আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বয়ং জননী (৩-য় ভাগ)



--কি ব্যাপার চিনতে পারছেন না সম্ভবত-- --বিদিশা! মানে...আপনি-- --হ্যাঁ। আমি ই বিদিশা সেন। বলতে বলতে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল বিদিশা। সামান্য হেলে বাঁ-পায়ের সঙ্গে ডান-পা জড়িয়ে বসার দরুণ বিদিশার আশ্চর্য শরীরে কিছু উথালপাতাল ঢেউ উঠল। বেদান্ত মুগ্ধতার অতলে তলিয়ে যেতে যেতেই বলল-- --এক গ্লাস জল পেলে ভালো হত-- --হ্যাঁ, এই যে জল এবং কফি এসে গেছে।

ধোপদুরস্ত বেয়ারা কাচের একটা ট্রের ওপর নিসর্গ আঁকা বিদেশি কাপে ধোঁয়া ওঠা দু'কাপ কফি এবং এক গ্লাস জল টি-টেবিলে রেখে নি:শব্দে চলে গেল। জলের গ্লাসটা তুলে নিতে নিতে বেদান্ত কাচের ট্রে'টা আর একবার ভালো করে দেখল। এর আগে এত সুদৃশ্য কাচের ট্রে ও দেখেনি। কফির কাপে আঁকা নিসর্গের ছবি দেখে বেদান্ত'র মনে হল এগুলো সম্ভবত ইটালিয়ান। অর্থের সঙ্গে আভিজাত্য না মিশলে অর্থ এবং উপকরণ এক সুরে বাজে না।

বিদিশার আভিজাত্য প্রতি সেন্টিমিটারে ঝলসে উঠছে অকৃত্রিমভাবেই! আভিজাত্যের প্রশ্নে আচমকাই নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতেই ভেতরে ভেতরে একটু কুঁকড়ে গেল বেদান্ত। ওর নিজের বংশগত বনেদিয়ানা এবং আভিজাত্য কিছু কম না হলেও সেটা গ্রামীণ এবং আর্থিক দিক থেকে বর্ণালী স্মৃতি ছাড়া বলার মতো এখন কিছু নেই। এই মুহূর্তে হাল্কা হলুদের ওপর কালো বাটিকের কাজ করা পাঞ্জাবি আর পা-জামা পরে আছে বেদান্ত। চশমাটা আধুনিক এবং পায়ে কোলাপুরী চপ্পল। এসবের মধ্যে কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য না থাকলেও বিদিশার সামনে তার উপস্থিতি যে যথেষ্ট অনুজ্জ্বল সে ব্যাপারে বেদান্ত নিশ্চিত।

যদিও ঠিক এইরকম অনুভূতি ওর জীবনে এই প্রথম। দ্রুত জলপান করে গ্লাসটা শব্দ না করে খুব সাবধানে ট্রে'র ওপর রেখে দিল বেদান্ত। বিদিশা সামান্য নীচু হয়ে কফির কাপ তুলে নিতে বেদান্ত'র চোখে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হল লকেটের লাল চুনি। বিদিশা কফির কাপ বেদান্ত'র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-- --কফি! কফির কাপটা নেওয়ার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেই বিদিশার আঙুল ছুঁয়ে ফেলল বেদান্ত। নারী শরীরের স্পর্শ এই প্রথম নয়।

তবু একটু শিহরিত হল! --কলকাতার তুলনায় এখানে গরম অনেক কম। এখন তো বলতে গেলে গরম লাগছেই না-- কফির কাপে শব্দ না করে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করল বেদান্ত। --গঙ্গার জল ছুঁয়ে বাতাস আসে এখানে। তাই হাওয়াটা গরম লাগে না। --আপনি কবিতা লেখেন? আচমকাই প্রশ্ন করল বেদান্ত।

--লিখতাম। অন্যের জন্য নয়। নিজের জন্যেই। এখনও দু'একটা---বলার মতো নয় কিছু তেমন-- --সম্প্রতি কিছু লিখেছেন? --শুনবেন? অবাক বেদান্ত বিদিশার চোখে চোখ রাখল-- --প্লিজ! --জলাশয় ততদূরে যতদূরে মানুষের মানবিক বোধ / একমাঠ সোনালি ধান উজ্জ্বল রোদ / জলাশয় ততদূরে যতদূরে যথার্থ মানুষের বাস / নিসর্গে ফুলের ছবি, নারী ও শিশুর উল্লাস / জলাশয় ততদূরে--- বলতে বলতে চুপ করে গেল বিদিশা। অবাক বেদান্ত অস্ফুটে বলে উঠল, আশ্চর্য! এসব লাইন শুধু আপনার জন্যেই গোপন রেখেছেন? --আরো কিছু আছে।

তবে এখন আর নয়। বেদান্ত আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ এখন কালো হয়ে গেছে। দু-একটা তারা যত্ন করে খুঁজলে চোখে পড়বে। চারপাশের সাজানো বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠল।

ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ব্যালকনির পরিবেশ এখন অনেকটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। আগের বেয়ারাটাই এবারে নিয়ে এল আইসপট। দুটো মিনারেল ওয়াটার। 'স্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট' হুইস্কির বোতল। দুটো দুর্দান্ত কাচের ড্রিঙ্ক-গ্লাস।

একপ্লেট হাল্কা বাদামি রঙের কাজুফ্রাই। বেয়ারাটা চলে যেতেই বিদিশা বলল-- --আমি জানি আপনার এসব মাঝে মাঝে চলে। আমার নিজের অবশ্য তেমন কোনো আর্জ নেই। তবে এক পেগ নিয়ে আমি আপনাকে বহুক্ষণ সঙ্গ দিতে পারি। কিন্তু আমার সামনে বসে পান করতে করতে আমি কাউকে বেহুঁশ হতে দিই না।

--আমি তেমন উচ্চ শ্রেণীর পান-রসিক নই। লিমিটি ক্রশ করি না। --জানি। তেমন কোনো খবর আমার কাছে নেই। --জানেন! আমার সম্পর্কে আপনি আর কি কি জানেন? বিদিশা আইসপট থেকে আইসকিউব গ্লাসে ফেলে বেদান্তর গ্লাসে একটু বেশি এবং নিজের গ্লাসে অনেক কম হুইস্কি ঢেলে জানতে চাইল-- --জল? --লাগবে না।

বরফ তো গলতেই থাকবে। --আমার কিন্তু লাগবে। সামান্য একটু জল নিজের গ্লাসে ঢেলে নিল বিদিশা। বেদান্ত'র দিকে তাকিয়ে বলল-- --আপনার একটি মেয়ে আছে। স্ত্রী পার্টি-ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত।

প্রায়শই বাপের বাড়িতে থাকেন। তাঁর বেশ কিছু ধনী বন্ধু আছে যাদের আমি চিনি। তাঁর নিজের দর্শন অনুযায়ী জীবন এনজয় করেন। আপনি লেখা-লেখি, পড়াশোনা, সভাসমিতি, বাকবিতণ্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আপনার বয়স বিয়াল্লিশ বছর তিনমাস চারদিন।

চেহারার বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার উপার্জনের সবটাই আপনার নিজস্ব যোগ্যতা নির্ভর এবং তার মধ্যে ময়লা নেই। এখনও আপনি বহু নারীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। প্রায় নি:সঙ্গ জীবনে এসব সুয্গে আপনি সময়ের অভাবে হারাচ্ছেন। সত্যি কি তাই? সময়াভাবই কি একমাত্র কারণ? --ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।

তবে মানসিক সংযোগের ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে গেলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না বলেই আমার বিশ্বাস। শুধুই শরীর--না, আই ডোন্ট বিলিভ সাচ রিলেশনস্! --ঠিক এই কারণেই আপনি জিনিয়াস এবং আপনাকে আমার প্রয়োজন সেই কারণেই। গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভেতরের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে বেদান্ত। ব্যাপারটা ঠিক কোনদিকে গড়াচ্ছে অনুমান করতে পারছে না কিছুতেই। সে এবারে সরাসরি প্রশ্ন করল-- --এখন বলুন কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন।

(শেষাংশ আজ রাতেই)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.