মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!
ডাঙ্কি রুট-পর্ব-৬
১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা প্রায় মাইনাস দশ হবে। তার উপরে ঝড়ো বাতাস। দুপরের দিকে খুব কস্টে সৃস্টে ঘনমেঘের ফাক গলে সুর্য মহোদয় বড়জোড় আধা ঘন্টার জন্য নিজের ফ্যাকাশে প্রভা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিলেন। আবার কিভেবে গোমড়া মুখে আবার বিদায় নিয়েছেন।
কিন্তু তার সল্প কালীন আগমনে নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ আরো বেড়ে গেছে। শীতটা আরেকটু জাকালো হয়েছে। রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম। রুম হিটারের প্রচন্ড উত্তাপও সে ঠান্ডকে রুখতে হিমশিম খাচ্ছিল।
আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বসে ছিলাম।
হঠাৎ বন্ধুর ফোন বেজে উঠল । সে উঠে গিয়ে ফোন ধরল। রোমানিয়ান ভাষায় অনেকক্ষন ধরে কি যেন বলল। আমি হয় শোনার চেস্টা করিনি না হয় শুনলেও বুঝিনি।
টেলিফোন ছেড়ে খুব উৎফুল্য চিত্তে আমাকে বললেন।
‘ওই মিয়া - ওঠেন রেডি হন। ’
আমি মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কপাল কুচকে তার দিকে তাকালাম। ‘ইয়াকি করে নাকি সে আমার সাথে। এই শীতে কম্বলের নীচ থেকে ক্রেন দিয়ে টেনেও আমাকে বের করতে পারবে না। ’
আমার চেহারা দেখে উনি বুঝলেন।
তার অনুরোধ আমার মনঃপুত হয়নি। তাই হেসে খোলসা করে দিলেন বের হবার কারন।
আরে ভাই আজকে ডাঙ্কি হবে। ওঠেন -ওঠেন তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। ’
‘কি বললেন ? ডাঙ্কি হবে এই শীতে! তারপর আবার ঝড়ো বাতাস।
লোক গুলোকে কি মেরে ফেলার চিন্তা করছেন নাকি?’
সে হেসে বলল,‘ মন বাজে দিনেই ডাঙ্কি হয়। আজকে বর্ডারে কড়াকড়ি কম থাকে!’
বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা না করলে পাছে তিনি মাইন্ড করেন সে কারনে,প্রচন্ড অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ধড়াচুড়া পরে বের হলাম। বাইরে বেরুতেই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় চোখে অন্ধকার দেখলাম। যা ভেবেছিলাম বাইরের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ!এর থেকে বাতাসহীন -৩৫ ডিগ্রি শীত অনেক সহনশীল!
মেইন রাস্তার পাশ ঘেষে একহাটু বরফের মাঝে দাড়িয়ে আছি। ট্যাক্সির দেখা নেই।
প্রচন্ড বাতাসের সাথে ভেসে আসা অতিসুক্ষ বরফ কনা গুলো চোখে মুখে সুচের মত বিধছে। মাথার উপরের টুপিটা আরো খানিকটা চোখের উপর নামিয়ে শরীর কুচকে জুবুথুবু হয়ে লাঠি হাতে ধরা বৃদ্ধের মত দাড়িয়ে আছি।
এই ঝড়ো হাওয়ায় দুমিটার সামনে তাকানোও দায়। প্রচন্ড শীতে শরীরের অনুভুতি শক্তিগুলো ভোতা হয়ে গেছে, সময়কাটানোর জন্য যে দুয়েকটা কথা বলব তারও উপায় নেই।
ঠোট দুটো পাথরের মত ভারী হয়ে গেছে, সে'দুটো ঠেলে অতিকস্টে শব্দের বাতাস বের করলেও তা এমন বিকৃত হয়ে যায়যে রুশ আর বাংলার পার্থক্য বোঝা যায় না! তাছাড়া ঝড়ো বাতাসের তোড়ে কথা মালা এলো মেলো ছুটোছুটি করে , বলতে হয় কয়েক বার।
সে এক দুঃসহ যন্ত্রনা। এর থেকে চুপ করে থাকা শ্রেয়।
আমারা থাকি এই ছোট শহরটা শেষ প্রান্তে এখানে গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা এমনিতেই কম তার উপর এমন দুর্যোগের দিন। আল্লায় জানে কি কপালে আছে। আরো কিছুক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকায় দৃস্টিশক্তি কেমন ঘোলা হয়ে এল।
মরবনা জানি তারপরেও ভাবছি মরনের ওপারের কথা ঠিক তখুনি-ভোঁস করে ঠিক আমার গা ঘেষে ঘোমটা দেয়া সাদা বরফে মোড়া বিশাল আকৃতির ভলগা ট্যাক্সি এসে থামল। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক জন্তু নাক দিয়ে ভোস ভোস করে ধোয়া ছাড়ছে। হঠাৎ এই ট্যাক্সির আগমন যদিও ছিল কিছুটা বিস্ময়কর- তবুও তখন তেমন কিছু মনে হয়নি,কেননা মনে হওয়ার মত অনুভুতি ছিল না।
কোন কথা না বলে দরজা খুলে ভিতরে সেধিয়ে গেলাম। ড্রাইভার ভদ্রলোকও কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে গাড়ি ছেড়ে দিলেন সেই সাথে হিটারটাও একটু বাড়িয়ে দিলেন।
উনি চলছেন শহর পানে - আমরা রাস্তার যেধারে দাড়িয়ে ছিলাম সেখানটায় ইঙ্গিত করে আমাদের গন্তব্য মুল শহর পানে। আর কোথায় যাব সে কথা জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর যে পাবে না সেটা ড্রাইভার ভদ্রলোক ভাল করেই জানে। কেননা এই অসাড় ঠোটে নিজের দেশীদের ভাষাই বোঝা যায় না আর আমরাতো বিদেশী!
ভিতরের গরম হাওয়ায় শরীরের সাড় ফিরে আসতে লাগল। সেই সাথে শুরু হল আরেক জ্বালা। মনে হচ্ছে কে যেন শত শহস্র সুচ দিয়ে চোখ মুখে খোচাচ্ছে ।
একটু ধাতস্ত হয়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে হাতের দস্তানা দিয়ে জানালার কাচ ঘষে বাইরে তাকালাম। অতি চেনা শহরটাকে কেমন যেন অচেনা ভুতুরে শহর মনে হচ্ছে।
ঘন্টাখানেক পরে শহরে অন্যপ্রান্তে রঙ বিবর্ন হয়ে যাওয়া ছ’তালা বিশাল এক বাড়ির সামনে থামলাম। লক্কর ঝক্কর লিফটে চড়ে পাচতলায় ৫৩নম্বর এপার্টমেন্টে গিয়ে পৌছুতেই হৈ হুল্লোড়ে চমকে উঠলাম। এমন দুর্যোগের দিনে আমাদের অপ্রত্যাশিত আগমন সেখানে বাস করা জনা বিশেক আদমের কাছে দারুন আনন্দের!
তারপর যখন শুনল তাদের বহু আকাঙ্খিত ডাঙ্কি আজকেই হবে তখন তাদের খুশী দেখে কে!হুড়ো হুড়ি করে দশ পনের মিনিটের মধ্যে নিজেদের তৈরি করে ফেলল।
এক এক করে ধড়াচুড়া পরে যখন সামনে এসে দাড়াল তখন সেই নানা রঙ্গের কিম্ভুত পোষাকে তাদের চেহারা চেনার উপায় ছিল না। তবে চোখের ভাষা বলে দেয় তাদের ঘোর অমানিশা আর মহা দুর্যোগ তাদেরকে রুখতে পারবে না। এমুহুর্তে তাদের কোন কিছুই কাছে দুজ্ঞেয় বা অগম্য নয়।
তাদের হাতে ধরা ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে হঠাৎ আমার সেই ডাঙ্কার বন্ধু খেঁকিয়ে উঠল- মিয়া ভাইরা কি কুটুম বাড়ি যাচ্ছেন কি? রাখেন এইসব। একদম ঝাড়া হাত পায়ে যেতে হবে।
'
একথা শুনে ওরা যেন একসাথে চুপসে গেল। কার প্রতিবাদ করার সাহস নেই। শুধু একে অপরের দিকে করুন বিষন্ন চোখে চাইল সেই নিরব দৃস্টি বলে দেয় অনেক অব্যাক্ত বেদনার কথা...
অবশেষে অনেক অনুরোধ উপরোধের পর তারা সামান্য কিছু নেয়ার অনুমুতি পেল। ব্যাগ ঘেটে সবাই সবার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বের করছে। সে এক দুর্লভ দৃশ্য! একেকজন ব্যাগ থেকে একটা কিছু বের করে আর পরম মমতা ভরে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা এইটেই কি তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কিনা?
কিছুক্ষন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে সেটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে আরেকটার দিকে মনোযোগী হয়।
তখন সেইটেই তার হৃদয়ে ঝড় তোলে।
অনেক ঘেটে ঘুটে শেষ মেষ কেউ তার অতি প্রিয়জনের দুখানা ছবি কেউবা ক’খানা চিঠি সাথে ছোট্ট কিছু নগন্য উপহার পকেটে কোমরে গুজে নেয়। ডাঙ্কারের ধমকা ধমকিতে আর সময়ের সল্পতার জন্যে সেগুলোও ভাল পকেটে পুরার সময় পেল না।
বের হবার সময় তারা বার বার ফিরে ফিরে চাইছিল তাদের ফেলে যাওয়া জিনিস গুলোর দিকে যেন কোন প্রিয়জনকে ছেড়ে যাচ্ছে।
দু'য়েকজনের চোখের কোনে জল চিক চিক করে উঠল।
নীচে নেমে দেখি চারটে ট্রাক্সি দাড়িয়ে আছে। আমাদের দেখেই ড্রাইভাররা নেমে এল। বন্ধু ডাঙ্কারের তাদের উদ্দেশ্যে সন্মোধনে বুঝলাম ওদেরকে সে আগে থেকেই চেনে। তাড়া হুড়ো করে ২০ জন আদমকে চেপে চুপে তিন ট্যাক্সিতে বসানো হল। আর আমরা অন্য ট্যাক্সিটাতে চড়ে ছুটলাম।
চারিদিকে সতর্ক দৃস্টি হেনে দারুন দক্ষ হাতে শেফাররা গাড়ি চালাচ্ছে। যেন ঝড়ের গতিতে উড়ে চলছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছুটে চলল আঙ্গুর ক্ষেতের মাঝে ছোট রাস্তা দিয়ে। মাইলের পর মাইল বিস্তৃর্ন আঙ্গুর ক্ষেত - জনবসতি তেমন নজরে আসেনা॥
আরো এক ঘন্টা এভাবে চলার পরে ছোট্ট একটা বনে গিয়ে গাড়ি ভিড়ল। সাদা বরফে মোড়া বনের ন্যাড়া গাছ গুলোকে সৌম্য ঋষির মত লাগছিল।
ভাগ্যিস এখানে পথের ধারে দুচারটে ক্রিসমাস ট্রি দেখা যায় নাহলে শীতের দিনে এ দেশে কেউ এলে তাকে বিশ্বস করানো শক্ত ছিল যে এখানেও গাছের পাতা সবুজ হয়। ... ক্রমশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।