বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে
আমি প্রায় সন্ধ্যাতেই বারান্দায় ডায়েরীটা নিয়ে বসি। কোন কোন বিকালে দুরের ছাদে দেখি মায়াবতী মেয়ের ঘুরে বেড়ানো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ছাঁদজুড়ে। কোন বিকালে অন্য কোন বিল্ডিংয়ে দেখি অন্য কোন মায়াবতীকে। কেমন যেন মায়াকাড়া চেহারা।
অবন্তীর চেহারাও কি এমন ছিল! আবার কোন বিকালে দুরের কোন বিল্ডিংয়ের বাসার বারান্দায় দেখি ভালোবাসার মানুষদের একসাথে বসে থাকা। অবন্তীর সাথে এমন করেই কি বসে থাকতে চেয়েছিল ছেলেটি! একটা বিষন্ন বিকাল, একটা ক্ষণজন্মা সন্ধ্যা, একটা সোডিয়াম আলোর নাগরিক রাত, একটা নিস্তব্ধ মধ্যরাত, একটা মিষ্টি ভোর কিংবা কর্মব্যস্ত একটা সকাল। মানুষের এক জীবনে অনেক স্বপ্ন থাকে, অনেক প্রত্যাশা থাকে। মানুষ তার এক জীবনে সব স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে পারে না বলেই এতো আন্তরিকতা নিয়ে স্বপ্নের পিছনে ছুটে বেড়ায়।
সন্ধ্যা পেরুনোর পর রাত নামলে মাঝেমধ্যেই আমাদের দুইজনের আলোচনায় ভালোবাসার কথা চলে আসে।
তারপর অবধারিতভাবে ছেলেটির ডায়েরী প্রসঙ্গ। জীবন কাহিনীর ফিনিশিং নিয়ে আমাদের তর্কটা দীর্ঘায়িত হয়। রুমমেট যেভাবে শেষ দেখে আমি ঠিক তার উল্টোটা। আমি মিলনাত্নক সমাপ্তি খুঁজি। যেখানে অবন্তী ও ছেলেটি একসাথে জেগে জেগে কাটিয়ে দিবে কোন এক সম্পূর্ণ জ্যোস্না রাত।
রুমমেট বলে এই ধরণের মিলনাত্বক পরিসমাপ্তি গল্পের পাঠকদের আকর্ষণের জন্য। আর কিছুই না। গড়পড়তা বেশিরভাগ পাঠক গল্পের সুন্দর পরিসমাপ্তি দেখতে চায়। যুক্তি দেই- ছেলেটির ডায়েরীর লেখাটা আমাদের কাছে এখন গল্পের মতো। সুতরাং এখানে একটা মিলনাত্বক সুন্দর পরিসমাপ্তি চিন্তা করলে সমস্যা কোথায়!রুমমেট চুপ করে শুনে যায় আমার বলা পরিসমাপ্তি।
আমি শুরু করি ছেলেটির পর্যায় থেকে। সময়ের সাথে সাথে ছেলেটির অনেককিছুই স্বাভাবিক হয়ে যেতে থাকে। ছোটখাটো একটা চাকরী পেয়ে যায় সে। চাকরীর পেছনেই দিনের বড় একটা সময় চলে যায়। তারপর ঘরে ফিরে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা সময় গল্পের বই পড়ে কাটায়, কিংবা কোন কোন রাতে টিভির চ্যানেল পাল্টিয়ে সময় কাটায়।
মাঝেমধ্যে বাড়িতে যাওয়া হয়। বাবা-মা বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে। তবে ছেলেটির সাড়া না পেয়ে প্রসঙ্গ বেশিদুর এগিয়ে যায় না। সময় এভাবেই প্রবাহিত হতে থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ রাস্তায় ছাত্রীর মার সাথে দেখা হয়ে যায় ছেলেটির সাথে।
খোঁজখবর নেয় দুজনেই। জানতে পারে ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর বিদেশ চলে গেছে পড়ালেখার জন্য। ছাত্রীর পরিবারের টাকাপয়সা অনেক। এমন পরিবারইতো মেয়েকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাবে। ছাত্রী সমন্ধে আরো কিছু বিষয় জানতে চাইতে গিয়েও ছেলেটি প্রশ্ন করতে পারে না।
তবে জানতে পারে ছাত্রী ইংল্যান্ডে পড়েতে গেছে। মুহুর্তেই চট করে মনে পড়ে গেল অবন্তীর খালাতো ভাইয়ের কথা। সেও ইংল্যান্ডে থাকে। এতোদিনে হয়তো তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
কয়েকমাস পরের এক বিকাল।
শপিংমলের গেট দিয়ে ভিতরে যাচ্ছিল ছেলেটি। বিশাল শপিংমলের স্বয়ংক্রিয় কাচের দরজা। প্রবেশ করতে গেলেই খুলে যায়। অবচেতন মনে গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই খেয়াল করলো কেউ একজন তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেল সেখানে অবন্তী দাড়িয়ে আছে।
কাছে এসে বললো-
“গেটের বাইরেই আপনাকে দেখছিলাম। তাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো। অনেকবার আপনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনি যে কোথায় ডুব দিলেন! আগের মোবাইল ফোনের নাম্বারটাও বন্ধ করে রাখছেন।
” একটানে কথাগুলো বলে থামলো অবন্তী।
ছেলেটি তখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে কি বাস্তবেই অবন্তীর সাথে কথা বলছে! এভাবে অবন্তীর সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি সে।
“কি ব্যাপার কথা বলছেন না যে?” অবন্তীর জিজ্ঞাসা।
“আসলেই অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো। সময় মনে হয় অনেক তাড়াতাড়িই চলে যায়।
কেমন আছেন?”
“এইতো চলে যাচ্ছে দিন। একলা যে? সঙ্গে কেউ নেই কেন?”
“সঙ্গে কাউকে জড়ালে না থাকবে। ” ছেলেটি হেসে হেসে জবাব দিলো।
তারপর দুজনেরই মাঝেই কিছু সময়ের নীরবতা।
“খুব ব্যস্ত আজকে? শপিং করবেন নাকি?”
“খুব ব্যস্ত না? কেন?”
“আমার সাথে একজায়গায় যেতে পারবেন?”
কোথায় যেতে হবে এমনটা জিজ্ঞেস করলো না ছেলেটি।
এমনকি দরকারী কিছু জিনিষপত্র কেনার জন্য শপিংমলে আসা, এটাও ভুলে গেল সে। সবকিছু রেখে কি এক আকর্ষণে অবন্তীর সাথে রওনা হলো। অবন্তীই রিক্সা ঠিক করেছে। সে দুরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আশপাশ দেখছিল। অনেকদিন পর আবার একসাথে রিক্সায় চড়া।
প্রথমবারের মতো একসাথে রিক্সায় চড়ার সেই বিকালের কথা মনে পড়ে গেল তার। সেই বিকালে ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে দীর্ঘ সময় পর শহরের শেষ প্রান্তে রিক্সা থামলো। তখন সূর্যটা ডুবি ডুবি করছে। পাকা রাস্তাটার একপাশে গিয়ে বসলো দুজনেই।
সামনেই নদী বয়ে গেছে। শেষ বিকালের শান্ত বাতাস নদীতে ঢেউ তুলছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর অবন্তীই মুখ খুললো।
“এখন কি করছেন আপনি?”
“এইতো, ছোটখাটো একটা চাকরী করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ”
চেষ্টা করে যাচ্ছি শুনে অবন্তী হেসে দিল।
ছেলেটি ভাবছে, অবন্তীকে তার খালাতো ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা! কিংবা বিয়ের প্রসঙ্গও তুলবে কিনা বুঝতে পারছে না।
“আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?” ছেলেটির জিজ্ঞাসা।
“কোনমতন চলে যাচ্ছে। আপনিতো হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেলেন। তারপর অনেকগুলো বিকাল আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি।
যেখানটায় আমাদের গল্প হতো সেখানে বসে থাকতাম। ভাবতাম হয়তো কোন এক বিকালে আপনি আসবেন। ”
“এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল?”
“এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি না জানি না। তবে এমনটা হয়েছে। আচ্ছা আপনি এমন প্রশ্ন করলেন কেন? খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের প্রসঙ্গ মনে করে?”
ছেলেটি কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।
অবন্তী আবার বলা শুরু করলো।
“আসলে আপনাকে পুরো বিষয়টা পরিস্কার করে বলা হয় নি তখন। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও সবসময়ই কেমন যেন একটা দূরত্ব রাখতো। বিয়ের প্রসঙ্গে দুজনেই একমত হয়েছিলাম। তবে সেটা এতোটা জোরালো কিছু ছিল না।
কথা ছিল কয়েকমাস পরে সে দেশে আসবে। তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। তবে শেষ পর্যন্ত একটা বিষয় নিয়ে আমরা আমাদের মতবিরোধ কাটাতে পারি নি। তার কথা হচ্ছে, বিয়ে হলে বিদেশে থাকতে হবে। সে দেশে থাকতে আগ্রহী না।
আমি আবার দেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী না। এই মতবিরোধটা কোনভাবেই কাটলো। যে যার ইগো নিয়ে পড়ে থাকলাম। ”
ছেলেটি চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। গল্পের মাঝখানে ছোট মাটির টুকরো নিয়ে নদীর দিকে ছুড়ে দিল।
মুহুর্তেই ছোট ছোট কিছু ঢেউ আসলো নদীর তীরে। হঠাৎ করেই ছেলেটির মনে হলো মানুষের জীবনটা নদীর ঢেউগুলোর মতো।
অবন্তী আবার বলা শুরু করলো। “মনে আছে প্রথম যেদিন আমরা রিক্সায় চড়েছিলাম তখন কি বলেছিলাম ভালোবাসার সম্পর্ক সমন্ধে? ভালোবাসার সম্পর্ক মানে প্রিয় কিছু প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমন্বয়। অন্যান্য সম্পর্কেও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি থাকে।
তবে ভালোবাসার সম্পর্কে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিগুলো খুবই স্পেশাল। এখন কেন জানি মনে হয় আমাদের পারস্পরিক প্রাপ্তিগুলো হয়তো এতোটা বিশেষ ছিল না। ”
ছেলেটি অবন্তীর কথাগুলোর জবাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কেবল চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। অবন্তীই আবার বলা শুরু করলো।
“সেই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। একটা পর্যায়ে প্রতিদিন বিকালে বারান্দায় বসে থাকতাম। প্রতিদিনই মনে হতো আমি কারো জন্য প্রতীক্ষা করছি। রাগ জেগে জেগে ভাবতাম অনেক কিছু নিয়েই। খুব মনে হতো, আমি হয়তো তোমার জন্যই প্রতি বিকাল প্রতীক্ষা করে থাকি।
”
তুমি সম্বোধন ছেলেটির কানে খুব করে বাজলো। এবার ছেলেটি কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো- “চলো উঠা যাক। ”
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার তখন ছুয়ে গেছে চলার পথকে। পথিক জানে না কতোটা পথ হেটে হেটে তারা অনুভুতির এই সীমানায় এসে দাড়িয়েছে। তবুও অবন্তী আর ছেলেটির চোখে হয়তো নতুন কোন সুন্দর স্বপ্ন।
অবন্তী আর ছেলেটির বিষয়ক ভাবনা শেষে আমি ছাত্রীকে নিয়ে ভাবি। বিদেশে পড়ালেখা করতে গিয়ে কি হয়েছিল তার? এখানেও মিলনাত্বক চিন্তাভাবনা। দৈবক্রমে অনেক কিছুই ঘটে। এখানেও আরেকবার তা ঘটলে সমস্যা কোথায়! ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করছে। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় অবন্তীর খালাতো ভাইয়ের সাথে।
পরিচয়ের গভীরতা পৌছায় প্রিয় সম্পর্কের দিকে। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাগুলো তাদের জন্য বিশেষ কিছু হয়ে উঠে।
তবে কাহিনীর শেষ কেমন হয়েছে এ নিয়ে আমার আর রুমমেটের তর্কের শেষ নেই। সবসময়ই একজনের ফিনিশিং এর সাথে অন্যজনেরটা মিলে না। তবে আমরা দুজনেই একটা ব্যাপারে একমত -ছেলেটা গল্প বলার মতো করে তার ডায়েরী লেখে গেছে।
ডায়েরীটা দুজনেই পড়ি আর আমাদের সামনে ছেলেটার জীবনের কাহিনীগুলো বিমূর্ত হয়ে উঠে। ছেলেটার কষ্টগুলো। দীর্ঘশ্বাসগুলো আমাদেরও যেন ছুয়ে যায়। ইদানিং লক্ষ্য করছি আমার রুমমেটও ডায়েরী লেখা শুরু করেছে। হয়তো সেই ডায়েরীতেও রুমমেট ছেলেটার মতো করে তার জীবনের কাহিনী লেখে চলেছে।
সেই কাহিনীতে আসবে তার জীবনের আনন্দ, বেদনা, দীর্ঘশ্বাসগুলো। হয়তো রুমমেট তার ডায়েরী এই রুমে রেখে চলে যাবে। নতুন নতুন কেউ এসে রুমমেটের ডায়েরী পড়ে কাহিনী খুঁজবে। এভাবে বছরের পর বছরের জীবনের দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়াবে কাগজের পৃষ্টা। আর ছেলেটির জীবনকাহিনী প্রতিনিধিত্ব করতে আরো কতো শতো পরিণত মোহ কিংবা অপরিণত ভালোবাসার।
(সমাপ্তি)
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব,পঞ্চম পর্ব , ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব
অষ্টম পর্ব,নবম পর্ব,দশম পর্ব, একাদশ পর্ব, দ্বাদশ পর্ব, ত্রয়োদশ পর্ব
পুরো সিরিজটার পিডিএফ লিংক - Click This Link
পিডিএফ লিংক কৃতজ্ঞতা : ব্লগার নাঈম ভাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।