চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি গভীর সঙ্কটে পড়েছে পুঁজিবাদ। আর এই সঙ্কটের আকৃতি প্রকৃতি অনেকটাই নজিরবিহীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সত্তর বছরে বিশ্ব পুঁজিবাদের মক্কা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই স্বয়ং দশবার বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। যার সবগুলোকেই মার্কিন পুঁজিবাদ বিভিন্ন উপায়ে কোন রকমে সামাল দিয়ে দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু এবার সে কিছুতেই সঙ্কটের যাঁতাকল থেকে বেরোতে পারছে না। মন্দা কাটাতে সামরিকায়ন, যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিস্তার, রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, শ্রমিক ছাটাই, মজুরী হ্রাস ইত্যাদি নানান উপায়কে বিভিন্ন সময় কাজে লাগানো হয়েছে।
কিন্তু এবারের সংকটে ইতিপূর্বে কাজে লাগানো কৌশলগুলোর কোনটাই কাজ করছে না। কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় সাহায্য প্যাকেজ মার্কিন ফাইনান্সিয়াল অর্থনীতিতে ঢালা হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের দু দুটো যুদ্ধে আরো কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল কি? আগষ্ট ২০০৭ থেকে জুন ২০০৯ পর্যন্ত বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে বেল আউট এর জন্য খরচ করা অর্থের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাগে পুরোপুরি পতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হলেও পরের দুই বছর, জুন ২০০৯ থেকে জুলাই ২০১১ পর্যায়ে দেখা যায় গোটা অর্থনীতি যেন থমকে আছে- ধ্বস এড়ানো গেলেও ব্যবসা ও অর্থনীতিকে স্লথ গতি থেকে বের করা যাচ্ছে না, লাখ লাখ ছাটাই হওয়া শ্রমিকের জন্য কর্মসংস্থানেরও কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। জুলাই ২০১১ থেকে আবার পতনের দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন অর্থনীতি।
সবচেয়ে বড় কথা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ তার বাজারকে প্রসারিত করে সঙ্কট থেকে মুক্তির উপায় খোঁজে, এইবারের আর্থিক মন্দায় সেই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৪৪৭ বিলিয়ন ডলারের নতুন একটা বিল উত্থাপন করেছেন গত ৭ সেপ্টম্বর ২০১১ তে। দুই দিন পর নিউ ইয়র্ক টাইমস এর হেডলাইন হয়: “মালিকেরা বলছেন নতুন কর্মসংস্থানের জোয়ার আসবে না”। মালিকেরা বলছে তারা নতুন নিয়োগ দেবে না কারণ বাজারে বাড়তি পণ্যের চাহিদা বা জনগণের পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা নেই ফলে বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। কিন্তু মুশকিল হলো নতুন কর্মসংস্থান না হলে তো লোকের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়বে না, বাজারের চাহিদাও বাড়বে না! অন্যদিকে অতীতে আমরা দেখেছি এরকম সংকট জনক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুজতে আমেরিকা ইউরোপ সহ প্রথম বিশ্বের দেশগুলির লগ্নী পুজি সারা দুনিয়াকে তার বিনিয়োগের ক্ষেত্র বানিয়েছে।
একসময় এভাবে প্রান্তস্থ দেশগুলো থেকে, যেখানে পুজিবাদ তুলনামূলক কম বিকশিত ফলে পুজিবাদের সংকটও অপরিণত, সেখানে পুজি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা আহরণ করেছে আমেরিকা ইউরোপ এবং তার বিনিময়ে নিজ দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রেণী সংগ্রামকে সামাল দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্শ্বিায়িত দুনিয়ায় ইতোমধ্যেই সারা দুনিয়ার প্রায় সমস্ত লাভজনক ক্ষেত্রে পুজিবাদী অর্থনীতির নিয়মের আওতায় চলে আসা, নতুন বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন, ম্যানুফ্যাকচারিং এর লাভজনক আউট সোর্সিং ইত্যাদির ফলাফল স্বরূপ পুজি রপ্তানি এখন সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা উন্নয়ণের বদলে মজুরী হ্রাস, শ্রমিক ছাটাই, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় হ্রাস ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপের এগিয়ে থাকা দেশগুলির সঙ্কটও মারাত্মক জায়গায়। গ্রীস, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালির মত কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান এরকম –
১) ২০১১ থেকে গ্রীসের অর্থনীতি ৬ শতাংশ নেমে গেছে, গত ৫ বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি একই ভাবে ডুবেই চলেছে।
২) গ্রীসে সরকারি হিসেবে ২০১০-এ বেকারত্ব- ১২.৫ শতাংশ, ২০১১তে ১৭.৩ শতাংশ এবং বর্তমানে ২১.৮ শতাংশ।
৩) তরুন যুবকদের মধ্যে গ্রীসে বেকারত্ব ৫০ শতাংশের উর্ধ্বে।
৪) গ্রীসের বন্দর শহর পারমায় বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশ।
৫) অর্থনৈতিক মন্দায় গ্রীসের ২০ শতাংশ খুচরা বিক্রির দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
৬) গ্রীসের জাতীয় ঋণ বার্ষিক জিডিপি’র ১৬০ শতাংশ।
৭) স্পেনে বেকারত্বের হার ২৩.৬ শতাংশ।
৮) স্পেনে যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ৫০ শতাংশের বেশি।
৯) স্পেনের জিডিপি ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। দেশটির প্রধান তিনটি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যেগুলো দেওলিয়া হওয়ার শেষ সীমানায় রয়েছে।
১০) ২০১১ থেকে স্পেনে বাড়িঘরের মূল্য ১১.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
১১) আর্থিক মন্দা সাথে সাথে স্পেন ৭০ বছরের মধ্যে রেকর্ড খরার সম্মুখিন হয়েছে।
১২) পর্তুগালের বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশ।
১৩) পর্তুগালে যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ৩৫ শতাংশ।
১৪) ২০১২ সালে পর্তুগালের অর্থনীতি নেমে যাবে ৫.৭ শতাংশ।
১৫) ইতালিতে যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ৩১.৯ শতাংশ।
১৬) ইতালির জাতীয় ঋণের পরিমাণ গ্রীস, আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের সম্মিলিত ঋণের ২.৭ গুন।
১৭) ইতালির জাতীয় ঋণ জিডিপির ১২০ শতাংশ।
পরিস্থিতি ক্রমশ মারাত্মক হয়ে উঠছে ব্রিটেনেও। এখানে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেছে দ্য ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজ বা আইএফএস । প্রতিষ্ঠানটি এক গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, আগামী কয়েক বছরে এ সঙ্কট আরও তীব্রতর হবে এবং জীবনমানের মারাত্মক অবনতি হবে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর হয়নি। এতে আরও বলা হয়েছে, ব্রিটিশ সরকার রেকর্ড পরিমাণ বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে আর এতে করে সরকারি ব্যয় কমানো হবে।
তখন মানুষের আয়-রোজগার কমে যাবে এবং ট্যাক্সসহ অন্যান্য খরচ বাড়বে। আইএফএসের গবেষক রবার্ট জয়সে বলেছেন, গত তিন বছর আগে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়েছে। এবং এটা এখন পুরনো খবর। নতুন খবর হচ্ছে, ব্রিটেনে এ সঙ্কট মাত্র অনুভূত হতে শুরু করেছে এবং আগামী অনেক বছর ধরে এ সঙ্কট চলতেই থাকবে। অর্থনীতির চাকা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত মারাত্মক মন্দা বোঝা যাবে না।
তবে এটা এড়ানোর সুযোগ নেই, দেশবাসীকে এর তাপ অনুভব করতে হবে।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পুজিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকা দেশগুলোতে শ্রেণী সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠার পরিস্থিতি তৈরী হওয়াই স্বাভাবিক। স্পেন, গ্রীস, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপ এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সহ দুনিয়ার দেশে দেশে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টের দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়া,জনপ্রিয় হয়ে উঠা তারই স্বাক্ষ্য বহন করে। আমেরিকা ইউরোপে শ্রমিকশ্রেণি নতুন করে উদ্দীপ্ত লড়াই শুরু করেছে। পাশাপাশি এই সমস্ত দেশগুলিতে গণবিক্ষোভের সূত্র ধরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও ঘটছে।
তার কিছু দৃষ্টান্ত আমরা মনে ধরতে পারি।
স্পেন : স্পেনে গত বছর আবাসন খাতে ব্যাপক ধস নামার কারণে দেশটির সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছিল। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী হোসে লুইস রডরিগুয়েজ জাপাতেরোর সরকার তা সহজে স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কৃচ্ছ্র সাধন নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনগণ।
ফলে গত বছর নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে জাপাতেরোর সরকারের পতন ঘটে।
ইতালি : ইতালিতে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং দেশও আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায়। ধারাবাহিক দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি গত বছর নভেম্বরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
আয়ারল্যান্ড : ২০০৮ সালে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্রায়ান কোয়েন। কিন্তু তিনি ঠিক মতো সরকার চালাতে পারছিলেন না।
ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ও দলের মধ্যে বিদ্রোহের কারণে ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
গ্রিস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে গ্রিস। চলমান এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে দেশকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিজয়ী হন জর্জ পাপান্দ্রু । কিন্তু আর্থিক সঙ্কট আরো গভীর হওয়ার পর নিজ দলের এমপিদের চাপে দুই বছর পর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন পাপান্দ্রু । বর্তমানে দেশটিতে লুকাস পাপডেমুসের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যামান।
পর্তুগাল : চলমান আর্থিক সঙ্কট থেকে বাঁচতে পর্তুগাল সরকার ৭৮ বিলিয়ন ইউরো আর্থিকসহায়তা চাওয়ার এক মাস পর অর্থাৎ গত বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হয় প্রধানমন্ত্রী হোসে সক্রেটিসের নেতৃত্বাধীন দেশটির ক্ষমতাসীন সরকার।
ডেনমার্ক : ডেনমার্কে চলমান ঋণসঙ্কটের কারণে কঠোর কৃচ্ছ্র সাধন নীতি গ্রহণ করে দেশটির মধ্য ডানপন্থী সরকার। এর ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত বছর সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে এই সরকার ক্ষমতা হারিয়েছে। এখন সেখানে বামপন্থী কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।
ব্রিটেন - ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট জোটের দুই দলেরই ভরাডুবি আর লেবার পার্টির বিপুল সাফল্যের পর সরকারের আার্থিক নীতি নিয়ে বিতর্ক চরমে উঠেছে। লন্ডনের মেয়রের আসনটি জিততে না-পারলেও সারা দেশে সাতশোরও বেশি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে লেবার পার্টি, আর তাদের নেতা এড মিলিব্যান্ড দাবি করেছেন মানুষ যা চায় তারা সে কথাই বলেছেন।
ফ্রান্স – সদ্যসমাপ্ত ফ্রান্সের নির্বাচনের ফলাফল সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে নিশ্চিতভাবেই উদ্দীপ্ত করবে। ৬ মে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ভোটে সমাজতন্ত্রী প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ মধ্য-ডানপন্থি প্রার্থী নিকোলাস সারকোজিকে পরাস্ত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
এককথায় বলা যায় সঙ্কটটা আর শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই, তার তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ভারত সরকারের আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন আগামী দু বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে যে বিরাট আর্থিক সঙ্কটের ছায়া দেখা যাবে, ভারতেও তার ছাপ অনুভূত হবে। আর এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ইউরোপের এইসব দেশগুলির মত ভারতেও এই সঙ্কট শুধু আর্থিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার নতুন বিন্যাস হবে ও মেহনতি মানুষ নিশ্চিতভাবেই সেই বিন্যাসে আত্মঘোষণা রাখবেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।