একজন ইউনুস খান বেঁচে থাকতে চান গণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং উদ্যেগ গ্রহণের মাঝে।
তিনি ছিলেন সাক্ষী, সাক্ষী এক বেদনার ইতিহাসের, কষ্টের ইতিহাসের৷ আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর একটি প্রশ্নের, "আমগো যদি ছাওয়াল থাকত, ভাত যদি নাও দিত, মা কইয়া ডাক তো দিত, না?
তিনি হাসনা বানু, মনে-প্রাণে একজন মা, শুধুই মা, যদিও সমাজের কাছে তাঁর পরিচয় ভিন্ন।
কিছুদিন আগেই গুনলাম তার মৃত্যু সংবাদটি। মনে পড়ে গেল তার একটি কথা "রাজাকার-আলবদরদের বিচার আমরা চাই, এই আমাগোর শেষ কথা"। তাঁর যাবার আগে তো তাঁর শেষ আশা পূরণ করা হলো না।
বলছি তাঁদের কথা, যাঁরা আমাদের কাছে পরিচিত বীরাঙ্গনা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল ইতিহাসের এক অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই নাম বীরাঙ্গনা। আমরা খুব সচেতনভাবে এই অধ্যায়টি লুকিয়ে রাখার, ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের অনেকের কাছেই যেন বীরাঙ্গনা শব্দটি লজ্জার।
হাসনা বানু পাকিস্থানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে ভীত হয়ে গ্রামের আর সকলের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।
গ্রামের রাজাকার আব্দুল কুদ্দুস পাকিস্থানি হানাদারদের নিয়ে তাঁদের ঘেরাও করে, তাঁর মা পাকসেনাদের হাতে-পায়ে ধরে তাঁকে ছেড়ে দিতে বললে তাঁর মাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় এবং তাঁকে ধর্ষণ করে।
এরপর তাঁর স্বামী আর তাঁকে গ্রহণ করেননি। স্বাধীনতার পর হাসনা বানুকে সমাজপরিত্যাক্তা হয়ে জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল, তাঁর মা তাঁকে কলাপাতায় মুড়ে আঁচলের নিচে লুকিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন। পাকিস্থানি বাহিনীর নির্যাতনের সময় তিনি ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্বা, নির্যাতনের ফলে তাঁর সেই সন্তানটি বাঁচেনি।
এরকম আরও বীরাঙ্গনা আছে আমাদের মাঝে।
সূর্য বেগম, বাহাতন বেগম, আয়েশা খাতুন, নূরজাহান বেগম, রাহেলা, আসিয়া বেগম। বর্তমানে বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করছেন। এরকম নাম না জানা আরও অনেকেই রয়েছে আমাদের মাঝে। আমাদের সভ্য সমাজে ঠাঁই দেয়নি এই নষ্টা মেয়েদের, অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন যদ্ধে বিজয় অর্জন করে ফিরেছেন তখন এই সমাজই তাঁকে বীরের মর্যাদায় গ্রহণ করেছে। মার্চ আর ডিসেম্বরে কিছু সেমিনার করে, বিভিন্ন চ্যানেলে প্রগ্রাম করে তাঁদের নিয়ে কিছু চোখের পানি আমরা ফেলি, আর মনে করি এভাবেই পালন করা হয়ে যায় তাঁদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব।
একজন বীরাঙ্গনা আকাঙ্কা করে আছেন কবে এ প্রজন্মের একজন তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা, আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। (নীলিমা ইব্রাহিম, আমি বীরাঙ্গনা বলছি, পৃষ্টা : ৭৯)।
এই জায়গাটিতেই আমাদের ব্যার্থতা। আমরা তাঁদের করুণা করি, সহানুভূতি জানাই, তাঁদের নিয়ে গভেষণা করি, কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দেয় না।
হাসনা বানুর মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্টীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়নি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তাঁর দাফন-কাফনে যোগ দেয়নি সমাজের অনেকে। খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন জাগে মনে, স্বাধীনতার এত বছর পরও কি তাঁদের কৄতকর্মের (!) প্রায়চ্চিত হয়নি? আমরা কতটা মানসিকভাবে অগ্রসর হয়েছি স্বাধীনতার পরবর্তী ৩৮ বছরে?
গর্ভাবস্থায় যে সন্তানকে হাসনা বানু স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, আমৃত্য সেই সন্তানের জন্য তাঁর মনে এক গভীর বেদনা বহন করে গেছেন তিনি।
আজ আমরা অনেকেই আড়ম্বরের সঙ্গে মা দিবস পালন করি, গানে গানে মায়ের বন্দনা করি, গায়ের চামড়ায় মায়ের জুতা তৈরি করে মায়ের ঋণ শোধ করার কথাও বলি, কিন্তু স্মরন করিনা তাঁকে, যিনি সমাজে নির্বাসিত অবস্থায় একটিবার 'মা' ডাক শোনার জন্য কান পেতে আছেন।
শহীদ মিনারে হাসনা বানু দাবি জানিয়েছিলেন যদ্ধপরাধীদের বিচার না হলে বীরাঙ্গনারা মরেও শান্তি পাবেন না। আমরা সপ্ন দেখি, এই দেশে একদিন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে, আনুষ্টানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া হবে সকল যদ্ধাহত নারীর কাছে, মাথা নত করে তাঁদের আমরা সম্মান জানাব। সেদিন হয়তো হাসনা বানুরা থাকবেন না, কিন্তু আমরা আমাদের অন্তর্ধন থেকে মুক্ত হব।
হাসনা বানু সহ এই যদ্ধাহত নারীদের উদ্দেশ্যে বলি, মা, তোমরা আমাদের সকল অক্ষমতাকে তোমাদের মহত্ব দ্বারা ক্ষমা করো।
ক্ষমা করো || ক্ষমা করো হে প্রভু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।