আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেথায় যে জন (২-য় পর্ব)



নীলেশ গ্লাসে হাল্কা চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করছিল মেয়েটা পুকুরের ধারে চলে গেছে। পুকুরের জলে ফুটে থাকা বড় বড় সাদা আর লাল শালুক দেখছে মুগ্ধ চোখে। বাংলাদেশ থেকে এই সব শালুকের বীজ আনিয়েছে নীলেশ। তাপস কিংবা বদু কেউই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করায় নি। তার আগেই অবশ্য মেয়েটা পায়ে পায়ে বাগানের ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।

তাপস একটু পরে ওদের পাশে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এসে বসল। শর্মিলা শাড়ির আঁচল ঠিক করার অজুহাতে তাপসের দিকে একটু বেশি রকম ঝুঁকে ওর শরীর থেকে উঠে আসা একটা অচেনা গন্ধ পেল। সুযোগ পেয়ে নিশ্চয়ই অঞ্জনাকে জাপ্টে ধরেছিল। কিন্তু পুরুষগুলো এত বোকা হয় কেন কে জানে! ওদের গায়ে অন্য মেয়ের গন্ধ যে দীর্ঘক্ষণ লেগে থাকে তা টেরই পায় না। কিন্তু অঞ্জনার শরীরে তাপসের গন্ধ পাবে না নীলেশ।

ছেলেদের গায়ের গন্ধ শুধু বাতাসই কয়েকমুহূর্ত ধরে রাখতে পারে, মেয়েদের শরীর নয়। শর্মিলার ইচ্ছে হচ্ছিল একটা বড় হাতুড়ি দিয়ে নীলেশের মাথায় আঘাত হানতে। ওর পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট দাঁতের ওপর শক্ত হয়ে চেপে বসছিল। নীলেশের সঙ্গে আজ একটা বোঝাপড়া করতেই হবে। নীলেশ তাপসের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল-- --অঞ্জনা কি করছে? এল না কেন? --বোধহয় রান্নাঘরে।

আসবে এখনি-- হাত বাড়িয়ে একটা গ্লাস তুলে নিল তাপস। শর্মিলা চাইছে তাপস একবার অন্তত: তার দিকে সরাসরি তাকাক। তাহলে শর্মিলা ভেবে নেবে ঘরের মধ্যে তাপস আর অঞ্জনার মধ্যে সামান্য একটু জড়াজড়ি ছাড়া আর কিছুই হয় নি। কিন্তু তাপস শর্মিলার দিকে ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছে না। তার মানে গাঢ়তর কিছু ঘটেছে স্বল্প সময়ের মধ্যেই।

তাপসের ভেতরে কি মানুষের ক্ষিদে ছাড়া আরো কিছু আছে? শর্মিলার মাথায় রক্ত চড়তে শুরু করল। অঞ্জনা এল একটু পরে। নীলেশ আড়চোখে অঞ্জনাকে দু'এক মুহূর্ত লক্ষ্য করে বুঝল ইতিমধ্যে ওর শরীরে কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখা দিয়ছিল যার আভাস নীলেশ দেখতে পাচ্ছে। এসব তো ওর খুবই চেনা। সব বুঝেও নীলেশ কি-ই বা করতে পারে? বাধা দেবার কিংবা মারামারি করার অবস্থানে ওরা কেউই নেই।

যে যার অবস্থানে ইচ্ছে মতো বিচরণ করার স্বাধীনতার অধিকারী। বিশেষ করে শিক্ষিত স্বচ্ছল আধুনিক পরিবারে। তাপসকে অঞ্জনা ভালবাসে, নীলেশকে বাসে না। কিন্তু অপছন্দও করে না। কাউকে ভালবাসার অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার সভ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা কিংবা নিলেও তা সুখকর হয় কি না নীলেশের মতো মানুষের পক্ষে তা যাচাই করা সম্ভব নয়।

শর্মিলার দিকে চোখ পড়তেই ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠল নীলেশ। শর্মিলা অপলকে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নীলেশ। বলল-- --তোরা চালিয়ে যা। আমি একটু দেখে আসি লেবাররা কি করছে।

না দেখলে খুব ফাঁকি দেয়। আসলে পুকুরের ধারে ইতস্তত: ঘুরতে থাকা মেয়েটার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছিল নীলেশ। মনে হচ্ছিল ওর সঙ্গে দুটো কথা বললে ভাল লাগবে। মেয়েটা ওদের সঙ্গে চেয়ারে এসে বসে নি। ওদের সঙ্গে গাল-গল্পে অংশ নেয় নি।

কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া দরকার। নীলেশ মেয়েটির ঠিক পেছন থেকে বলে উঠল-- --কি দেখছেন? চমকে উঠল মেয়েটা। দ্রুত ঘুরে তাকাল নীলেশের দিকে। একটু জড়োসড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করল-- --এই পুরো জায়গাটা আপনার? --হ্যাঁ। মোট আট একর মানে চব্বিশ বিঘে জমি আছে-- --এই পুকুর, ঐ আম-কাঁঠালের বাগান, ধানক্ষেত....এত এত নারকেল গাছ, ওদিকে ঐ হাঁস-মুরগী সব আপনার? --হ্যাঁ।

--পুকুরে মাছ আছে? --আছেই তো। ইলিশ মাছও আছে-- --যা:! পুকুরে আবার ইলিশ মাছ হয় নাকি? --হয়। বাঁচানো খুব কঠিন। দুপুরে এই পুকুরের ইলিশ মাছ ভাজা আর পাতুরী খাবেন। মেয়েটি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে পুকুরের প্রায় নিস্তরঙ্গ জলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

নীলেশ দেখল মেয়েটির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নীলেশ জিজ্ঞেস করল-- --আপনার নামটা কিন্তু জানা হয় নি। --জয়ন্তী। আচ্ছা, আপনাদের তো বাজারই করতে হয় না, না? সবই তো আছে-- --উল্টে কতকিছু রোজ বাজারে পাঠাতে হয়। ভারি ঝকমারির ব্যাপার।

জয়ন্তী আপনি ডাব খাবেন? --কে গাছে উঠবে? আপনি? বলে খিল খিল করে হেসে উঠল জয়ন্তী। নীলেশের মনে হল গোটা ফার্ম হাউস জুড়ে নীল-সবুজের সমুদ্র গড়িয়ে গেল। পুকুরের জল ঘেঁষে আগাছা পরিষ্কার করছিল একটি লোক। চটপট পুকুরে ঘষে ঘষে হাত ধুয়ে তরতর করে একটা ছোট নারকেল গাছে উঠে গেল। দুটো কচি ডাব ছিঁড়ে মাটিতে ধুপধাপ ফেলে দিল।

তারপর ফের তরতর করে নেমে এসে একটা হেঁসো দিয়ে ডাবের মুখ কেটে দু'জনের দিকে এগিয়ে দিল। চুমুক দিয়ে ডাবের জল খেতে গিয়ে জয়ন্তীর বুকের কাপড় একটু ভিজে গেল। এভাবে ডাব খাওয়ার অভ্যেস নেই ওর। ডাবে চুমুক দিতে দিতেই ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল গোলাপ বাগানের দিকে। কাছাকাছি এসে মুগ্ধ হয়ে গেল জয়ন্তী।

লাল হলুদ সাদা কালচে-লাল ছাড়াও আরো কত রঙের গোলাপ! এতরকমের গোলাপ একসঙ্গে জয়ন্তী কখনো চোখে দেখে নি। নীলেশ জিজ্ঞেস করল-- --গোলাপ ফুল ভালবাসেন? --বাহ্! কে না ভালবাসে? নীলেশ একটা গাঢ় লাল আর একটা হলুদ গোলাপ ছিঁড়ে ওর হাতে দিল। চোখে জল এসে যাচ্ছিল জয়ন্তীর। ভাললাগায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুবই নিচু স্বরে নীলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল-- --আপনি খুব সুন্দর মানুষ! তাজ্জব হয়ে গেল নীলেশ।

এত সহজে এমন হীরকদ্যুতি বিচ্ছুরিত কয়েকটা শব্দ যে কেউ উচ্চারণ করতে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিজের কানদুটোতে একবার হাত বুলিয়ে নিল। কথাটা বলে ইতিমধ্যেই জয়ন্তী কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। নীলেশ তাকাল দূরের তাপস-বদু-অঞ্জনা-শর্মিলাদের দিকে। ওরা সকলে এদিকেই তাকিয়ে আছে।

নীলেশের মনে হল ওরা নীলেশের সঙ্গে জয়ন্তীকে জড়িয়ে কিছু রুগ্ন কথা ভাবছে। অথচ নীলেশের মনে কোনো রুগ্ন ভাবনার ছায়াপাতও ঘটছে না। মনটা ওর অনেকদিন পরে অদ্ভুত এক ভাললাগায় ভরে উঠছে। জয়ন্তীর পিছু পিছু নীলেশ জটলার মাঝখানে এসে গেল। জয়ন্তীকে দেখামাত্র শর্মিলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল-- --ছেলেমেয়ে দু'টোকে চোখে চোখে রাখার জন্যেই তোমাকে আনা হয়েছিল।

কিন্তু তারা কোথায়? আর তুমিই বা কি করছিলে? আশ্চর্য! চকিতে একবার নীলেশের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল জয়ন্তী। গোলাপ ধরা হাতটা পেছনে লুকিয়ে রেখেছে। তন্দ্রা শর্মিলার পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল-- --সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? দেখো বাচ্চা দুটো কোথায় গেল? মাথা নিচু করেই দ্রুত চোখের সামনে থেকে পালালো জয়ন্তী। নীলেশের সামনে এসে দাঁড়াল অঞ্জনা-- --তুমি বোধহয় জানতে না জয়ন্তী শর্মিলার কাজের মেয়ে। এমনভাবে ডাব খাওয়াচ্ছিলে যেন তোমার হারানো প্রেমিকা-- --শুধু ডাব? জাহাঙ্গিরের স্টাইলে কেমন গোলাপ নিবেদন করল বলো? একটা প্রকাণ্ড ঢেঁকুড় তুলে ধুনোর মধ্যে ঝোড়ো বাতাস ছুঁড়ে দিল বদু।

শর্মিলা নীলেশের দিকে একটা তীব্র ধিক্কারের দৃষ্টি হেনে বলে উঠল-- -- তোমার কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না নীলেশদা। ছি:! অঞ্জনা শর্মিলার রক্তফোটা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসল। আসলে গোলাপ দুটো ওর খোঁপার বদলে চলে গেল কিনা ওরই কাজের মেয়ের হাতে! নীলেশ সকলের মুখের দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল-- --তোমরা বললে বলে জয়ন্তীর পরিচয় বদলে গেল। না হলে কয়েক মিনিট আগেও তোমাদের মতোই একজন ছিল আমার কাছে। আমার অন্তত: তাই মনে হচ্ছিল।

ডাবের জল কিংবা গোলাপ ফুল ওর প্রাপ্য ছিল। তোমাকে অঞ্জনা, যদি অচেনা কেউ কাজের মেয়ে কিংবা আরো খারাপ কিছু ভাবতো তাহলে সেটাই সেই মুহূর্তে তোমার পরিচিয় হত না কি? এখনকার এই মিথ্যের মতো? জয়ন্তীর সঙ্গে তোমাদের অবশ্যই একটা গুরুতর পার্থক্য আছে তা হল, জয়ন্তী তার নিজের বিন্দুতে স্থির এবং অত্যন্ত খাঁটি। তোমাদের তা কেন মনে হচ্ছে না বল তো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.