অ।
চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে বের হওয়ার সময় মবিন দরজায় উস্টা খায়।
মবিন গ্রামের প্রায় অসচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে, ঢাকাতে এসেছিল সে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে। কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত তার, কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর বন্ধুদের সাথে মেসে উঠতে হয়। জীবন যাপনের খরচ তো কম না এই শহরে, ফলে, অন্তত বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একটা চাকরি তার খুব প্রয়োজন হয়ে পরে।
যেহেতু তার বারা অবসর জীবন যাপন করেন, ফলে সংসারের হাল ধরার জন্যেও তার একটা চাকরি খুব দরকার। নাকি এই সব কিছুর চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ন ছিল তার একটা চাকরি পাওয়া, কেননা, সে তো শিরিন কে বিয়ে করতে চেয়েছিল।
মবিন কি চাকরীটা পায়? হয়ত সে চাকরীটা পায়, অথবা পায় না; তবু এখানেই এ গল্পের শুরু।
আ।
শিরিন ছিল মবিনের ক্লাসমেট, একসাথে পড়াশোনা।
একসাথে থাকার সপ্ন দেখত কি তারা কোন পার্কে বসে বাদাম চিবানোর ফাঁকে? শিরিন শহরের মেয়ে, মবিনের গ্রাম্য সরলতা হয়ত আকর্ষন করত তাকে, মবিনও যে সেটা বুঝতে পারে নাই তা তো না। ফলে, ভালবাসে তারা, বিয়ে করতে চায়। তো, বিয়ে করার আগে মবিনের চাকরি পাওয়া প্রয়োজন হয়ে পরে, তাই মবিনের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত শিরিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে বের হওয়ার সময় মবিন দরজায় উস্টা খায়।
তো যাই হোক, অবশেষে হয়তো মবিন চাকরীটা পায়।
তারপর সে শিরিন কে বিয়ে করে। গ্রামে মায়ের কাছে টাকা পাঠায় সে, বোনের বিয়েতে গয়না বানাতে দেয়। গ্রামে দু একটা ছোট জমিও হয়ত রাখে সে, বৃদ্ধ বাবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। মবিনের বাল-বাচ্চা হয়, আস্তে আস্তে সে বুইড়া হয়ে যায়। অতঃপর, একদিন মবিন মইরা যায়।
এখানে একটা গল্প শেষ হয়, কিন্তু এর বাইরেও কি আরও কোনো গল্প থাকতে পারে?
সে গল্পের প্রয়োজনেই হয়তো মবিন মরে না।
ই।
প্রেমের প্রথম দিনও মবিন দরজায় উস্টা খেয়েছিলো।
হয়তো এই কারনেই শিরিন সিরাজের সাথে ভাইগা যায়; ফলে, মবিন শিরিন কে পায় না। ঠিক একই কারনে হয়ত তার চাকরীটাও হয় নাই।
বেকার মবিনকে শিরিন বিয়ে করে নাই ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিনের ভালবাসা তাদের। ফলে, ভাইগা যাওনের আগের দিন মবিনকে সে জানায়- মরনের দিন আমি তোমার পাশে থাকব। চাকরী তো আর নাই তোমার কপালে, যারা নাকি উস্টা খায়, তাদের তো কখনো চাকরী হয় না। জীবনে কখনো বিয়া করতে পারেনা তারা। সে এই কথাও বলে দেয় যে, উস্টা খাওয়া রোগ মরনের আগে সারে না।
তারপর মবিন আবার ইন্টারভিউ দিতে যায়, ইনটারভিউ ফেস করার আগে আবার সে উস্টা খায়, ফলে এইবারও সে চাকরি পায় না। অথবা শিরিন যেদিন তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সেদিনও সে উস্টা খাইছিলো- দরজার চৌকাঠের লগে; তাই তাদের বিয়ে হয় না।
ঈ।
একদিন মবিন মিস্ত্রি ডেকে দরজার প্রশস্ততা বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু বাড়িওলার ছোট জামাই বাধা দিলে সে অত্যন্ত অসহায় বোধ করে; নয়াপীরের শরনাপন্ন হয় তখন সে। নয়াপীর তো খুব কামেল লোক, তার তাবিজের ক্ষমতার কথা কে না জানে? প্রবল বিশ্বাসে মবিন নয়াপীরের তাবিজ আইনা তার ঘরের চৌকাঠে ঝুলায়া রাখে ।
তার মনে হতে থাকে যে, এইবার হয়তবে সব বিপদ কাতবে তার, শিরিনও হয়তো আবার ফিরে আসবে তার কাছে ।
কিন্তু,তবুও সমস্যা মেটে না তার। চাকরী তো হয়ই না, এমনকি উস্টা খাওয়া রোগও সারে না । ফলে, আবারও নয়াপীরের শরনাপন্ন হয় সে। কামেল লোক নয়াপীর স্বভাবে দার্শনিক, ফলে মবিনকে এবার সে বলে, 'মিয়া,বেহেস্ত থেকা আদম যখন উস্টা খাইয়া দুনিয়াতে আইসা পড়লো, তখন থেকাই আমাগো সবতের কপালে উস্টা লেখা হয়া আছে।
সারনের তো কোনো কায়দা নাই!’ (এইটা এই গল্পের ভিতরে একটা দর্শন গছিয়ে দেয়ার চেস্টা মাত্র, যেহেতু সব গল্পের ভিতরেই একটা দর্শন থাকা দরকার)
উ।
কোন একদিন রাতে হয়তো শিরিন কে স্বপ্নে দেখে সে। দেখে যে, সে বসে আছে পার্কে, তার হাতে প্যাকেট ভরা বাদাম। এই বাদাম কোথা থেকে আসলো তার হাতে, কিভাবে, কিছুই মনে করতে পারে না সে। শুধু বাদাম ছিলে খাওনের সময় শিরিনের কথা মনে পরে তার।
ফলে, শিরিন কে ডাকতে যায় সে; দূর থেকে শিরিনকে ফুল ছিড়তে দেখে সে। তাকে ডেকে বলে, শিরিন,এই দেখ, এইখানে এত বাদাম আমার কাছে, আর তুমি দূরে বইসা ফুল ছিড়? চল, আমার লগে, গায়ে হেলান দিয়া বইসা বাদাম খাইবা তুমি। শিরিন খিলখিল করে হেসে উঠে যেন, একটু পরে কি ভেবে আবার মনমরা হয়ে পরে। তারপর বলে, এই বাদাম তো আমার কপালে নাই, আমার কপালে আছে খালি উস্টা। মবিন ভাবে, সত্যিই তো তাই।
সে দেখে যে, তার হাতের প্যাকেট বাদামের খোসায় ভর্তি, এক দানা বাদাম নেই সেখানে! ঘুম ভেঙ্গে যায় তার।
মবিন কখনো বিয়ে করে না, অথবা যেদিন তার আত্নীয়-স্বজনেরা তাকে শিরিন ছাড়া অন্য কারো না কারো বিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন সে পুনরায় উস্টা খায়। ফলে সেদিনও সে বিয়ে করতে পারে না।
ঊ।
অতঃপর, এভাবেই জীবন-যাপন শেষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে মবিন; কারন শিরিন হয়ত তাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখে, অথবা মৃত্যু শিরিনের জন্য।
সে বুইড়া হতে হতে মুমূর্ষ হয় দিনে দিনে, এবং একদিন নয়াপীরের তাবিজটা দরজার চৌকাঠ থেকে খুলে ডোবার পানিতে ফালায়া দেয়। তার চোখগুলি দিনে দিনে আধবুজা হইতে হইতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়- আর সে অপেক্ষা করতে থাকে মৃত্যু, অথবা শিরিন, অথবা উভয়ের জন্যই।
কিন্তু শিরিন আসার পুর্বেই বুঝি মৃত্যু চলে আসে।
তবুও আমরা দেখতে পাই যে, মৃত্যুর আগে মবিনের চোখদুটি হটাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- যখন সে দেখে নেয়- যেন মৃত্যু উস্টা খায়; তার ঘরের চৌকাঠে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।