাতি-ঘোড়া ব্যবহার করবো, রাজাকে আক্রমণ করবোনা, সম্পূর্ণ রক্ষণাত্মক খেলবো। দাবা খেলায় এই ঘোড়ার চালটাকেই আমার সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে লাগে, ফাহিম ভাইয়ের হাত ঘোড়ার কাছে গেলেই আমি আশেপাশের সবগুলো ঘর বিপদমুক্ত আছে কিনা পরীক্ষা করি, আর হাতির কৌণিক চালতো বুঝিইনা। তাই, আজ যদি ফাহিম ভাই শুধু এ দুটি ঘুটি ব্যবহার করেই খেলতে থাকেন, আমার ভাবনার ধরনও হবে সেরকমই। অবশ্য, আমি খেলার সময় চিঠিটা হাতে নিয়েই বসেছি; শুরুতে ফাহিম ভাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার সেদিকে তাকালেও আমার না-সূচক মাথা নাড়ানো দেখে পুরোপুরি খেলায় মনোনিবেশ করেছেন এখন।

ঘোড়ার প্রতিটি চাল আমাকে উদ্দীপ্ত করছে, ওদিকে ফাহিম ভাইও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘোড়া-ই খেলছেন। এই ঘোড়ার চাল হিসেব করতে করতেই পাপড়ির কথা বলার ধরন নিয়ে ভাবছি। ‘ও’ আসলে কিভাবে কথা বলে, কোন্ শব্দগুলো বেশি ব্যবহার করে, কোনগুলোর প্রতি সুগ্ধতা আছে, অনেকটা একজন মানুষকে আদ্যন্ত ‘স্ক্যান’ করার মত ব্যাপার। ‘হয়ত, ধরা যাক’, এই দুটি শব্দ সে বলবেই কথা প্রসঙ্গে। ‘ধরো, তুমি অনেক বড় কিছু করে ফেললে একদিন’ অথবা ‘হয়ত আমার ভাবনাকে তুমি কোনদিনই স্পর্শ করতে পারবেনা’..এগুলো তার চিরচর্চিত বাক্য, সেই সঙ্গে তার অধিকাংশ বাক্যই নেতিবাচক।

‘আমি কাজটি করতে অপারগ’ এ ধরনের বাক্যের চেয়ে ‘আমি কাজটি করতে পারিনা’ ধর্মী বাক্যই তার মুখে প্রাধান্য পায়। এ দিক থেকে, এই চিঠিতে ‘no, not’ অবশ্যই আছে, আর প্রথম শব্দটি অবধারিতভাবেই suppose, অথবা perhaps হবে। কিন্তু দুটিই তো ৭ অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ!সেক্ষেত্রে ‘অন্য কী হতে পারে’-এমন দুর্ভাবনা স্থায়ী হওয়ার আগেই সমাধান হয়ে এল ‘probably’ শব্দটি। এইবার বোধহয় দাবা খেলাটা সার্থক হল! ফাহিম ভাই ঘোড়া রেখে এখন দস্তুরমত হাতি দিয়ে খেলা শুরু করেছেন, ওদিকে খেলার ফাকে আমার মস্তিষ্ক এখনো পাপড়ির গতিবিধি পর্যালোচনাতেই ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। ওর প্রতিদিনকার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘unforgiven’শব্দটি থাকবেই, অন্য শব্দ যতই পরিবর্তিত হোক না কেন।

এছাড়া ওর খুবই পছন্দের একটা উক্তি আছে-‘পারলে আমায় ক্ষমা করো, নয়তো ভুলে যেও”, তাই forgive-forget এর একটা সম্মিলন থাকার সম্ভাবনাটা রয়েই যাচ্ছে, সেকারণে 6,7 গুলোর পাশে তারকাচিহ্ন দিয়ে রাখলাম। দুইটা বেজে গেছে, আমাদের ২টা ম্যাচ হয়ে গেলেও আর কোন সংকেত খেলা থেকে পাইনি বিধায় ৩য় ম্যাচটি মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছি। উভয়ের সম্মতিতে এগুলো প্রীতিম্যাচ হিসেবে গণ্য হবে। কিছুক্ষণ আগে ফাহিম ভাই বাসায় ফিরে গেছেন, যাওয়ার আগে ‘লাঞ্চ করবে কখন?’ প্রশ্নটা করেই মুচকি হেসে বলে গেছেন-‘ওহো, আজ তো প্রশ্ন করা বারণ!’ এই কথাটা শুনে সারাদিনে প্রথমবারের মত হাসলাম। গত ২০মিনিট যাবৎ ঝিম বসে আছি চিঠিটা নিয়ে।

এখনো অনেক কিছু্‌ই অজানা। সময় মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমার ভিলেনের চেয়েও নির্দয় হয়ে যায় বোধহয়, নইলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ২লাইনের এক চিঠির পেছনে সমস্ত দিনটা অপচয় করছি, সেজন্য সে যে একটু দয়াপরবশ হয়ে ধীরে চলবে, তেমন কোন লক্ষণই দেখতে পাচ্ছিনা। যাইহোক, আবার মুভি দেখাকেই উপায় হিসেবে ধরতে হচ্ছে। ‘Goodwill Hunting’ মুভিটা এই দিয়ে ৫ বার দেখছি। গণিতবিদ রামানুজনের চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত এই মুভিটা অন্য সময় যে কারণেই টানুক, এখন টানছে এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের ২টি বৈশিষ্ট্যের কারণে; প্রথমত একটি ঘটনা কোন্ বইয়ের কতপৃষ্ঠায় আছে তা সে বলতে পারে, ২য়ত গণিত সমাধান করে পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানোই তার কাছে বেশি মূল্যবান।

মুভি দেখছি, আর চিঠিতে চোখ বুলাচ্ছি, এমন করতে করতে আরও একটি ভাবনা উকি দিল মনে : পাপড়ির শব্দভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ নয বলেই জানি, সেক্ষেত্রে খুব অপরিচিত শব্দ সে ব্যবহার করবেনা। চিঠিতেও 7,8 এর মোট সংখ্যা অন্যান্যদের তুলনায় বেশ কম। তাছাড়া verb এর শেষে ‘ing’ যোগ করার কারণে ছোট্ট শব্দেরও আকার বৃদ্ধি ঘটে, এমতাবস্থায় 6,7,8 এর verb বা সমধর্মী শব্দ হবার সম্ভাবনা বেশি। সংকেতপ্রাপ্তির মধ্যে এগুলোকেও অন্তর্ভূক্ত করে নিই আপাতত। ৪টা বেজে গেলেও কাজ কতদূর এগুলো বুঝে উঠার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজায় ছুটতে হল।

সম্ভবত রিয়াদ এসেছে; প্রায় বিকেলেই ‘ও’ এভাবে চলে আসে। এরপর আমি ওকে গীটারের কিছু রিদম শোনাই, ‘ও’ সেই রিদমের আলোকে গান লিখে, আমরা রাতভর গান নিয়ে মেতে থাকি। প্রথমে ভাবলাম, আজ গান করবোনা, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল গানটাও একটা উপায় হতে পারে সমাধানের। টানা ৩০মিনিটের মত গিটার বাজাচ্ছি, একটার পর একটা কর্ড পরিবর্তন করছি, তবুও আমার ভাবনা আমার গিটার বাদনে প্রভাব ফেলেছে বোধহয়, নয়তো রিয়াদ কেন জিজ্ঞেস করবে- ‘কিরে, আজতো সব অপরিচিত কর্ড দেখছি। আজকে ভিন্নধাচের লিরিক লিখতে হবে রে...’ রিয়াদের লিরিক লেখা শেষ, আমি এখন তাতে সুর দেয়ার চেষ্টা করছি; লিরিকের শেষাংশে এসে চোখ বিস্ফোরিত হবার মত দশা আমার: ভালোবাসা ‘ভ’-তে লীন অনুভূতি “অ’-তে নেই আমি তাই বর্ণহীন ‘ব’-তে বাঁচি ১৪দিন বাকি দিনগুলো বাঁচিনা বাকি দিন আর বাঁচিনা।

এটা সুর করতে গিয়েই গত সপ্তাহে পাপড়ির বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘জানো আলভি, ইদানীং তোমাকে মানুষের ছায়া হয়। শুধু তোমাকে নয়, সবাইকেই তা-ই মনে হয়। এই ছায়ার ত্রিকোণমিতি-পরিমিতি আর ভাল লাগছেনা’। ‘রিয়াদ তুই কিছুক্ষণ মুভি দ্যাখ, আমি একটু ভেতর থেকে আসছি’ -এই বলে আমি চিঠিটা নিয়ে পড়ার রুমে চলে আসলাম। আগের অনুমানগুলোর সঙ্গে পাপড়ির গতসপ্তাহের ঐ কথাটি মিলিয়ে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে ক্রমাগত কাটাছেড়া চলল খাতাজুড়ে।

অবশেষে যে সমাধানটি পেলাম তাতে আমার শরীরের তাপমাত্রা -২৭৩ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে গেল মুহূর্তেই; পাপড়ি এমন সিদ্ধান্ত কিভাবে নিল? সন্ধ্যা সাতটা। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কিভাবে পাপড়ির হলের সামনে এসে পড়েচি খেয়াল নেই, আসার সময রিয়াদ কী করছিল তা-ও ভুলে গেছি। পৌছামাত্র পাপড়িকে ফোন করি, আর ‘ও’নিচে নেমে আসে। গেস্টরুম কথা বলার জন্য মোটেই কোন আদর্শ জায়গা নয়, তাই পাশাপাশি নিঃশব্দে বেশ কিছুটা পথ হেটে আমরা একটি ফাস্টফুডের দোকানে বসেছি। ‘কী ব্যাপার, তোমাকে এমন মৃত মানুষের মত দেখাচ্ছে কেন?’-পাপড়ি-ই নীরবতা ভঙ্গ করলো।

আমি কিছু না বলে চিঠিটা সশব্দে পড়তে শুরু করলাম: Alvi, Probably this is the last day I am passing on earth. To be honest, I am feeling no charm in living anymore. Everyone, even you yourself, seems to be a fake shadow of human. So, what’s the essence of wasting soul? Hence, I am gonna start for a new journey, in quest of other world, tonight. Please, forgive and forget me, if you can. Papri চিঠি শেষ হলে বললাম, ‘এই চিঠিটাতো তুমিই লিখেছো , তাইনা?’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাপড়ির জবাবের প্রতীক্ষা করছি, অথচ তার হাসি যেন থামতেই চাইছেনা। আমরা যে দোকানে বসে আছি, সম্ভবত এটা তার মনে পড়ল, তাই কপট গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল, “আচ্ছা, তুমি ঠিক কী কারণে এটাকে ইংরেজি চিঠি ভাবলে?তুমি জানোনা আমার ইংরেজি জ্ঞানের দৌড় কতদূর!আর, এধরনের ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেব, আমার কী জীবনের প্রতি ‘এলার্জি’ আছে কোন?অহেতুক সারাটা দিন নষ্ট করলে ভুল ভাবনায়’। পাপড়ির স্বরতন্ত্রীতে হঠাৎ প্রণয়স্বর খেলতে শুরু করল যেন-‘আচ্ছা, আমি যে তোমাকে ‘মেঘদুত’ ডাকি এটা মনে আছে? ভাবলেশহীনভাবেই বললাম-“হ্যা আছে, আর আমি তোমাকে ডাকি ‘বৃষ্টিফুল’”। ‘বাহ, এটাইতো চাইছিলাম, এবার তাহলে আসল চিঠিটা শোনো”- সে পড়তে শুরু করলো: মেঘদুত, বিষাদগ্রস্ততার পরিসীমা নেই জেনেও অদ্ভুত খেয়ালে, এক গূঢ় পরম্পরাতেই আমি ঘূর্ণায়মান। তবে, আমি কনফিডেন্ট যে, তুমি অসমান্তরাল নও, উপরন্তু সব সংকীর্ণতার ব্যবচ্ছেদকারী।

আসংলগ্নতার সংজ্ঞা নিয়েও সংশয়াচ্ছন্ন অবস্থান, তবে তুমি যে সর্বাংশে বাতিকমুক্ত তাতে আনন্দিত। সব বৈপরীত্যই হয়ত অযাচিতভাবেই প্রেমে স্থানান্তরিত; know? প্রতিনিয়ত কে যেন অনুভবের অভ্যন্তরে আমায় এক আপাত অকিঞ্চিৎকর গান পরিবেশন করে অবিশ্বাস্য সম্মোহনীতায়। রূপান্তরিত স্বপ্নভঙ্গে, কিংবা কল্পনাতে শুধু তুমি-তুমিই আমার। বৃষ্টিফুল আমি তরঙ্গবেগে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে সাংকেতিক চিঠির সঙ্গে মেলাতে লাগলাম _ পাপড়ির হাসির ২য় পর্ব শুরু হল তাতে। একটু ভালমত খেয়াল করেই অসঙ্গতিটা ধরতে পারলাম,কিন্তু মূর্তির মত প্রতিক্রিয়াশূন্যতায় বলে চললাম-‘মূল চিঠিতে প্রশ্নবোধক চিহ্নের পরের বাক্যটাতে একটা 5 ছিল, এটায় নেই।

ঐটাতে কোন সেমিকোলন চিহ্ন না থাকলেও এই চিঠিতে তার ব্যবহার দেখলাম। আর, সবচেয়ে বড় কথা হল, এই চিঠির বাক্যগুলো অসংলগ্ন_ পড়েই বোঝা যায় অক্ষর গুণে গুণে শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে অর্থতৈরির ব্যর্থ প্রচেষ্টা’। এবার বোধহয় পাপড়ি একটু ঘাবড়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে স্মিত হাসি দিল। -‘আরে, এটা তো তোমার সঙ্গে স্রেফ মজা করেছি। তোমার ব্যাঙ হওয়ার খায়েশ জেগেছিল না?তাই ভাবলাম তোমাকে সত্যিকারের ব্যাঙ বানাই।

সেজন্যই, ইচ্ছামতো কয়েকটা সংখ্যা লিখে তোমাকে পাঠিয়ে চিঠি বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম; পাছে তুমি সত্যিই চিঠি ভাব এমন আশঙ্কায় কয়েক বান্ধবী মিলে আজ সারাদিন অভিধান ঘেটে শব্দ বের করে সংখ্যার সাখে মিলিয়ে অর্থ তৈরি করেছি, কিন্তু শয়তান রিমিটা একটা সংখ্যা ভুল করেছে। হা হা হা....” আমি নিশ্চিত পাপড়ি মিথ্যা বলছে, কারণ আমি যখন ইংরেজি চিঠিটা পড়ছিলাম , তখন তার ঐ কৃত্রিম হাসির মাঝে আমি অপরাধবোধের প্রতিবিম্ব দেখেছি; সম্ভবত আমার সেই ‘ইচ্ছামামাটা’ আজ পরোক্ষভাবেই বাস্তবায়িত হল! বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ কলম বের করে ঐ চিঠিটার অপরপাশে লিখতে শুরু করলাম: প আ, ক, ভ, ম, ব, ই, ক। য, খ, র, ব, ক, ত, চ, দ। হ, ক, জ, ক, দ, ত, ক, য।

আ, অ, ভ, দ, য, এ, চ, প, ন; L, H, A, B. ভ, থ। আ লেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম; এরপর চিঠিটা পাপড়ির হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার চিঠির সত্য-মিথ্যা জানিনা, তবে আমার এই চিঠিটা ১০০% সত্যি, আগামীকাল দুপুরের মধ্যে এর সমাধান করতে পারলে ভালো, না পারলে কী হবে জানিনা’। এ কথার প্রেক্ষিতেও পাপড়ি হাসল। ওর এই হাসিটার অর্থ আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল........ এই সিরিজের আগের গল্পটা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।