আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাঙ্কি রুট পর্ব-৮

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

ডাঙ্কি রুট- পর্ব ৮ .. .. .. ওরা বিশজন। লোহার এক খাচায় বন্দি। পেট্রলের দম আটকানো ঝাঝালো গন্ধ আর নিকষ অন্ধকার অনুভুতিকে একদম ভোতা করে দিয়েছে। সবার মনে একটাই শুধু আক্ঙ্খা সেটা হল কোন মতে একবার আলোময় সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া। লোহার খাচা এগিয়ে চলছে হেলে দুলে।

পিচঢালা পথ আর চাকার ঘর্ষন সেই সাথে মিলে আছে ইঞ্জিনের আওয়াজ কয়েকগুন হয়ে এদের কানে ভয়ঙ্কর হয়ে বাজছে। ওদের মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন শুধু ভয়ঙ্কর শব্দ আর ঝাঝালো গন্ধময় অন্ধকার প্রেতপুরী। এভাবে অনেক্ষন। একসময় গাড়ি থেমে গেল। তারও সামান্য সময় পরে মাথার উপর ঘস ঘস ভোতা শব্দ হতেই সবাই মাথা তুলে উপর দিকে তাকাল।

হ্যা ওইতো খুলে যাচ্ছে .. তার মানে আমরা আবার দেখব পৃথিবী! প্রান ভরে শ্বাস নিতে পারব! বাইরে বেরিয়ে আসতেই প্রচন্ড শীতের ঝাপটায় সবাই চোখে মুখে অন্ধকার দেখল। ভেবেছিল হয়তো বুখারেস্টে পৌছে গেছে। কিন্তু তাদের ছেড়ে লরি চলে যেতেই ওরা নিজেদের আবিস্কার করল ঘোর অন্ধকারময় বরফের মরুভুমিতে। রোমানিয়ান গাইড ভাঙ্গা রুশ ভাষায় হিস হিস করে উঠল- ‘রিবেয়েতা- পাইদ্জুম বিস্ত্রা। -- দাভায়!’ ও ভেবেছিল ওরা রুশ ভাষা বোঝে।

কিন্তু এ বঙ্গসন্তানরা কন্ঠ শুনে বুঝতে পারে কে কি বলতে চাইছে। ওরা একসঙ্গে শুরু করল দৌড়, পেট্রলে ভিজে যাওয়া জুতা জোড়াকে অনেক বেশী ভারি মনে হচ্ছে। বরফে সেধে যাচ্ছে গোড়ালি ছাড়িয়ে কখনো হাটু পর্যন্ত। অভ্যেস নেই! ওরা গায়ে গা লাগিয়ে এলো মেলো পা ফেলে ছুটে চলছে গাইডের পেছনে। একটু অসতর্ক হলেই ওকে হারিয়ে ফেলতে পারে চিরতরে! তারপর এই বরফের রাজ্যে ....ভাবার সময় নেই।

ছুটছে ওরা সবাই কখনো হাচড়ে পাচড়ে ছোটখাট পাহাড় ডিঙ্গিয়ে,পাইন বনের উচুনিচু পথ বেয়ে কখনোবা নদী কিংবা ডোবার উপরে জমে থাকা বরফের পাতলা আস্তর মাড়িয়ে। কোন কোন স্থানে বরফ এত পাতলা যে সামান্য চাপে হুড়মুড় করে ভেঙে হিম শীতল পানিতে তলিয়ে দু মিনিটেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। অবশ্য এ মরনে কস্ট কম! হঠাৎ উজ্জল তীব্র সাদা আলো চোখ ধাধিয়ে দিল সবাইকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাড়িয়ে পড়া। আমরা কি স্বর্গের দ্বারে এসে পৌছুলাম নাকি? ইহকাল মনে হয় সাঙ্গ হয়েছে, পরকালের পথেই হয়তো দৌড়াচ্ছি! ওদিকে বিস্ফোরিত নেত্রে হাপ ধরে আসা চাপা কন্ঠে গাইড ডাকছে, -পাইদ্জুম বিস্ত্রা।

দাভায়!দাভায়! সেও যে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দুর থেকে ছুটে আসা কয়েক জোড়া কুকুরের ডাকে সচকিত হয়ে আবার দৌড়। ধেয়ে আসছে কাছে আরো কাছে সীমান্ত রক্ষীদের বহু যতনে লালিল একঝাক ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুরের দল। তার সাথে বরফের উপর পড়ে দেবে যাওয়া ভারী বুটের অস্পস্ট ভোতা শব্দ। আঃ আর যে পারিনা! অন্ধকার এই পথের শেষ কোথায় আমরা কেউ জানিনা।

শুধু অন্ধের মত এগিয়ে চলা। হাত পা অসাড় হয়ে গেছে সেই কত আগে! এখন মনে হচ্ছে না কিছুই মনে হচ্ছে না। সে অনুভুতি আমাদের কারো নেই। এখন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য পিছনে ধেয়ে আসা ভয়ংকর জন্তুগুলোর হাত থেকে নিজেকে বাচানো । হায়! এও কিসম্ভব? দৌড়ে যাচ্ছে ২০জন বঙ্গ যুবক।

গাইডের চিৎকার -দাভায় বিসত্রা! দাভায়। জোরে! আরো জোরে! কেন? কিসের জন্য? কি অপরাধে? কার অপরাধে তাদের এই আনন্দ ভ্রমন !!! আচমকা পিছনে কড়মড় করে কিছু একটা ভেঙ্গে পরার শব্দ। সেই সাথে বিভৎস আর্তনাত! তাকিয়ে দেখি বন্ধু আমার বরফের চাই ভেঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে। কখনো একফুট কখনো আধাফুট কখনোবা তারও কম দুরুত্বে ঠিক আমার ওই বুটের নীছে ওৎ পেতে আছে হিম শীতল তরল মৃত্য! ঠিক ওখানটা এক মুহুর্ত আগে আমিও পেরিয়ে এসেছি। একটু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার বৃথা চেস্টা করলাম।

পিছন থেকে কেউ একজন আমার কাধ খামচে ধরে হ্যাচকা টান দিল। কি বলল বুঝলাম না। বোঝার মত শক্তি তখন ছিল না। হয়তো সে বলেছে ‘তুইও মরবি শালা!’ ঠিক তখুনি গুলির আওয়াজ। জলন্ত সিসের টুকরোগুলো বাতাসে শিস কেটে অন্ধকারের বুক চিরে সামান্য দুর দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম! ’ ওরা এত কাছে চলে এসেছে! নাঃ আর পারিনা-হাল ছেড়ে দেই যা হয় হবে।

আবার গর্জে উঠল বন্দুক সেই সাথে একদঙ্গল কুকুরের তারস্বরে চিৎকার!নাঃ বাচতে আমাকে হবেই - দাভায় বিসত্রা -বেজি! -দৌড় দৌড় আরো জোড়ে দৌড়! বলতে পারিনা কতক্ষন দৌড়েছি। যখন হুশ ফিরল তখন দেখি, উপুর হয়ে পড়ে আছি হালকা তুষারে ঢাকা বিস্তৃর্ন এক মাঠের উপর। চারিদিকে একটিবার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না-আর কি কেউ আছে না নেই। মনে হল এখানটাতেই চিরদিন শুয়ে থাকি। কেউ একজন কাধের কাছের পশমের ওভার কোটটা খামচে ধরে হ্যাচকা টান মেরে আমাকে দাড় করাল।

তখুনি পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই আবার পতন ঠেকাল। কানের কাছে টের পেলাম গরম নিঃশ্বাস,সে বলছে কিছু অদ্ভুত অচেনা ভাষায়। সেভাবেই আমাকে এক রকম টেনে নিয়ে চলল কোথাও। কোথায় যাচ্ছি আমার জানার আগ্রহ নেই।

বেচে আছি এই ঢেঢ় বেশী। আবার জ্ঞান হারালাম । এবার নিজেকে আবিস্কার করলাম গাড়িতে। না পুলিশের হাতে পরিনি। সেবার ঠিক ঠিকই পৌছে গিয়ে ছিলাম আমার গন্তব্যে।

বুখারেস্ট। রুমানিয়ার রাজধানী। এখানে আবার সল্পকালীন বিরতি। সেই জীবন .. একঘরে আটকে থাকা দিনের পর দিন। আর অপেক্ষায় থাকা আরেকটা ডাঙ্কির।

এই ক’দিনেই কি ভুলে গেছি মালদোভা থেকে রোমানিয়া ঢোকার সেই দুঃসহ কস্টকর স্মৃতি - বন্ধু হারানোর বেদনা? না কিছুই ভুলিনি .. চাইনা মনে করতে চাইনা .. কিচ্ছু মনে করতে চাইনা। ...ক্রমশ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।