যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মিথুন আহমেদের ডকুমেন্টারি ‘ট্রাইব্যুনাল ফর ওয়ার ক্রিমিনালস’
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্তটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। বাঙালি জাতির জীবনে এটি একটি বড় অধ্যায়। একটি গ্লানি মোচনের সত্রপাত। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোটার সংখ্যা ছিল একত্রিশ শতাংশ। এরা সবাই স্পষ্ট জানিয়েছে, ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।
সাংসদরা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে প্রজন্মের প্রতি সেই সম্মান দেখিয়েছেন। এজন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। হওয়া প্রয়োজন। এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
শহীদ রুমীর মা তিনি। লাখো শহীদের মা তিনি। তার ডাকে জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। জেগে উঠেছিল বাঙালির মানবিক সত্তা। সবাই একবাক্যে বলেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।
১৯৯১ সালের শেষার্ধে শহীদ জননী যখন এই ডাক দেন, তখন অভূতপর্ব সাড়া পড়েছিল দেশে-বিদেশে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা এই নিউইয়র্কেও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ যুক্তরাষ্ট্র শাখা গঠন করি। এর যৌথ আহ্বায়ক মনোনীত হন শ্রদ্ধাভাজন কাজী জাকারিয়া ও ড. নুরুন নবী। সদস্য সচিব মনোনীত হন ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী এবং যুগ্ম সদস্য সচিব মনোনীত হই আমি। এর সুবাদেই শহীদ জননীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগের একটি সুযোগ আসে।
তার সঙ্গে আলাপচারিতা ছিল আমার জীবনের অত্যন্ত শাণিত সময়।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণআদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শহীদ জননী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, যেকোন মূল্যে গণআদালত হবেই। সে সময় বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থেকে নানা হুমকি ধমকিই দিচ্ছিল শহীদ জননীকে। কিন্তু তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তে অনড়।
বলেছিলেন, কোন শক্তিই গণআদালতকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।
নির্মূল কমিটি যুক্তরাষ্ট্র শাখার পক্ষ থেকে তখন একজন পর্যবেক্ষক আইনজীবী ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটর্নি মি. টমাস কিটিংকে গণআদালত পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা ঢাকায় পাঠাই।
তিনি তা পর্যবেক্ষণ করে এসে নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলন করে সবিস্তারে বর্ণনা দেন তার অভিজ্ঞতার কথা, তার অভিমতের কথা। তিনিও সে সময় বলেছিলেন, গণআদালত তার রায় দিয়েছে।
এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই।
দুই.
১৯৯৪ সালে শহীদ জননী প্রয়াত হওয়ার পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির কার্যক্রম বেশ স্খবির হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিটি মুখথুবড়ে পড়ে। এ বিষয়ে সে সময়ের রাষ্ট্র পরিচালকরা ছিলেন বেশ নির্বিকার।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক-আলবদর নিজামী ও মুজাহিদকে মন্তী করা হয়। নরঘাতক গোলাম আযম নেপথ্যে থেকে এই দুই মন্তীর মুখ্য পরামর্শকের ভূমিকাই পালন করেছিল বলে জানা যায়।
যারা যুদ্ধাপরাধী, যারা ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন, নরহত্যা, ব্যভিচারের মতো জঘন্য অমানবিক কাজগুলোর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন যুগিয়েছিল কেন তাদের বিচার হবে না? এই প্রশ্নটি সময়ের। এই প্রশ্নটি কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর।
যারা ২০০৮ সালেই প্রথম ভোট দেবার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
১৯৭১ সালে বাংলার মাটিতে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধন ও সম্ভ্রম লুণ্ঠন হয়েছে এর সচিত্র ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্কাইভে। এদেশের গণমানুষ যে বারবার এসব দালাল-ঘাতকদের বিচার চেয়েছে তার প্রমাণও আছে বিভিন্ন ফুটেজে।
এগুলো সমন্বয়, সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেই একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছেন নিউইয়র্ক অভিবাসী তরুণ সংগঠক, নির্মাতা মিথুন আহমেদ। ‘ট্রাইব্যুনাল ফর ওয়ার ক্রিমিনালস’- শিরোনামের এই ডকুমেন্টারিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই দিনগুলোর কথা।
মিথুন আহমেদ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় মাঠকর্মী। বিভিন্ন ঘটনা দেখেছেন খুব কাছে থেকে। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ কিংবা ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’-এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে বাঙালি মননের বোধকে পরিশুদ্ধ করেছেন মানবকল্যাণের স্বার্থে।
মিথুন আহমেদের নির্মিত ‘ট্রাইব্যুনাল ফর ওয়ার ক্রিমিনালস’-এর বিভিন্ন দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্বপ্নগুলোকে আবারও জানান দিচ্ছেন তিনি।
এই ডকুমেন্টারিতে বেশ ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তির তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার রয়েছে। শাহরিয়ার কবির, ফজলে হোসেন বাদশাহ, লুৎফর রহমান রিটন, আমিরুল ইসলাম, আসলাম সানী, অশোক কর্মকার, মোহন রায়হান, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, কাইয়ুম চৌধুরী এরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল মানুষ। আছে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, মার্কিন আইনজীবী মি. টমাস কিটিংয়ের সাক্ষাৎকারও।
জাতিসংঘ চত্বরে একবার একটি মৌলবাদী সমাবেশে হাজির হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মওলানা আশরাফুজ্জামান খান। তারও একটি তাৎক্ষণিক বক্তব্য দিয়েছেন মিথুন আহমেদ এই ডকুমেন্টারিতে।
যদিও আশরাফুজ্জামান খান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যে গণআদালত গঠিত হয়েছিল এর দীর্ঘ সচিত্র বর্ণনা ডকুমেন্টারিটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
আমরা জানি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনউদ্দিন এখন লন্ডনে এবং মওলানা আশরাফুজ্জামান খান নিউইয়র্কে অবস্খান করছে। সম্প্রতি ঢাকাস্খ মার্কিন রাষ্ট্রদত মি. মরিয়ার্টি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চাইলে তারা সার্বিক সাহায্য করার কথা বিবেচনা করবেন। আমি মনে করি, এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্তণালয় যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের সাহায্য চাইতে পারে।
পালিয়ে আসা চৌধুরী মইনউদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে বিচারের মুখোমুখি করা সব মানবসত্তারই দায়িত্ব।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য অনুষ্ঠানে, আন্তর্জাতিক বিচার কার্যগুলোর ধারা-উপধারা বিবেচনা করা দরকার। দেশের বিচারকরা যাতে ‘বিব্রতবোধ’ না করতে পারেন সে জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা অত্যাবশ্যক। তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে যার কাছে যা প্রমাণ আছে, সব নিয়ে এগিয়ে আশা নৈতিক দায়িত্ব।
নিউইয়র্ক, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
-------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ ।
ঢাকা। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।