প্রিন্স মাহমুদ
‘ব্যর্থ কবিরাই নাকি সফল উপন্যাসিক হন!’ তাহলে ব্যার্থ গায়কেরা? সফল সুরকার!
বলছিলাম বাংলা ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জনপ্রিয় সুরকার প্রিন্স মাহমুদের কথা। আসলেই কি প্রিন্স মাহমুদ গায়ক হিসেবে ব্যার্থ? নাকি সুরকার প্রিন্স মাহমুদের ঔজ্বল্যের কাছে ম্লান হয়ে গেছে গায়ক প্রিন্স মাহমুদ? প্রিন্স মাহমুদ গায়ক হিসেবে পুরোপুরি ব্যার্থ হলে ৯০ দশকের শুরুর দিকে অনেক কিশোর তরুনের মুখে মুখে ফিরত না, ‘বেলা শেষে/ ফিরে এসে /পাইনি তোমায়’। হ্যাঁ, আইয়ুব বাচ্চু নন, তাঁর কন্ঠে এই গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়ার বহু আগেই ‘বেলা শেষে’ গানটি গেয়েছিলেন প্রিন্স মাহমুদ! তিনি তখন ছিলেন বন্ধুদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড "দ্যা ব্লুজ" এর ভোকালিস্ট। সংগীতের ভূবনে প্রিন্সের এর পথ চলা শুরু হয় ৮০র দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে এই 'দ্যা ব্লুজ' ব্যান্ড এর ভোকাল ও গিটারিস্ট হিসেবে। এরপর ৯০ দশকের শুরুতে প্রিন্স গঠন করেন ‘ফ্রম ওয়েস্ট’ নামক একটি ব্যান্ড যেখানে ব্যান্ড লিডার এবং মূল ভোকাল ছিলেন তিনিই।
সেই ব্যান্ড এর আলোচিত একটি গান ছিল '' রাজাকার আলবদর কিছুই রইবো নারে/উপরে দালাল ভিতরে চোর কিছুই হইবো নারে/সব রাজাকার ভাইসা যাইবো বঙ্গোপসাগরে" গানটি। গানটি সেই সময়ে তরুন প্রজন্মকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল! ফ্রম ওয়েষ্ট এর প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম এর নাম ছিল 'সে কেমন মেয়ে'' । এছাড়াও ‘আবেগ’ নামে চমৎকার একটি মিক্সড অ্যালবামও বের হয় ব্যান্ড গুলো ছিল, 'ফ্রম ওয়েস্ট' অবসকিউর ও ডিফরেন্ট টাচ । এই অ্যালবামে আছে প্রিন্স মাহমুদ এর চমৎকার চারটি গান। কিন্তু তারপর? তারপর, তার আর পর নেই এর মত প্রিন্স মাহমুদেরও আর কোন খোঁজ নেই!
ফ্রম ওয়েস্ট - সে কেমন মেয়ে
এখানে উল্লেখযোগ্য যে আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে যে ''বেলা শেষে'' গানটি শোনেন সেটি হচ্ছে প্রিন্স মাহমুদ এর 'ফ্রম ওয়েস্ট' ব্যান্ড এর 'সে কেমন মেয়ে' অ্যালবাম এর 'বেলা শেষে' গানটির ২য় পর্ব।
১ম পর্বে প্রিন্স নিজেই গানটি গেয়েছিলেন যা বহু শ্রোতার অজানা। অ্যালবামের অন্যান্য গান গুলি হচ্ছে – আন্ধারেতে, অনন্যা ১, অনন্যা ২, বেলা শেষে, কলেজ জীবন, এই বুকেতে, এই মনটারে, যুগে যুগে, ও চাঁদ, পথে যেতে, পৃথিবীর সবকিছু, রাজাকার, সঙ্গী এবং সে কেমন মেয়ে।
নব্বইয়ের শুরুর দিকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ব্যান্ড মিক্সড বা মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু করেন এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্কের দলনেতা আশিকুজ্জামান টুলু (জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইমেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি)। তবে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম তখনও শক্ত আসন গড়তে পারেনি। তখন ব্যান্ড অ্যালবাম বলতে ব্যান্ড গুলোর একক অ্যালবামই বোঝাতো।
১৯৯৫ সাল। বাজারে এলো ''শক্তি'' নামের একটি ‘ব্যান্ড মিক্সড’ অ্যালবাম।
প্রিন্স মাহমুদের সুরে ব্যান্ড মিক্সড - শক্তি
প্রিন্স মাহমুদের সুরে ব্যান্ড মিক্সড ‘শক্তি’। 'ফ্রম ওয়েস্ট’ এর সেই প্রিন্স ৯৫ তে এসে হয়ে গেলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ‘প্রিন্স মাহমুদ’। এলাম দেখলাম এবং জয় করলাম, এর মতই নিমেষের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কিশোর তরুনের হৃদয় জয় করে নিল প্রিন্সের শক্তি! এই মাইলফলক অ্যালবামের শক্তি এতই বেশি ছিল যে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে মিক্সড অ্যালবাম এর ভিত্তিটা এমন শক্ত করে দিল যে এর পর থেকেই শুরু হল মিক্সড অ্যালবাম এর জয় জয়কার, যা চলছে অদ্যাবধি! 'শক্তি' অ্যালবাম এর শিল্পী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, ফজল, বাবনা, পার্থ , নকিবখান ও আজম খান।
অ্যালবাম এর প্রথম গান আইয়ুব বাচ্চুর 'পালাতে চাই’ এখনও মাঝে মাঝে কানে বেজে ওঠে, ‘যদি তুমি ভালবাস আমায়/শুধু সে কারনে আমি পালাতে চাই/ তোমারই কাছ থেকে আরও দূরে/ পালাতে চাই...!’ কিংবা জেমসের 'জানালা ভরা আকাশ'
ওরা এগারো জন
শক্তির পরে এল ‘ওরা এগারো জন’। যথারীতি জনপ্রিয়তা পেল এই অ্যালবামও। আইয়ুব বাচ্চুর আরেকটি হিট ‘আমার দুটি আকাশ ছিল’, খালিদের গাওয়া ‘কিভাবে কাঁদাবে’ তরুণদের মুখে মুখে ফিরেছে। ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে/ততটা মেঘ বুকে রেখেছি পুষে/কিভাবে আমায় তুমি কাঁদাবে বল!.........’
এর পর একে একে এল ‘ঘৃণা’, ক্ষমা, শেষদেখা। প্রত্যেকটি অ্যালবাম সুপার হিট! এর মাঝে ঘৃণা অ্যালবামে প্রিন্স মাহমুদের সুরে প্রথমবারের মত গান করলেন আরেক ব্যান্ড কিংবদন্তী মাকসুদ, আর্কের টুলু এবং হাসান।
‘শেষ দেখা’র দুইটি গানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চুর ‘শেষ দেখা’(যে তুমি কথা রাখোনি/কি লাভ এতদিন পর/...... আমার সমাধির পর/আমি চাইনা তোমার উপহার!) এবং আরেক লিভিং লিজেন্ড ‘জেমস’ এর গাওয়া ‘হতেও পারে’ (নীরবে, কি অভিমানে নিভৃতে/করছো, তিলে তিলে নিজেকে শেষ.../হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা/হতেও পারে এই গানই শেষ গান!)
ঘৃণা
এরপর এল ''এখনও দু চোখে বন্যা'' অ্যালবাম টি । জন্ম নিল আইয়ুব বাচ্চুর '' কতদিন দেখেনি দু চোখ'' , জেমস এর '' মা' গান দুটি। এই দুটি গানের জন্যই এই অ্যালবামটি আমাদের অডিও ইতিহাসে ঠাই করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে জেমসকে অমরত্ব দিল ‘মা’ গানটি।
যেসব বোদ্ধারা ব্যান্ড মিউজিকের কথায় নাক কুচকাতেন তাঁদেরও দ্বিতীয় বার শুনতে, দ্বিতীয় বার ভাবতে বাধ্য করল প্রিন্স এবং জেমসের ‘মা’!
(এভাবে অ্যালবাম বাই অ্যালবাম বিশ্লেষণ করতে গেলে পোষ্ট বিশাল হয়ে যাবে, কাজেই এবার সংক্ষেপে সারি!)
এভাবেই একের পর এক এল ''স্রোত'', ' ''দেয়াল, দুই হৃদয়ের মাঝে'' ‘চিঠির উত্তর দিও’ ''হারজিৎ'' পিয়ানো’ ''দহন, শুধু তোমার জন্য'। অসাধারণ সব অ্যালবাম! এগুলোর মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু এবং জেমস এর প্রথম ডুয়েট অ্যালবাম পিয়ানো বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে সর্বাধিক অ্যালবাম বিক্রির নতুন রেকর্ড গড়েছিল! এই অ্যালবাম নিয়ে আলাদা পোষ্ট দিতে হবে, শুধু উল্লেখ করি জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটার কথা!
‘তুমি মিশ্রিত লগন মাধুরির জলে ভেজা কবিতায়
আছো সরোয়ার্দী শেরেবাংলা ভাসানীর শেষ ইচ্ছায়...
... আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি!’
পিয়ানো - বছরের সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালাবাম
আর্কের বাইরে হাসানকে জনপ্রিয় করেছেন প্রিন্স মাহমুদই। হাসানের 'এত কষ্ট কেন ভালবাসায়’ তরুণদের মুখে মুখে বেড়িয়েছে।
শাফিন আহমেদের ‘আজ জন্মদিন তোমার’ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা বাংলাদেশ। যেখানেই যাই সেখানেই বাজে ‘আজকের পৃথিবীটা অনেক সুন্দর/দিন ছিল সূর্যে ভরা/আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর/সন্ধ্যাটা আগুন লাগা!) বাংলা মিউজিকে জন্মদিন নিয়ে এরচেয়ে ভাল বা জনপ্রিয় গান কি আর আছে?
খালিদের কোন গানটার কথা বলব? অথবা কোনটার কথা বলব না! ‘সরলতার প্রতিমা (তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা/তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা/আমি তোমাকে গড়ি ভেঙে চুড়ে শতবার/ রয়েছ তুমি...!), কোন কারনেই ফেরানো গেলনা তাঁকে, যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে, আবার দেখা হবে, ‘আকাশনীলা তুমি বল কিভাবে, যদি হিমালয় হয়ে দূঃখ আসে, হয়নি যাবার বেলা ......।
ক্ষমা
হাসানের ‘প্রশ্ন’(এতদিন পরে প্রশ্ন জাগে/শুধুই কি হেরেছি আমি/ হৃদয় ভাঙার সেই নিপুন খেলায়/ একটু কি হারনি তুমি!), মায়া, যে যায় ফিরে আসেনা, ভালবাসা ও অপরাধ (ভালবাসা যদি অপরাধ হয়/সে অপবাদ কাঁধে নিয়ে আমি/অনাদিকাল/সে অপরাধ/আমি তোমারই সাথে করে যাবো/গোধূলির রঙ্গে রাঙা হ্রদে হৃদয়/ভিজিয়ে তোমার ঐ মন ভেজাবো/ও সাজাবো, সাজাবো/আমি তোমাতেই স্বপ্ন অপার!’.................. ।
জেমসের ভূল, পাপী, ফুল নেবে না অশ্রু নেবে, এক নদী যমুনা, তুমি জানলেনা, জানালা ভরা আকাশ, সমাধি (ঐ ওপারের ডাক এসে গেছে/শেষ খেয়া বুঝি হবে পারি দিতে/ তুমি আসনি অভিমানী এই মনে/ অভিমান ভেঙে কোন খোঁজ নিতে /তুমি এসোনা ফুল দিতে/আমার সমাধিতে/ সেই সৌরভ মাটি পাবে সব/কিছু পারবনা আমি নিতে!).....................।
আইয়ুব বাচ্চুর পালাতে চাই, শেষদেখা, বেলাশেষে (বেলা শেষে /ফিরে এসে/ পাইনি তোমায়/ কৃষ্ণচূড়ার রঙে/ একেছি তোমায়!), কতদিন দেখেনি দুচোখ, .................।
শাফিনের ‘আজ জন্মদিন তোমার’, প্রতি রাতই নির্ঘুম রাত, জুয়েলের ‘তুমি বোঝোনি বন্ধুত্ব কি/ভালবাসা কাকে বলে’ ‘যদি কখনও অসহায়’ টিপুর ‘চাঁদ জাগা এক রাতে’ (চাঁদ জাগা এই রাতে/দুচোখের বরষায় ভিজে/ভাবছি তোমায়/জেগে জেগে রাত/তুমিও কি ভাবছো আমায়' .................. এই তালিকা শেষ হবার নয়! কাজেই ক্ষান্ত দিলাম আজকের মত!
দেয়াল - দুই হৃদয়ের মাঝে
পুরো ৯০ এর দশক শেষ হলো প্রিন্স মাহমুদ এর অসাধারণ সব গানের মধ্যে দিয়ে। যে গান গুলো একই সাথে রুচিশীল এবং জনপ্রিয়।
এবং কিছু কিছু গান তো অবশ্যই কালজয়ী!
বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাস লেখা হলে সেখানে ‘প্রিন্স মাহমুদের যুগ’ নামে একটা অধ্যায় অবশ্যই থাকবে! বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এই অঘোষিত যুবরাজের এই গানগুলি অনন্য সংযোজন হিসেবে টিকে থাকবে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসের পাতায় এবং ব্যান্ড মিউজিক প্রেমীদের হৃদয়ে!
প্রিন্স মাহমুদের নিজের প্রিয় দশ গানঃ
১. খালিদের- কোন কারণেই ফেরানো
২. জুয়েলের- যদি
৩. আইয়ুব বাচ্চুর- বার মাস
৪. হাসানের- এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়
৫. জেমসের- বাংলাদেশ
৬. হাসানের- প্রশ্ন
৭. আইয়ুব বাচ্চুর- পালাতে চাই
৮. জেমসের -মা
৯. মাহাদীর- সুণীল বরুনা
১০. খালিদের- যদি হিমালয় হয়ে
প্রিন্স মাহমুদ
(প্রিয় প্রিন্স মাহমুদ, সুস্থ এবং সুন্দর সব গান উপহার দিয়ে আমার এবং আমার মত অসংখ্য মানুষের কৈশোর এবং তারুন্যকে ভাসিয়েছিলেন অপার ভাল লাগায়। এই লেখাটি আপনার জন্য!)
*লেখাটি লিখতে গিয়ে প্রিন্স মাহমুদ ভক্তদের বিভিন্ন পোষ্ট থেকে বিভিন্ন তথ্য (ভাল লাগা দুএকটা লাইনও) নেয়া হয়েছে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।