আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপজেলা পরিষদে সাংসদের ভূমিকা প্রশ্নে সরকারের নয়া অবস্থান: একজন শংকিত নাগরিকের প্রতিক্রিয়া

munirshamim@gmail.com
ক. রাজনৈতিক ময়দানে এখন পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি চরমশতত্রুভাবাপন্ন প্রধান দুই দল আ'লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বেশির ভাগ বিষয়ে চরম অমিল থাকলেও স্থানীয় সরকার প্রশ্নে একটি ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ মিলটি কোন কাকাতালীয় ঘটনা নয়। বরং দু'দলের নীতিনির্ধারকদের সচেতন চিন্তা ও কার্যক্রমেরই বহি:প্রকাশ বলে মনে হয়। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরুধী আন্দোলন পরবর্তীতে বিএনপি ও আ'লীগ দু'দলই পালক্রমে দু'বার করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় এসে যে মন্ত্রী পরিষদটি তারা গঠন করেছেন তাতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রতিবারই দলের মহাসচিব এর কাছে ছিল।

এটি বিএনপির ক্ষেত্রে সত্যি। আ'লীগের ক্ষেত্রেও সত্যি। এ সত্যের ধারাবাহিকতা আমরা এবারও দেখলাম। ফলে এবার যখন ঘোষণার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জানা যায়নি মহাজোটের মন্ত্রী পরিষদে কারা থাকাছেন এবং কে কোন মন্ত্রণালয় পাচ্ছেন তখনও পর্যবেক্ষকরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং মূখপাত্র আশরাফুল ইসলামই হচ্ছেন। এবং শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষকদের ধারণাই সত্যি হলো।

খ. স্থানীয় সরকার প্রশ্নে বিএনপি ও আ'লীগের উপরোক্ত ঐতিহাসিক অভিন্ন অবস্থানের আপাতত একটি ইতিবাচক ব্যাখ্যা হতে পারে। বলা যেতে পারে যে, দু'টি দলের কাছেই শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে তৃণমূলে গণতন্ত্রায়ন সম্ভব নয়। স্থানীয় উন্নয়নও সম্ভব নয়। সুতরাং এ রকম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অবশ্যই দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেই দিতে হবে।

আর সে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিই হচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এটি মূদ্রার একটি পিঠ। আর অন্য পিঠটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কব্জা ও দলীয়করণের আকাঙ্খা। দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের সুগভীর চিন্তা। এখন প্রশ্নটি হচ্ছে আমাদের বিগত ১৫ বছরের (বিএনপির ১০ বছর এবং আ’লীগের পাঁচ বছর) পর্যবেক্ষণ মূদ্রার কোন পিঠটিকেই বেশি সত্য এবং কার্যকর হয়েছে বলে মনে হয়।

আমরা কি বিগত ১৫ বছরের রাজনৈতিক সরকারের আমলে স্বাধীন ও কার্যকর স্থানীয় সরকার পেয়েছিলাম? আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলো কি দলীয় প্রভাব (মন্ত্রী, সাংসদ) মুক্ত হয়ে কাজ করতে পেরেছিলেন? স্থানীয় জনগণের আকাঙখা কেন্দ্রীক স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয় উন্নয়নে ব্রতি হতে পেরেছিলেন? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, না। যদি তাই হয় তাহলে এটিও সত্যি যে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিব এর কাছে রাখার ধারাবাহিক প্রবাণতা যতটা না কার্যকরভাবে স্থানীয় সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে তার চেয়ে অনেক বেশি সীমিত দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের আকাঙ্খা থেকে। যে আকাঙ্খার পুন:পৌনিক প্রতিফলন পর্যবেক্ষণ করার দুর্ভাগ্য নাগরিক হিসেবে আমাদের বহুবার হয়েছে। স্থানীয় সরকার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে না বলে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মধ্যে দলবদলের মহরত অনুষ্ঠানও দেখি। এ সব প্রবণতা শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকার হিসেবে বিকশিত হতে দেয়নি।

আর দেয়নি বলেই বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ নাগরিকদের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা হওয়ার পরিবর্তে নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও হীন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অকূলস্থল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যা কার্যত তৃণমূলে গনতন্ত্রায়নের জনআাকাঙ্খাকেই পিছিয়ে দিয়েছে। গ. চারস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকারের দাবি অনেক দিনের। আমরা পরপর তিনটি নির্বাচিত সরকার পেলেও কেউ সে জনদাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে চারস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। আমলাতন্ত্রের ভেতর থেকেও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আপত্তি রয়েছে বলে শোনা যায়।

ফলে অনেক দিন ধরে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হতে পারেনি। সদ্য বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে কয়টি প্রশংসাসূলভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। উপজেলা পরিষদ সহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে তারা স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশও জারি করেছে। এ অধ্যাদেশের একটি অন্যতম দিক হচ্ছে স্থানীয় উন্নয়ন এর কার্যক্রমগুলো শতভাগ স্থানীয় সরকার পরিষদের হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং স্থানীয় সরকারকে সাংসদদের প্রভাব মুক্ত রাখা। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাংসদদের কাজ প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ণ ও নীতিনির্ধারণ।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সাংসদরা আইন প্রণয়নের পরিবর্তে অনেক বেশি উৎসাহবোধ করেন স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া বা যুক্ত থাকার প্রতি। নিকট ইতিহাস বলে সাংসদদের এ ধরনের যুক্ততা আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রকে যেমন শক্তিশালী করতে পারেনি তেমনি স্থানীয় সরকারের স্বাভাবিক বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করেছে। ঘ. অনেক রাজনৈতিক দোলাচালের পরও আশার কথা হচ্ছে আজ সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে বহু আকাঙ্খিত উপজেলা পরিষদ গঠিত হবে। তত্ত্ববাধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ অনুযায়ী আমরা আশা করেছিলাম যে, অনেক দিন পর জনগণ একটি শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ পেতে যাচ্ছে।

যেটি স্থানীয় উন্নয়নে দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে মিনি পার্লমেন্ট হিসেবে কাজ করবে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত উপজেলা পরিষদের যে গঠনটি রয়েছে তাতে উপজেলার উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত উপজেলা পরিষদ নিবে। তাতে স্থানীয় সাংসদের হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। উপজেলা পরিষদে সকল ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিত্ত্ব এবং নারী প্রতিনিধিত্ব থাকায় আশা করা যায় ইউনিয়ন ও গ্রামগ্রলোর প্রয়োজন, চাহিদার প্রতিফলন ঘটবে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তে। অপরদিকে ইউএনও সহ উপজেলা পর্যায়ের সকল সরকারী কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদের কাছে দায়িত্বশীল থাকায় জনপ্রতিনিধির কাছেও তাদেরও জবাবদিহীতা নিশ্চিত হবে।

তাদের ভূমিকাটা প্রধানত হবে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। কিন্তু ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইংগীত দিয়েছেন যে, উপরোক্ত অধ্যাদেশে কতিপয় সংশোধনী আনা হতে পারে। যার মধ্যে দিয়ে আবারও স্থানীয় সাংসদদের যুক্ত করা হবে। তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে স্থানীয় সাংসদদের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য থোক বরাদ্দের কথাও বলেছেন। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের আশান্বিত করতে পারছে না, বরং সরকারের এ চিন্তা আমাদের শংকিত করে তুলছে।

স্থানীয় সরকার কমিশন ইতোমধ্যে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তাদের মতে থোক বরাদ্দ ভারতেও কাজ করেনি বরং সেখানেও এর মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। তারা আশংকা করছেন এখানেও সেরকম হতে পারে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয় উন্নয়নে সাংসদদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখলে তারা যদি সংসদে অধ্যাদেশটি পাশ না করেন তাহলে উপজেলা নির্বাচনই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা মনে করি না এ ধরনের শংকার কোন কারণ আছে।

আ’লীগ যদি দলীয়ভাবে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়, দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাংসদদের কাজ আইন প্রণয়ণ, তবে সংসদে তাদের সাংসদরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে দাঁড়াবে। বা দাঁড়াতে পারবে। তাছাড়া বর্তমান বিধান অনুযায়ী দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সাংসদদের দাঁড়ানোরও কোন সুযোগ নেই। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সরকারকে বিনীত অনুরোধ করবো আমরা স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী পরিষদের যে সম্ভবনা দেখে আশায় বুক বেঁধেছি আমাদের সে আশা যেন শুধু দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় শেষ করে দেয়া না হয়। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

এ দায়িত্বের প্রতি যেন সরকার অবিচল থাকে সেটিই হবে আমাদের অনুরোধ, প্রত্যাশা এবং কামনা। আমরা দু’টি প্রধান দলে বিভক্ত স্থানীয় সরকার পরিষদ চাই না। আমরা সত্যিকারের শক্তিশালী স্থানীয় সরকার চাই। যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাটিও হবে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি নিবেদিত হবে শুধু স্থানীয় উন্নয়নের কার্যক্রমে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.