আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিন্স আশরাফের রহস্য উপন্যাস দানব-৪

শিরদাঁড়া নেই, বহু শরীরেই নিজেদের মানাতে মানাতে.......

(পূর্ব প্রকাশিত পর) একদিন এক বন্ধুর বাসা থেকে ফিরছি। ফার্মগেট থেকে বাস চেঞ্জ করে উত্তরার বাসে উঠতে হবে। হঠাৎ যেন মনে হলে গাবতলীর বাসে উঠতে আমাদের গ্রামের আমাদের ঘেরের পাহারাদার হামিদ ভাইকে দেখলাম। কিন্তু হামিদ ভাই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে আসবে কেন? আর আমার যেন মনে হলো হামিদ ভাই আমাকে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি করে বাসে ঠেলে উঠল। কিন্তু তা তো করার কথা নয়।

হামিদ ভাইয়ের সাথে আমার যে সম্পর্ক তাতে তো বাস থেকে আগে নেমে পড়া উচিত। তাহলে হয়তো হামিদ ভাইই নয়। মনের মধ্যের খঁচখঁচানি না যাওয়ায় বাড়িতে ফোন করে খবর নিয়ে জানতে পারলাম হামিদ ভাই নাকি ঘেরের কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন কি যেন ব্যবসা করে। ব্যবসার কাজেই তাকে ঢাকায় আসতে হয়।

হামিদ ভাইয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি এমন সময় হামিদ ভাইকে আবার দেখলাম। তাও আমাদের মেডিকেল কলেজে। এবারে আর আমাকে এড়াতে পারল না। বলতে গেলে হাতে নাতেই ধরে ফেলেছি। হামিদ ভাই এখানকার এক কর্মচারীর কাছে এক সেট তাজা বোনস বিক্রি করতে এসেছে।

তারই লেনদেন চলছিল। হামিদ ভাইকে ক্যান্টিনে ডেকে নিয়ে বসিয়ে একটু বিদ্রুপাত্বক স্বরে বললাম, ‘ঘেরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাহলে এখন লাশের হাড়গোড় এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা করছো!’ হামিদ ভাই কাচুমাচু মুখে বলল, ‘না মানে- ছোট ভাই, একটা সুযোগ এসে গেল। গরীব মানুষের একটা লাশ পেয়ে গেলাম। তাই কিনে এনে-’ আমি একটু কড়া স্বরে বললাম, ‘ওসব ধান্ধাবাজি ছাড় হামিদ ভাই। লাশ কেনাটেনার কথা বাদ দিয়ে আসল কথা বল।

এ ব্যবসা কদ্দিন ধরে করছো? গ্রাম থেকে কবর খুঁড়ে কতগুলো লাশের হাড় এরকম ঢাকায় পাচার করেছো?’ ‘সত্যি বলছি ছোট ভাই এই প্রথম। ’ ‘ফার্মগেটে যেবার দেখা হলো। না দেখার ভান করে বাসে উঠে পড়লে। সেবার?’ ‘আর ঐ আরেকবার। ’ ‘হুম।

এরকম কত আরেকবার আছে তা আল্লাই জানে। আমার সাথে দেখা হয়নি বলে। ’ ‘না, ছোট ভাই না। এই দু’বারই লাশ তুলে হাড় এনেছি। ’ ‘কবর খুঁড়ে?’ ‘হু।

’ ‘কেউ জানতে পারেনি?’ হামিদ দুদিকে মাথা নাড়ে। ‘একেকটা লাশের হাড়ে কত করে পাচ্ছ?’ ‘সরকারী মেডিকেল গুলো কম দেয়। বেসরকারীতে আটের মত দিয়েছে। ’ ‘ভালই ব্যবসা তো দেখছি। বিনা পুঁজির ব্যবসা।

কবর থেকে লাশ তুলে এনে বেঁচে দিলেই হলো। কবরের বাসিন্দার তো আর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। ’ ‘রিস্ক আছে ছোটভাই। পুলিশে ঝামেলা করে। ’ ‘এর মধ্যে করেছে নাকি?’ ‘সন্দেহে করছে।

তবে আমি যে করছি তা তো জানে না। আর আপনার আল্লার দোহাই লাগে ছোট ভাই বাড়িতে কাউকে জানায়েন না। ’ ‘ঠিক আছে আমি কাউকে জানাব না। আমার উপরে বিশ্বাস করতে পার। কিন্তু তোমারও আল্লার দোহাই লাগে এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা কর।

কবরের লাশ নিয়ে ব্যবসা করা ঠিক না। লাশের আত্মার অভিশাপ লাগে। ’ হামিদ ভাই কি বুঝল কে জানে! মুখ গম্ভীর করে আমার সামনে থেকে উঠে গেল। আমার অনুরোধ সত্বেও আমার বাসায় যেতে রাজি হলো না। তাকে নাকি আজই গ্রামে ফিরতে হবে।

জরুরী কাজ। বোধ হয় কবর খুঁড়ে আজ রাতে আরেকটা লাশ তুলবে। বাসায় এসে দেখি আরেক কান্ড। আমার বন্ধু, ক্লাস মেট কাম রুমমেট হাসান, দেশের বাড়ি থেকে ফিরেছে। তার ছোটমামা এসেছে আমেরিকা থেকে।

হাসানের জন্য উন্নত মানের একটা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। বাসায় এসেই ও সামনের মাথায় যা পাচ্ছে, যাকে পাচ্ছে তাই ভিডিও করে নিচ্ছে। আমি রুমে ঢুকতেই আমার কর্মকান্ড ভিডিও শুরু হয়ে গেল। ওর কান্ডকারখানা দেখে বাথরুমে যেতেও ভয় পাচ্ছি। মেডিকেলের পড়া এক ঘেয়ে লাগার কারণেই কিনা জানি না, হাসানের দেখাদেখি হাসানের সাথে ফিল্মের একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম।

এপ্রিসিয়েশন কোর্স। হাসানের ভিডিও ক্যামেরাটা থাকায় আমাদের বেশ সুবিধে হয়েছে। বড় ক্যামেরার যে কাজ শিখছি তাই প্রয়োগ করছি ভিডিও ক্যামেরাতে। বত্রিশ, ষোল না হোক আট মিলিমিটারে কিছু বানানো তো শিখে নিয়েছি ইতিমধ্যে। তাছাড়া থার্ড প্রফেশন্যাল হয়ে যাওয়ায় হাতে কিছুটা বাড়তি সময়ও আছে।

বেসরকারী মেডিকেলের স্যারেরা একটু ছাড় দিয়ে খাতা দেখে। আর সাপ্লিমেন্টারী তো মেডিকেলের আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। বাসা চেঞ্জ করেছি। অতবড় বাসায় অন্যদের সাথে বনছিল না বলে হাসান আর আমি বাসা ছেড়ে একটু ভেতরের দিকে বলতে গেলে গ্রাম এলাকায় বাসা নিয়েছি। বাসাটা নতুন।

এখনও কমপ্লিট হয়নি। আমরা দুজনই প্রথম ভাড়াটে। নিচতলার দরজা জানালা কমপ্লিট হলেও আমরা দোতলাটাই নিলাম। দোতলার প্লাস্টারের কাজ সহ কিছু কাজ এখনও বাকি। তাতে আমাদের অসুবিধে হচ্ছে না।

জানালার গ্রীল দেয়া না থাকলেও কপাট আছে। তাতেই কাজ চলে যাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেয়ে ঘটনা জানতে পারলাম। হামিদ ভাই বর্তমানে ফেরারী আসামী। কবর থেকে লাশ চুরির ঘটনার পেছনে যে হামিদ ভাই জড়িত পুলিশ জেনে ফেলেছে।

কিছুদিন আগে মিত্র বাড়ির যতীন খুড়োর আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়ায় পুলিশ ধারনা করছে হামিদই খুড়োকে গুম করে খুড়োর লাশের কংকাল ঢাকায় পাচার করেছে। যতীন খুড়োকে এখনও পাওয়া যায়নি। আমার একটু খারাপ লাগতে লাগল। কবর খুড়ে লাশ তোলার ঘটনার আমিই প্রথম পথ দেখাই। আর তার ফলেই হামিদ ভাই এই জঘন্য ঘৃণিত ব্যবসায় নেমে পড়ে।

আমি পথ না দেখালে হয়তো তার এই অধঃপতন হতো না। ঢাকায় ফিরে মনে মনে হামিদ ভাইকে খুঁজতে থাকি। ফেরারী আসামীর লুকিয়ে থাকার জন্য ঢাকা আদর্শ স্থান। এত মানুষের ভিড়ে হারানো খুব সোজা। আমাদের কলেজের কর্মচারী মামার কাছেও খোঁজ নিলাম।

তারপরে আর কোন লাশের কংকাল টংকাল বেঁচতে এসেছিল কি-না। নেগেটিভ উত্তর পেয়ে হামিদ ভাইকে খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছি। কালচারাল সেন্টার থেকে ফরাসী আর্ট ফিল্ম দেখে বাসায় ফিরলাম। হাসান যায়নি। বাসায় এসে দেখি আমার রুমের বিছানার উপরে হামিদ ভাই বসা।

যারপর নাই বিস্মিত হলাম। আমার পরিচয় দেয়ায় হাসান তাকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে। হামিদ ভাইকে কেমন যেন বিধস্ত উস্কোখুস্কো দেখাতে থাকে। জিজ্ঞেস করলাম ‘ কোথায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে এতদিন?’ হামিদ ভাই কাচুমাচু মুখে বলল, ‘ঢাকাতেই ছিলাম। একটা বস্তিতে।

কিন্তু সেখানকার বস্তি তুলে দিয়ে হাসপাতাল বানাচ্ছে। ’ ‘তোমাকে আগেই নিষেধ করেছিলাম হামিদ ভাই। তা তো শুনলে না। এখন তো শুনলাম মানুষ খুন করে নাকি কংকাল বের করা শুরু করেছো। ’ ‘বিশ্বাস করেন ছোটভাই।

যতীন খুড়োকে আমি খুন করিনি। কোন মানুষ খুন করে কখনও কংকাল নেয়নি। যতীন খুড়ো যখন হারিয়ে গেছে তখন আমি গ্রামেই ছিলাম না। শুধু শুধু আমার হয়রানি। ’ ‘তাহলে সে বুড়ো গেল কই? ‘তার আমি কি জানি।

গ্রামের কেউ হারিয়ে গেলেই আমার ঘাড়ে দোষ পড়বে নাকি? ‘যে কাজ করেছো তাতে তো পড়বেই। বুড়োকে খুঁজে বের করতে পারলে দোষ থেকে কিছুটা রেহাই পেতে। ’ ‘কোথায় খুঁজে পাব সে বুড়োকে। হয়তো ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। হিন্দু মানুষ তো!’ ‘এখন ঢাকায় করছোটা কি?’ হামিদ ভাই মাথা নিচু করে রইল।

তার মাথা নিচু দেখেই বুঝলাম এখানেও অবৈধ কাজ। যে কাজের কথা মাথা উঁচু রেখে বলা যায় না। ‘কি হামিদ ভাই, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজিটাজিতে জড়িয়ে পড়েছো নাকি? টেরর রাজ্যে ‘কংকাল হামিদ’ নাম হয়ে গেছে নাকি তোমার?’ হামিদ ভাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে, ‘না না সেসব কিছু না। তবে কাজটা ভাল না। বস্তিতে ডাইলের ব্যবসা ধরেছিলাম কিছুদিন।

বস্তি উঠে যাওয়ায় এখন বেকার। তাই ভাবলাম, তোমার সাথে একটু দেখা করি। যদি তুমি কোন কাজের খোঁজখবর দিতে পার। ’ ‘আমি কাজের কি খোঁজখবর দেব? আমি থাকি নিজের পড়াশুনায়। এক কাজ করো, তোমার যখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তখন আমার এখানে কিছুদিন থেকে কাজটাজ খোঁজ করো।

এটুকু সাহায্য করতে পারি তোমায়। ’ হামিদ ভাই কিছু বলল না। কিন্ত আমার এখানেই থাকতে লাগল। কাজটাজও তেমন খোঁজ করে না। খায় আর সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়।

থাকতে বলেছি কাজেই কিছু বলতে পারি না। কিন্তু এরকম বেকার ঘরে পড়ে থাকলে কে ওকে কাজ দেবে? এর মধ্যে একদিন সুযোগ এসে গেল। আমাদের নতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিছুটা এক্সটেনশন করা হয়েছে। অনেকগুলো বিভাগ বাড়ানো হয়েছে। এবং তার জন্য বেশ কিছু কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হবে।

আমি হাসান সহ কয়েক বন্ধু মিলে হামিদ ভাইকে কোথাও ঢোকানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করতে লাগলাম। চেষ্টায় সফলও হলাম। হা্িমদ ভাইয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা এত কম যে, রাতের শিফটে মর্গ পাহারা দেয়া ছাড়া আর কোন ক্যাটাগরীতে তাকে ঢোকানো গেল না। সেই চাকরি পেয়েই হামিদ ভাই কি খুশি! কবর খুঁড়ে লাশ তোলার জন্য একাকী রাতে মর্গে লাশ পাহারা দেয়ার চাকরি হামিদ ভাইয়ের কাছে ভয়ের কিছু মনে হলো না। চলবে...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.