আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শার্লক হোমস রাজনীতিবিদগণ ও কয়েকটি বিলম্বিত নোট

গেরিলা কথাবার্তা

পঁচিশ তারিখ সকালে ঘুম ভাঙল এক বন্ধুর টেলিফোনে। সময় সম্ভবত আট বা নটা হবে। আগেরদিন এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর ঢাকা-চট্টগ্রাম ভ্রমণ শেষে শরীর নুয়ে পড়ছিল, তাই ঘুমে বুঁদ ছিলাম বেলা ফরসা হওয়া পর্যন্ত। চোখ বন্ধ করেই শুনলাম, বন্ধু বলছে, সামইনে কীসব বিডিআর বিদ্রোহের কথা আসছে, দেখুনতো। তারপরে মুখ হাত ধুয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো বসে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে, আনমনে হোঁচট খেতে খেতে, সেই থেকে দেখছি দিনমান।

পড়ছি। ভাবছি। কাজটি আজ পর্যন্ত শেষ হয় নাই। আপাতত শেষ হবে না। মুহূর্তগুলো প্রতিদিন নতুনতরো অর্থ তৈরী করছে।

এর মধ্যেই ব্লগে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের লেখায় প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ কথা এসেছে। তাই এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার বলা এবং তাড়াহুরো করে লিখতে সতর্ক থেকেছি, এমনকি মন্তব্য করা থেকেও বিরত থেকেছি। এই সতর্কতা জারি রেখেই বিডিআর ঘটনার সাম্প্রতিক ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কয়েকটি জরুরী নোট তুলে রাখতে চাই। ''সত্য'' হেজিমনি প্রথম কথা হলো, আমরা সত্য জানছি না। এই ঘটনার মধ্যে প্রথম দুদিন আমরা ''সত্য'' জেনেছি মিডিয়ার কাছ থেকে, তারপর থেকে আমাদেরকে ''সত্য'' জানানোর দায়িত্ব নিয়েছে সেনাবাহিনী।

দুটোই আমাদের এ বিষয়ক ভাবনায় হেজিমনি এবং অনিবার্যভাবেই বিভ্রান্তি তৈরী করেছে। সবশেষে, জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রীমহোদয়গণ শার্লক হোমস সেজে বিরোধী দলীয় নেত্রীর দিকে আঙ্গুল তুলে ''সত্যে''র আরো একটি বিভ্রান্তি ছড়ালেন। এইসব ঘটনা অবশ্যই প্রকৃত বিষয়কে আড়াল করবে। এই ছদ্ম ''সত্য''গুলোর আড়ালে প্রকৃত ''সত্য'' আর কোনদিনই উদঘাটিত না হওয়ার সম্ভাবনা মিলে। এমনকি রাষ্ট্রের নিজের বিপদ সম্পর্কে অসচেতনতার কথাও বোঝা যায়।

তারা সচেতন থাকুন বা না থাকুন, এই ভুল পথ ও পদ্ধতি এবং এই মুহূর্তটির গুরুত্ব বুঝতে যে কোন রকম ব্যর্থতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। তাই, আপাতত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব থাক। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আড়ালে আমরা সত্যকে হারাতে চাই না। এটি কোনমতেই দলীয় সমস্যা নয় এর দায় কার? আমরা মনে করি, এর দায় অবশ্যই বর্তমান একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের আওয়ামীলীগ সরকারের। কারণ, তারা এখন রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছে, এবং এটি কোনমতেই দলীয় সমস্যা নয়।

যখন সময়টি এমন যে, সরকারের জন্য দরকার জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করে সকল দলমত নির্বিশেষে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা, তখন প্রধানমন্ত্রী যদি বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করাকে মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দেওয়ার সাথে তুলনা করে মশকরা করেন, এটি সত্যিই এলার্মিং। এমন কি ভারতীয় পত্রিকা যখন আমাদেরকে খবর দেয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে অনিচ্ছুক হলেও, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সাথে কথা বলেছেন এবং পরামর্শ চেয়েছেন, আমরা না ভেবে পারি না। যদি আমরা সত্যিই বিশ্বাস করে থাকি, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশেবে এখনো আমাদের পরিচয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, এবং এর নিরাপত্তা বিষয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিশেবে প্রধানমন্ত্রীর দায় আছে। এই মুহূর্তে শার্লক হোমস হবার কাজ নয় বিডিআর অসন্তোষ এবং সেটিকে পুঁজি করে যে গণহত্যা হয়েছে, তার সুষ্ঠু দলনিরপেক্ষ তদন্ত দরকার অবশ্যই, কিন্তু তার চেয়েও যেটি জরুরী সেটি হল এর মন্দ ফলাফলকে রুখে দেওয়া, যেটি এই গণহত্যা সম্পাদনকারীদের উদ্দেশ্য ছিল। মনে রাখতে হবে, এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা খুব সফলভাবেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আর বিডিআরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে।

সেনাবাহিনী, সরকার আর বিডিআর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের চরম অবিশ্বাস রচনা করতে পেরেছে। সেনাবাহিনী এখন ''অপারেশন রিবেল হান্ট'' চালাচ্ছে বিডিআরের বিরুদ্ধে। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বিডিআরকে গণহত্যাকারী হিশেবে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া গেছে। এইভাবে, বিডিআরের নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যু এবং একইসাথে সেনাবাহিনীকেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধে ব্যস্ত রেখে সেই কাজে ব্যবহার করতে প্রায় সফল হতে চলেছে তারা। এটি খুব নাজুক পরিস্থিতি একটি দেশের জন্য।

তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, এর মধ্যে সংযোগ রচনা করা এবং এর ভীত মজবুত করাই এখনকার প্রধান কাজ। যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রু তাদের উদ্দেশ্যটাই যদি সম্পাদন করি সরকার সেনাবাহিনী আর বিরোধী দল মিলে- তাইলে আমাদের কী করার আছে? বিডিআরের নাম পরিবর্তন: আমরা ভেবে দেখছি কি? এক জেনারেল আভাস দিয়েছেন, বিডিআরের নাম পরিবর্তন করার কথা ভাবা হচ্ছে। জেনারেলদের মনে এ প্রশ্নটি দুই কারণে আসতে পারে। এক: পঁচিশ তারিখের ঘটনার কারণে বিডিআর নামশুদ্ধ অপবিত্র হয়ে গেছে, এখন এই বাহিনীটারে পবিত্র করা দরকার। দুই: সেনাবাহিনীর প্রতি চোখ তোলার কারণে বিডিআরের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহা।

প্রথম প্রশ্নের জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমরা যদি বলি, বাংলাদেশের দুই দুইজন প্রেসিডেন্ট হত্যার জন্য দায়ী এবং এগার একের ক্যু থেকে শুরু করে বহুবিধ ক্যুর জনক যে সেনাবাহিনী, তাদের পবিত্রতা এবং পাপ মোছনের তরিকাও কী স্রেফ নাম পরিবর্তন? জেনারেল মহোদয় কী জবাব দেবেন। কখনোতো তাদের নাম পরিবর্তন করার কথা আমরা কাউকে বলতে শুনি নাই। দ্বিতীয়: প্রতিশোধের স্পৃহা থেকে যে কোন সিদ্ধান্ততো অবিবেচনাপ্রসূত এবং হটকারীই হবে, সেটি আশা করি কারো না বুঝার কথা নয়। অপারেশন রিবেল হান্ট: তৎক্ষনাৎ শাস্তি বা ক্রসফায়ার নয়, ন্যায়বিচার এবং সুষ্ঠূ তদন্তের প্রতি বিশ্বস্থ থাকা চাই আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা প্রচুর কথা বলেছি, সে বিষয়ে বিস্তারিত এখানে নয়। শুধু এই অপারেশন রিবেল হান্ট বিষয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের কারণেই শুধু নয়, প্রতিষ্ঠান হিশেবে সেনাবাহিনীর প্রতিশোধস্পৃহার কারণেও এখানে বিনা বিচারে তৎক্ষণাৎ শাস্তি, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।

এটি বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো নাজুক, পাজলড এবং ধারাবাহিক অন্যায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করবে। এমনকি এই ঘটনা সব পক্ষের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জারি রাখবে এবং সুষ্ঠূ তদন্তের প্রতি সেনাবাহিনীর অবিশ্বস্থতার কথাও প্রমাণ করবে। পঁচিশ তারিখের ঘটনা যারাই ঘটিয়ে থাকুক, বিনা বিচারে তৎক্ষনাৎ শাস্তি বা ক্রসফায়ার হলে এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। সর্বোপরি, সব পক্ষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা একটা জরুরী কাজ বটে। মনে রাখতে হবে, সীমান্ত প্রহরীরা যাতে মনোবল না হারায়, তাদের প্রতি কোন অন্যায় অবিচার যাতে না ঘটে।

কারণ এরাই রাত জেগে আমাদের সীমান্ত পাহারা দেয়, বাংলাদেশ টেরিটোরির সীমান্তে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে। পুনশ্চ: এফবিআই জাতীয় সংসদ থেকে আমরা জেনেছিলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই পৃথিবীর ধূরন্ধর দেশসমূহের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এই বিডিআর ঘটনার তদন্ত করতে। সর্বশেষ এইমাত্র টিভি নিউজ দেখলাম, এফবিআই এই ঘটনার তদন্ত করবে, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে। আমরা এটিকে শংকার দৃষ্টিতে দেখছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.