নীলিমা চোখ বড় বড় করে তাকাল সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয় হাসলো ওর কথা শুনে। নীলিমার মাথাট ডান হাতে একটু নাড়িয়ে দিয়ে বলল--
--দীর্ঘ ঊনিশ বছর কি সেজে থাকা যায়? তুমি কি পারো?
--ভাবতেই পারি না। তবে সত্যি, মল্লিকা কিছু না বললেও বুঝি ওর চারপাশে একটা অসহনীয় শূন্যতা আছে--
--কিজন ওর হাজব্যাণ্ড কিন্তু প্রেমিক নয়--
--কিন্তু তুমিও তো হাজব্যাণ্ড--
--আগে আমি প্রেমিক, পরে হাজব্যাণ্ড--
--তাহলে মল্লিকার কি হবে?
--অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তুমি কি বলতে পারো নীলাঞ্জনেরও কি হবে?
--নীলাঞ্জন!
নীলিমা ঘুরে মুখোমুখি বসলো সঞরজয়ের।
--হ্যাঁ, নীলাঞ্জনের চারপাশেও এক অসহনীয় শূন্যতা রয়েছে। আমার সঙ্গে কাজ করে । আমি ওর ভেতরের অস্থিরতা টের পাই।
--মল্লিকা কিন্তু নীলাঞ্জনের প্রসঙ্গে কেমন আলোকিত হয়ে ওঠে। আমি লক্ষ্য করেছি।
--মার্ভেলাস!
--কি হলো?
--এই যে বললে 'নীলাঞ্জনের প্রসঙ্গে আলোকিত হয়ে ওঠে!' একটিমাত্র বাক্যে পুরো মহাভারত প্রকাশ পেয়ে গেল। তুমি লেখো বলেই এমন একটা বাক্য উচ্চারণ করতে পারলে--
--তবু ভালো! আমি ভাবলাম না জানি কি--
--নীলাঞ্জন মল্লিকার প্রেম--
--কিন্তু বিজন?
নীলিমা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো--
--অধিকারবোধে আচ্ছন্ন মল্লিকার হাজব্যাণ্ড। প্রেমিক নয়। মল্লিকা ওর ব্যবহার যোগ্য সাংসারিক একটা জৈব উপকরণ মাত্র।
--আর নীলাঞ্জনের বউ অঞ্জলি?
--বিজনের মতোই অনেকটা অধিকারবোধে কঠিন স্ত্রী--প্রেমিকা নয়।
--তাহলে!
নীলিমাকে দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে।
--মল্লিকা যে কোনো মূল্যে নীলাঞ্জনের প্রেম পেতে পারে। নীলাঞ্জন ও মল্লিকার প্রেম--
--কিন্তু জীবনে নৈতিকতার তো একটা প্রশ্ন আছে--
--সৃষ্টিশীল জীবন নৈতিকতার দাসত্বে চালিত হয় না। আর তাছাড়া ঐ নৈতিকতা শব্দটা তো পুরোপুরি গেরস্থালী শব্দ--
--গেরস্থালী বাদ দিয়ে তো জীবন হয় না--
--গেরস্থালী গৃহস্থের জন্যে। গৃহস্থরাও সৃজনশীল হতেই পারে।
সেক্ষেত্রে নৈতিকতা কোনো সমস্যা হবে না যদি তারা তোমার আর আমার মতো হয়। দু'জন দুজনের শূন্যতাকে যদি গ্রাস না করতে পারে নীলিমা, তাহলে নৈতিকতার ঢাল ব্যবহার করে আত্মরক্ষার চেষ্টাটা অর্থহীন হয়ে ওঠে।
--তাহলে কি মল্লিকা আর নীলাঞ্জন--
--ওদের নিয়ে ভেবো না। ওরা যদি পরস্পরের শূন্যতা গ্রাস করে নিতে পারে নিক্ না!
উপসংহার :
পরিচালন সমিতির এক সদস্যের মৃত্যুতে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। নীলাঞ্জনের আসার কথা সাড়ে এগারোটায়।
স্কুলের বাইরেই দেখা করা ভালো ভেবে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে পড়লো মল্লিকা। নীলিমাও উঠে পড়লো। দুজনে একসঙ্গে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে গেটের পাশে দাঁড়ালো। মিনিট পাঁচেক দেরী আছে এখনো।
--তোর শরীরটা কি ভালো নয় মল্লিকা?
--উঁ? না ভালোই তো আছি--
মল্লিকা চমকে উঠলো।
নীলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
--রাত্রে ঘুম হয়নি বুঝি?
--না। আসলে লেখাটা শেষ করার ছিল--তুমি তো জানো--
--কারুর জন্যে অপেক্ষা করছিস?
--হ্যাঁ--মানে--
--নীলাঞ্জন আসবে?
--মানে লেখাটা তো ওকেই দিতে হবে--
--এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? এক কাজ কর, নীলাঞ্জনের অফিস তো সেই বেলা চারটেয়। তুই বা এত সকাল সকাল বাড়ি ফিরে কি করবি? চাবিটা রাখ--আমার ঘরে ফিরতে ফিরতে সাড়ে তিনটে বেজে যাবে--একটা অনুষ্ঠানে যাবো--সঞ্জয়ও যাবে--
--না না--তোমরা কেউ থাকবে না--
--তোরা তো থাকবি। গল্পগুজব করবি।
কিচেনে কফি-মেকার আছে--এক মিনিটে দু'কাপ কফি! রাস্তায় ঘুরবি নাকি? নে রাখ--
প্রায় জোর করে মল্লিকার হাতে ঘরের চাবিটা গুঁজে দিল নীলিমা। মিনিবাস থেকে উল্টো দিকের ফুটপাতে নেমে দাঁড়িয়েছে নীলাঞ্জন। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবী। । কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ।
দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল শেভ্ করেনি।
--নীলাঞ্জন এসে গেছে। ভাবিস না কিছু। নিজের মনের নির্দেশকে উপেক্ষা করে জীবনটাকে বিষাক্ত করিস না, কেমন?
বিস্মিত মল্লিকার হাতে মমতার স্পর্শ গুঁজে দিল নীলিমা।
--স্কুল ছুটি হয়ে গেল নাকি?
--হ্যাঁ।
নীলাঞ্জন, অনেকদিন তুমি আমাদের ওখানে যাও না--দাদার সঙ্গে ঝারপিট হয়নি তো?
নীলিমার চোখে স্পষ্ট কৌতুক লক্ষ্য করে হেসে ফেললো নীলাঞ্জন।
--না না বৌদি, সেসব কিছু নয়--আসলে সময়টাই কারণ--
--ঠিক আছে। আজ মল্লিকাকে নিয়ে যাও। চাবি দিয়ে দিয়েছি। আমরা সাড়ে তিনটের মধ্যেই ফিরবো--
--সে কী! কিন্তু--
হাত নাড়তে নাড়তে একটা মিনিবাসে উঠে পড়লো নীলিমা।
--ভালোই হলো--ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ কথা বলি--
--কিন্তু সঞ্জয়দা কি ভাববেন?
মল্লিকা ইতস্তত: করছিল। নীলাঞ্জন বললো--
--নীলিমা বৌদি যা ভাববেন সঞ্জয়দাও তাই ভাবেন। অন্যরকম কিছু ওরা ভাবেন না--
--খুব আশ্চর্য মনে হয় না?
--হয়। তবে এটাই তো হওয়া উচিত।
--অথচ কেন যে হয় না!
ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে হাতটা কেঁপে গেল মল্লিকার ।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রাখা যায় না। অথচ বন্ধ করতেও কোথায় ডেন দামামা বাজে!
--তোমার লেখাটা এনেছো?
--হ্যঁ, এই নাও--
ব্যাগ থেকে লেখাটা বের করে নীলাঞ্জনের হাতে তুলে দিল মল্লিকা। নীলাঞ্জন দ্রুত শেষের দিকের পাতাগুলো চোখের সামনে মেলে ধরলো। মল্লিকা একটা চেয়ারে বসে ব্যাগটা টেবিলের কোণায় রেখে আঁচল দিয়ে ঘাড়-গলা-মুখ মুছে নিল। টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মল্লিকার সদ্য সমাপ্ত কাব্যনাটক পড়ছে মন দিয়ে নীলাঞ্জন।
নীলাঞ্জনের আজকের চেহারায় কোথায় যেন একটা ঝড় শেষের ছাপ ফুটে উঠছে। প্রতিদিন নিয়ম করেই শেভ্ করে। আজ করেনি। অফিস যাওয়ার সময়টুকু ছাড়া অন্য সময়ে সাধারণত: পাজামা-পাঞ্জাবী পড়লেও সেগুলো পাটভাঙ্গা ঝকঝকে লাগে। আজ মনে হচ্ছে কয়েকদিনের ব্যবহৃত পোশাক-ই পরেছে।
--যেমনটা শেষ হওয়ার কথা ছিল তেমনটাই হয়েছে। তবে কয়েকটা শব্দ এবং লাইন যদি একটু বদলে দাও তাহলে মনে হয়--
--করে দাও--
পেন খুলে নীলাঞ্জনের হাতে ধরিয়ে দিল মল্লিকা।
--তুমি করলেই তো ভালো হতো!
নীলাঞ্জনের দ্বিধা দেখে খুব নরম করে একটু হাসলো মল্লিকা--
--এই পর্যন্ত যে আমি এসেছি তা তো তোমারই জন্যে নীলাঞ্জন! প্রথম পরিচয়ের পর থেকে তুমি আমাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছো। এখন তোমার এত দ্বিধা কেন?
--না--তা ঠিক নয়--
--ঠিক করে দাও--প্লিজ!
নীলাঞ্জন প্রয়োজনীয় শব্দ বদল করে করে মল্লিকাকে শোনালো। মুগ্ধ বিস্ময়ে মল্লিকা নীলাঞ্জনের মেধার কথা ভাবছিল মনে মনে।
ঠিক এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল--
--এখন এটা আমি জমা দিয়ে দিতে পারি--
--তোমার গল্পটা দাও, পড়ি--
মল্লিকা হাত পাতলো। নীলাঞ্জন ম্লান হাসলো একটু। বলল--
--আমি আর লিখবো না মল্লিকা। আমাকে দিয়ে আর এসব হবে না।
ঝড়ের সন্দেহটা সত্যি মনে হলো মল্লিকার।
নি:শব্দে উঠে নীলাঞ্জনের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জনের মাথাটা দু'হাতে টেনে নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে মল্লিকা বলল--
--এক্ষুণি এখানে বসে লেখাটা তুমি শেষ করবে। কোনো কথাই আমি শুনবো না। তুমি না লিখলে আমি লিখবো কি করে!
--আর তা হয় না--
--হতেই হবে। আমি জানি অঞ্জলি বৌদির হেনস্থায় তুমি ভেঙ্গে পড়েছো। আমার কথাটা তো তুমি জানো না--জানলে তুমি নিজেকে এত দুর্বল ভাবতে না--
--লেখার জন্যে ভাবার জন্যে জীবনে দু'একটা খোলা জানলার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি মল্লিকা--
--জানি।
আমিও ভীষণভাবে ফিল করি সেটা। আমারও দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। আমরা কি পরস্পরের খোলা জানলা হতে পারি না?
নীলাঞ্জনের এলোমেলো চুলের মধ্যে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণপণে নিজের আবেগ সামলাবার চেষ্টা করে মল্লিকা।
--কিন্তু সমাজ সংস্কার!
--থাকুক না যে যার জায়গায়।
--কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত?
--লেখার মধ্যেই গড়ে উঠুক না কেন!
নীলাঞ্জন হাত বাড়িয়ে মল্লিকাকে সামনে টেনে এনে ওর চোখে চোখ রাখলো।
মল্লিকা নীলাঞ্জনের মুখটা নিজের দুই করতলের মধ্যে ধরে বলল--
--কতদিন তোমার মুখটা এইভাবে ধরে আমি অজস্র কথা বলেছি জানো! দু:খে যন্ত্রণায় তোমার এই চোখ এই মুখ আমাকে কিভাবে রক্ষা করেছে তুমি জানো না--
নীলাঞ্জন দুহাতে মল্লিকার কোমর জড়িয়ে ওর বুকের নিচে মাথাটা গুঁজে দিল নি:শব্দে। মল্লিকা ফিস ফিস করে বলে উঠলো--
--নীলাঞ্জন! আজ এই প্রথম নিজেকে আমার মেয়ে-যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে না--আমার শরীর আমি ফিরে পাচ্ছি, বিশ্বাস করো!
(শেষ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।