সাল ১৯৮২। বেলগোরাড শহরে এক তীব্র শীতের সন্ধ্যা। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্র ফিরোজ খুব ক্ষেপে আছে। ‘ফিরোজ,তুমি কি সত্যিই চলে যাবে?”,আলেক্সি বিশ্বাস করতে পারছে না ওর প্রিয় বাংলাদেশী বন্ধুটির কথা।
“আলেক্সি,এদেশে এসে আমি তোমার মতো বন্ধু পেয়েছি।
আমার দিন খারাপ কাটছিল না। কিন্তু আজকের ঘটনার পর আর থাকা সম্ভব নয়। “,বলে নিজের মনে ব্যাগ গোছাতে থাকে ফিরোজ। উচ্চমাধ্যমিকে মানবিকে স্ট্যান্ড করা ফিরোজ পড়তে এসেছিল মনোবিজ্ঞান। বাংলাদেশে তা তখনো মানবিকের বিষয়।
কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই তা পড়ানো হচ্ছে বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার ব্যতিক্রম নয়।
“আরে তুমি কি আজকেই চলে যাবে নাকি?এখনই ব্যাগ গোছাচ্ছো কেন?”,আলেক্সির চোখে ভরা বিস্ময়।
“আর এক সপ্তাহ বড়জোর। “,বলে ফিরোজ।
আলেক্সি বুঝতে পারে ফিরোজকে ঘাটানো আর ঠিক হবে না।
ফিরোজ গত কয়েকদিন ক্লাস করতে গিয়ে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। বিজ্ঞানের বিষয় বলে পদার্থবিদ্যা,রসায়ন,গণিত এসব বিষয়ও পড়তে হবে তাকে। কিন্তু তার পক্ষে তা সম্ভব নয়। নিরীহ এক ছাত্রের কথা কে শোনে!কে বোঝে!ডিনের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে রুশি ডিন ফিরোজকে শেয়াল-কুকুর জ্ঞান করেছে।
কোনো পরামর্শ তো দূরে থাক!গরিব দেশের ছাত্র অভিহিত করে ফিরে যেতে বলেছে যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে। মনে মনে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছে ফিরোজ।
পাঁচদিন পরের ঘটনা। এরোফ্লত বিমানে চলে যাবে ফিরোজ। আলেক্সির সাথে শেষ কিছু কথা বিনিময় চলছে।
“বাংলাদেশে আমার এক চাচা আমাকে এদেশে আসতে নিষেধ করেছিল। “,ফিরোজ বলে চলে আলেক্সির চোখে চোখ রেখে।
“কেন?”
“উনি বলেছিলেন,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিনটিতেও তোমাদের মানুষগুলোর মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব-সহমর্মিতা ছিল তা এখন আর নেই। চলে গ্যাছে খুব দ্রুতই। “
“এ কি তবে পেপসি খাওয়ার ফল?”,আলেক্সি মজা করে।
“এখানে আসার পর তোমাদের পার্টিরই ছেলেপেলে আমার কাছে পোশাক খুঁজেছে। কালোবাজারে চড়া দামে বেচবে বলে। আমার পোশাকগুলো তেমন আকর্ষণীয় না আর আমার বেচারও কোনো আগ্রহ ছিল না। “
ফিরোজের কথায় সরলমনে হাসি দেয় আলেক্সি।
“কষ্ট করে রুশ ভাষা শিখেছিলে।
এখন তোমার জীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেল। “,আফসোস করে আলেক্সি।
“সমস্যা নেই। বাংলাদেশে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। “
“আমাকে তোমার বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ করবে না?”
ফিরোজ জড়িয়ে ধরে আলেক্সিকে,”অবশ্যই বন্ধু।
বাংলাদেশী আতিথেয়তায় তুমি মুগ্ধ হবে তা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। “
"পৃথিবীর সব সভ্যতাতেই ভালো-খারাপ উভয়প্রকার মানুষ থাকে ফিরোজ। "
আলেক্সি জড়িয়ে থাকে ফিরোজকে।
“আমার কিপ্টে বাবা নিজের জমানো টাকা থেকে ৫৬০০ টাকা তুলে আমাকে দিয়েছিলেন। এখন দেশে ফিরলে ওই টাকার শোকবাণী শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যাব।
“,অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ফিরোজ।
হাসে আলেক্সিও। চোখে চিকচিক করতে থাকে অশ্রু। টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে একটি ছবি।
“আমার বাবা আর আমি।
তুমি তো জানোই বাবা এয়ারফোর্সে ছিলেন। এক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। “
“হুম!তোমাকে তো দারুণ সুদর্শন লাগছে। “
“আমার বাবাও কম কীসের!”
ছবিতে দুই প্রজন্মের দুই রুশি। পিছনের জঙ্গি বিমানে জ্বলজ্বল করছে অনেক আত্মত্যাগের ফসল লাল নক্ষত্র।
ফিরোজকে নিজের স্মৃতি দিয়ে দেয় আলেক্সি। ছবিটি ব্যাগে ঢুকোয় ফিরোজ।
কথায় কথায় এগিয়ে আসে চলে যাওয়ার বেলা।
হালকা লাগেজগুলো নিয়ে প্লেনে উঠে যাচ্ছে ফিরোজ। ফেলে চলে যাচ্ছে রূপকথাতুল্য এক বিপ্লবের দেশকে।
ওঠার সময় তরুণ মন ওই দেশটিকে দিতে থাকে অভিসম্পাত। আলেক্সির কাছে শোনা কথাগুলোয় ফিরোজ বিষ ঢুকিয়ে দেয়। “শালা!শ্রমিকরাষ্ট্রই হইয়া থাকলা। বুদ্ধিরে দাম দিতে শিখলা না। এহ!বিমূর্ত শ্রম মূল্য সৃষ্টি করে না!“
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।