আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের বর্তমান গতি ও প্রকৃতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আদর্শগত ঠান্ডা লড়াই । গোটা পৃথিবী বিভক্ত হয়ে যায় পুজিঁবাদী ও সাম্যবাদী দলে। পূর্ব ইউরোপ , ল্যাাটিন আমেরিকা , পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্যবাদের বীজ বুনতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুজিঁবাদী নীতি অনুসরণ করে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়ার কিছু দেশ। আফ্রিকায়ও এই দুই পরাশক্তির তাবেদার রাষ্ট্র ছিল।

লাতিন আমেরিকা সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ চর্চার একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারার মত কালজয়ী বিপ্লবী নেতাদের আার্বিভাব হয় এই অঞ্চলে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লাতিন আমেরিকার ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ক্ষমতা , এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে ইতালিয়, জার্মান , এবং স্প্যানিশ অভিবাসীদের আকৃষ্ট করে। এই সব অধিবাসীরা তাদের সাথে করে নিয়ে আসে মার্ক্সিস্ট ধ্যান ধারণা এবং তারা এসব এই অঞ্চলে প্রসার ঘটান। লাতিন আমেরিকার বেশীরভাগ দেশ তখন সদ্য ঔপনিবেশিকতার শিকল ছিড়ে মুক্ত হয়েছে।

কিন্তু প্রকৃতিগত দিক দিয়ে তখনো এসব দেশের সমাজ ছিল সমাজতান্ত্রিক, মধ্যযুগীয় এবং গোড়াঁ। মার্ক্সিস্ট সাম্যবাদী আহবান তাই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বিরাজমান দ্বি-শ্রেনীভিত্তিক কৃষিভিত্তিক শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটি আকর্ষণীয় উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। লাতিন আমেরিকায় তৎকালীন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতা এই অঞ্চলটিকে সামাজিক বিপ্লব পরিচালনার জন্য আদর্শ ক্ষেত্রে পরিণত করে। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী নেতা তাই বলেছিলেন ‘ আমাকে চল্লিশ জন ক্ষুধার্ত মানুষ দাও, আমি বিপ্লব ঘটিয়ে দেখাব’। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর লাতিন আমেরিকার এই সব দেশগুলোতে সৃষ্টি হয় তীব্র মার্কিন জাতি বিরোধী জাতীয়বাদ এর বাম ঘেঁষা আদর্শের।

পরবর্তী দুই দশক এই অঞ্চলটি স্বৈরতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই এর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফলে এই অঞ্চলটি হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধের ধারণায় কিছুৃ নতুন মাত্রা সংযোজনের মাধ্যমে নগরকেন্দ্রিক গেরিলা যুদ্ধের ধারনার সূত্রপাত হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো পরিচালিত কিউবার অভ্য্থুান এ অঞ্চলে সাম্যবাদী রাষ্ট্রের একটি কার্যকারী মডেল উপস্থাপন করে। ক্রমে ক্রমে লাাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও সাম্যবাদের হাওয়্ ালাগতে শুরু করে।

যেটার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে নেমে পড়ে দুই পরাশক্তি। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুয়েতমালার অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে । উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত ‘সাম্যবাদী সরকারের’ পতন ঘটানো। এর কিছু বছর পরই কিউবায় সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালিত হয়। লাতিন আমেরিকায় কিউবায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ক্রমেই এই অঞ্চলের সমাজতন্ত্রের বিকাশে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাই সমাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে সামরিক , রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অনেক পরোক্ষ সমার্থন শুরু করে। যেহেতু কিউবা লাতিন আমেরিকার উপযোগী একটি নতুন মার্ক্সিস্ট- লেলিনিস্ট মডেল উদ্ভাবন করে , সেহেতু এই অঞ্চলে সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধই যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট হয়ে দাড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে ভয়াবহ সমাজন্ত্রবিরোধী অপারেশন করে ১৯৬১ সালে বে অব পিগস্ এ। তবে ১৯৬৫ সালের পর সমাজন্ত্র অনুসারী দলগুলোর ভেতর বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়।

সে সুযোগে যুক্ত্রাষ্ট্র অভ্যন্তরীন বিরোধকে সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধে সফলভাবে ব্যবহার করে। এই বিরোধের সূত্রপাতকে কেন্দ্র করে ১৯৯১ সালের দিকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ তথা নিকারাগুয়া, চিলি প্রভৃতি দেশে মার্ক্সিস্টরা পরাজিত হয়। ব্যাপক জনসমার্থন এবং আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও ৭০ এর দশকের শেষার্ধে লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্রের জোয়ারে ভেসে যায় সমাজতন্ত্রের সকল আকুতি, বেজে ওঠে এর বিদায়ের ঘন্টা। মার্ক্সিজম এবং সাম্যবাদ ধারার পরস্পর বিরোধী উন্মেষ ঘটে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর ভেদ করে ভিন্ন ভিন্ন মতের উদ্ভব হয়।

মার্ক্সিজমের মত একটি অনমনীয় আদর্শকে বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোটা একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। উদাহরণস্বরুপ লক্ষ্য করা যায়, পেরুতে দীর্ঘদিন যাবত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকারীগণ এবং কঠোর সাম্যবাদী দলগুলোর মধ্যে শত্রুতা চলতেছে। নিকারাগুয়ায় রয়েছে খ্রিস্টান সমাজতন্ত্রবাদী ,স্বাধীন মার্ক্সিস্ট এবং সেমিনিস্ট দল। কলোম্বিয়ায় মার্ক্সিস্ট এবং গেরিলা আন্দোলনকারীদের চার রকম প্রভেদ রয়েছে। সম্পূর্ণ মহাদেশ জুড়ে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদীদের মত ও পথের পার্থক্য সমাজতন্ত্রের পতনকে আরো বেশী তরান্বিত করছে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যাবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। নিকারাগুয়ার মত রাষ্ট্রসমূহ স্বৈরশাসন থেকে শুরু করে সমাজতন্ত্রের ভেতর দিয়ে অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রায়নের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সারা বিশ্ব জুড়ে অবশিষ্ট চারটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র- চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং কিউবার সামাজিক ও রাজনৈতিক দূরাবস্থা সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রের আবেদনকে বহুলাংশে হ্রাস করছে। কিউবা ছাড়া লাতিন আমেরিকার উনিশটি রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই রয়েছে গণতন্ত্রায়নের পথে পরিভ্রমণ ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা। কিন্ত সঠিক বিচারে এই অঞ্চলটি কৃষিভিত্তিক মধ্যযুগীয় এলাকা হতে একটি আধুনিক, নগরকেন্দ্রীক, শিল্পোন্নত এবং বৈচিত্রময় এলাকায় উন্নীত হয়েছে।

যদিও পূর্বের তুলনায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন , মানবাধিকার রক্ষা এবং রাজনৈতক উদারীকরনের ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকা যথেষ্ট উন্নতি করলেও এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিষয়টি এখনো অনুপস্থিত। বর্তমানে এই অঞ্চলের ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি খুবই ধীর। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির প্রাদুর্ভাব এখন লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশের বৈশিষ্ট্য।

লাতিন আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের জন্য গণতন্ত্র এখনো তার প্রতিশ্রুত সফলতা বয়ে আনতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি। এই স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশা থেকে স্বৈরশাসনের দিকে ফিরে যাবার জন্য একটি প্রবণতা লাতিন আমেরিকাতে বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্ক্সিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণ ঘটতেছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর সর্বাত্মক পুনরুত্থান এখন একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। বিশ্বায়ন , মুক্ত বানিজ্যের বিকাশ এবং উদারবাদী অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মডেল অনুসরনকারী রাষ্ট্রসমূহের সাফল্যর উদাহরণ মার্ক্সিজম লেলিনিজম এর ফিরে আসার সম্ভাবনাকে বর্তমানে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।