আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেথায় যে জন (১ম পর্ব)



জানি, গল্প পড়ার মতো সময় এবং ধৈর্য্য অনেকেরই খুব কম। তবু গল্প যারা ভালবাসেন সেই মুষ্টিমেয় পাঠকদের জন্য আর একটি গল্প! গল্পের নাম 'যেথায় যে জন'। । কুড়ি বিঘে জায়গা জুড়ে বিরাট ফার্ম হাইসের ঠিক মাঝখানের বাংলো প্যাটার্নের গেস্ট হাউসের সামনে তিনটে টাটা-সুমো এসে থামতেই নীলেশ বারন্দা থেকে নেমে এল। ওর পরনে সিল্কের একটা বাটিক-প্রিন্ট লুঙ্গি।

গায়ে হাফ-হাতা শর্ট-পাঞ্জাবি এবং বিস্ময়করভাবেই ওর পায়ে লাল ক্যাম্বিসের কেডস্! গাড়িগুলো থামার সঙ্গে সঙ্গে দু'পাশের দরজাগুলো ঝটপট খুলে গেল। দুটো বছর আট-দশের ছেলেমেয়েগাড়ি থেকে নেমেই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। । তিনজন মহিলা, দু'জন পুরুষও গাড়ি থেকে ধীরেসুস্থে নেমে নীলেশকে ঘিরে দাঁড়াল। স্বল্পকেশ এক রোগাটাইপের ভদ্রলোক, যার পরনে বারমুডা প্যান্ট ও গায়ে জেনিফার লোপেজের উচ্ছ্বল হাসি-আঁকা ঢলঢলে গেঞ্জি, নীলেশের সুপুষ্ট ডানহাত দুহাতে চেপে ধরে বলল-- --হাই নীলু! আমরা কিন্তু সত্যি সত্যি তোর ফার্ম হাউসে উইক-এণ্ড এনজয় করতে এলাম।

মানতেই হবে তোর সাহস আছে-- নীলেশ বৈদ্যনাথ বক্সির উচ্ছ্বাসের উত্তরে একটু গর্বের হাসি হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বক্সির বউ তন্দ্রা বক্সি যথারীতি তার চিরন্তন স্খলিত আঁচল সামলাতে সামলাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে নিজের আকর্ষণের ঝাঁঝালো তীব্রতাকে সকলের চকচকে চোখে ছড়িয়ে দিয়ে বলল-- -- নীলুদার হিম্মতই আলাদা। তোমাদের মতো দাসত্ব না করে দেখ তো কী সুন্দর একটা আস্ত নন্দন কানন বানিয়ে ফেলেছেন! সত্যি ভাবা যায় না-- --শেষ বাক্যটা একটু টেনে একপাক ঘুরে নিল তন্দ্রা। বদ্যিনাথ, যার যাক নাম বদু, তন্দ্রার এইসব ভাবভঙ্গিতে কেন যেন আজও বিচলিত বোধ করে। স্ত্রীকে আর পাঁচজন পুরুষের তুলনায় প্রথম প্রথম একটু বেশিই ভালবেসেছিল। কিন্তু স্বচ্ছল সংসারে এসে যত দ্রুত তন্দ্র আধুনিকা হচ্ছিল ততই বৈদ্যনাথ নামটা তাকে কাঁটার মতো বিঁধতে শুরু করেছিল।

একটা কর্পোরেট হাউসের এজিএম-এর নাম বৈদ্যনাথ বক্সি! শুধু তাই নয়, ওর ডাক নাম 'বদু'---প্রথম যেদিন ওই নামটা শুনেছিল সেদিন থেকে টানা সাতদিন তন্দ্রা তার শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি বৈদ্যনাথকে। বদুর কোনো কথাতেই তন্দ্রার মেজাজ নরম না হওয়াতে নীলেশ এবং তাপসের পরামর্শে বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজপত্র নিয়ে তন্দ্রার মুখোমুখি দাঁড়াল। কাগজপত্র হাতে নিয়ে গোল গোল বিস্ফারিত চোখে মেলে নতুন করে বৈদ্যনাথকে বুঝতে চেষ্টা করছিল তন্দ্রা। বৈদ্যনাথ যে তার নামের প্রাচীনতার কারণে আর অপমান সইতে রাজি নয়, সেটা তন্দ্রা বোঝামাত্র নিজের অবস্থানটাও স্পষ্ট বুঝে ফেলল। বৈদ্যনাথকে আচমকা বিমূঢ় করে তন্দ্রা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর।

অপ্রস্তুত বৈদ্যনাথ বেশ কিছু কিল-ঘুঁষি হজম করতে করতে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ছাপার অযোগ্য কিছু বিশেষণ সাহেবি ঢঙে উচ্চারণ করে যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত বৈদ্যনাথের নামের প্রাচীনতার ব্যাপারটা ভুলে যেতে পেরেছে তন্দ্রা। ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটেই বেরিয়ে এসেছে অঞ্জনা। নীলেশের বউ। অঞ্জনার সঙ্গে তাপসের একটা ইমোশন্যাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নীলেশের অজ্ঞাতেই।

তাপস একটা বড় মাপের নিউজ-হাউসের আর্ট-ডিরেক্টর। শান্তিনিকেতনের কলাভবন থেকে ছবি আঁকা শিখেছে। ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীতও গায়। মেয়েদের কাছে সঙ্গত কারণেই ওর একটা বিপজ্জনক আকর্ষণ আছে। তাপসের বউ শর্মিলা সেটা বোঝে এবং কিছু কিছু টের পায়।

যা টের পায় তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা করে সবসময়েই প্রায় বিমর্ষ থাকে। তাপসের উত্তপ্ত সঙ্গও ওকে উজ্জীবিত করতে পারে না। ফলে তাপসের মনেও মেঘের আনাগোনা লেগেই থাকে। গাড়ি থেকে নেমে তাপস অন্যমনস্কভাবে কিছুটা দূরের পুকুরটাকে ঘিরে থাকা নারকেল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। অঞ্জনাকে দ্রুত সিঁড়ি টপকে বারন্দা থেকে নেমে আসতে দেখে অঞ্জনার দিকেই তাকিয়ে থাকল নি:সঙ্কোচে।

শর্মিলার দৃষ্টি আটকে গেল তাপসের মুখের ওপর। তাপসের মুখের ওপর দেখতে পেল একঝলক আলো। শর্মিলার অন্তত: তাই মনে হল। নীলেশও অঞ্জনাকেই লক্ষ্য করছিল। বাচ্চাদুটো ছোটছুটি করতে করতে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছে।

নীলেশ দেখল এদের সঙ্গেই আসা একটা মেয়ে, বেশ ছিমছাম এবং মোটামুটি সুন্দরী, আপনমনে একা একা ফার্মহাউসের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীলেশ ওকে চিনতে পারল না। নামও জানে না। তবে মেয়েটির সাজ-সজ্জায় কোনোরকম উগ্রতা নেই, নেই অসহ্য আধুনিকতা। নীলেশের বেশ ভাল লাগছিল মেয়েটিকে।

দূর থেকে লক্ষ্য করছিল মাঝে মাঝে। বাংলোর ঠিক সামনেই একটু বাঁ দিক ঘেঁষে দু'টো বড় বড় রঙীন ছাতার নীচে বাঁশের তৈরি দুটো টেবিলের চারপাশে চারটে করে বাঁশেরই তৈরি চেয়ার পাতা আছে। আকর্ষণীয় ওদের গঠনশৈলি। বৈদ্যনাথ বা বদু দু'পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে একটা চেয়ারের ওপর নিজেকে প্রায় ভাসিয়ে দিল। বদুর রোগা রোগা দুটো পায়ের ছাড়ানো ভঙ্গি তন্দ্রা বক্সির মোটেও ভাল লাগছিল না।

একে তো বিদঘুটে পোষাক, তার ওপর ওই ভঙ্গি! বুড়ো ভামগুলো কেন যে ওই ঢোলা হাফ-প্যান্টগুলো পরে কে জানে! বিশ্রী লাগে দেখতে। চারপাশের মনোরম দৃশ্যের মাঝখানে বদুকে একটা জংলী কাঁটাঝোপের মতো অসহ্য লাগছিল তন্দ্রার। কিন্তু কিঠু করার নেই। একে একে তাপস শর্মিলা তন্দ্রা অঞ্জনা এবং নীলেশ চেয়ারে নিছকই আড্ডা মারার মেজাজে বসল। বদু জুত করে দুটো পা টেবিলের ওপর তুলতে গিয়ে তন্দ্রার চোখের দিকে চোখ পড়তেই সামলে নিল।

এতটা বাড়াবাড়ি তন্দ্রার পক্ষে বোধহয় আজ সহ্য করা সম্ভব হবে না। বদু অত:পর তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে নীলেশের দিকে তাকিয়ে বলল-- --একটু জলের ব্যবস্থা হয় না ব্রাদার! অঞ্জনা তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর রাখা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বৈদ্যনাথের দিকে এগিয়ে ধরতেই নীলেশ এবং বৈদ্যনাথ হো হো করে হেসে উঠল। শর্মিলা অঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল-- --বদু'দা মুখ ধোওয়ার জন্যে জল চায় নি। 'পান' করার জল চাইছে বোধহয়। বোধগম্য হল অঞ্জনার।

নীলেশ উঠে গেল ভেতরে। বদু অঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল-- --ব্রেকফাস্টের কি আয়োজন করেছ অঞ্জনা? --কি খাবেন বলুন? --কুচো চিংড়ি দিয়ে গরম গরম মটরডালের বড়া আর খাসির চর্বির বড়া খাওয়াতে পার? --নীলেশ জানত এসব লাগবে। আয়োজন আছে। নিয়ে আসছি এখনি। অঞ্জনা উঠে যেতেই শর্মিলা তাকালো তাপসের দিকে।

তাপস অঞ্জনার চলে যাওয়ার ছবি আঁকছিল মনে মনে। শর্মিলা মনে মনে সেই ছবির ওপর এক শিশি কালো রং ঢালছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই। নীলেশকে মনে মনে কামনা করে শর্মিলা। নীলেশের কথা-বার্তা, সৌন্দর্য্যবোধ, স্মার্টনেস এবং মেদহীন টানটান শরীর নিয়ে নিষিদ্ধ ভাবনায় ডুব দিতে ওর কোনো গ্লানিবোধ কেন হয় না তা বোঝে না। অঞ্জনাও তো তাপসের সঙ্গে.....একটু ঢোক গিললো শর্মিলা.....সত্যি কি কিছুই করে নি? নিশ্চয়ই কিছু গভীর গোপন ব্যাপার আছে।

নীলেশ কি কিছুই জানে না, নাকি বোঝে না! নীলেশ 'জল-টল' এবং আনুষঙ্গিক সব কিছু নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো। দু'টো বড় বড় প্লেটে সত্যি সত্যি কুচো চিংড়ি এবং খাসির চর্বির বড়া নিয়ে এল অঞ্জনা। বদু পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়ে বোতল আর গ্লাসের ওপর ঝুঁকে পড়ল। তাপস বলল-- --একটু মুখ-হাত ধুতে পারলে ভাল হত-- --ওয়াশরুমে যেতে চাস?' নীলেশ জানতে চাইল। --হ্যাঁ...মানে-- --ওকে ভেতরে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিয়ে এস অঞ্জনা-- নীলেশের কথায় তাজ্জব হয়ে গেল শর্মিলা।

তাপস আর অঞ্জনা ঘরের ভেতরে চলে গেল। নীলেশের মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে চাইছিল শর্মিলা। নীলেশ কি ইচ্ছে করেই তাপস আর অঞ্জনাকে অন্তরঙ্গ হতে সুযোগ দিল? অঞ্জনাকে না পাঠিয়ে তো তারই যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে? (শেষাংশ আগামীকাল)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.