জাহাঙ্গীর আলম আকাশ, গোপালগঞ্জ-বরিশাল থেকে ফিরে :
'নির্বাচন এলেই আতংকিত হয়ে পড়ি আমরা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা। নির্বাচনের পর আমাদের অবস্থা কি হয় তা নিয়ে আমরা ভয় ও শংকার মধ্যে আছি। যে নির্বাচন আমাদের ওপর আক্রমণ বয়ে আনতে পারে সেই নির্বাচন কোনদিন না হলেই আমরা খুশি। নির্বাচনের আগে বা পরে যেন একটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বাড়ি ভাংচুর, লুট না হয়, সংখ্যালঘুরা যেন কোন ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার না হয় আমরা তার গ্যারান্টি চাই। হাসিনা বা খালেদা কে প্রধানমন্ত্রী হবেন কে সরকার গঠন করবেন তা নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
ভোটের চাইতে ধর্মীয় স¤প্রীতি আমাদের কাছে অনেক বড়। আমাদের দেশকে যেন আমরা আমাদের দেশই মনে করতে পারি। সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশিল সমাজসহ দেশী-বিদেশী সকল মানবাধিকার সংগঠনের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া। আর সেটা হলো শান্তিতে থাকা, সম্পদ, ঘর-বাড়ি রা করা। আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের সাথে সমান আচরণ করবে।
রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের নিয়ে কোন রাজনীতি করবে না। নিজের জান-মাল, ভিটেমাটি, জমি-ফসলাদী নিয়ে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার চাই আমরা। আমরা 'গণিমতের মাল' হতে চাই না। ' বৃহত্তর বরিশাল ও গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ উপরোক্ত প্রত্যাশার কথা জানালেন।
মানবাধিকার সংগঠন ও 'জাষ্টিজ ফাউন্ডেশন' ও 'ক্রিস্টিয়ান ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ’ এর যৌথ উদ্যোগে নির্বাচনপূর্ব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা পর্যবেণের জন্য অতি সম্প্রতি বরিশাল ও গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম।
ক্রিস্টিয়ান ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ এর উইলিয়াম গোমেজ ও জাষ্টিজ ফাউন্ডেশনের পক্ষে আমি নিজে এই পর্যবেক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করি। এসময় আমরা পর্যবেক্ষণ এলাকায় পেয়েছি ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সদস্য পিটার এগলফ, তিমথি প্যারিট, ম্যাক্রো মনটেনারী, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনষ্টিটিউট-এনডিআই এর নির্বাচন পর্যবেক নোরান এম প্যানালুংসং ও মাইকেল জন ভেরলিংককে। বিদেশী এই নির্বাচন পর্যবেকরাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্বাচনকেন্দ্রীক আতংক ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিস্তারিত কাহিনী শোনেন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
সরজমিন পর্যবেক্ষণকালে দেখা গেল, সংখ্যালঘুদের মাঝে হামলা-নির্যাতন আর লুটপাটের আতংক বিরাজ করছে। এই অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছে। বহু সংখ্যালঘু মানুষকে পাক বাহিনী পাখির মত নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। গোপালগঞ্জ-বরিশাল অঞ্চলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অনেক অনেক ইতিহাস জানে না আজকের তরুণ প্রজন্ম।
স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে অত্রাঞ্চলের সংখ্যালঘুরা মূলত: ভোট রাজনীতি ও ভূমির কারণে নির্যাতিত হচ্ছেন। বিভিন্ন নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটারের ভোট পাওয়া না পাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ধারী ক্যাডার আর সংখ্যালঘুদের ভূমি নানান কায়দা-কৌশলের মাধ্যমে গ্রাস করার জন্যে রাজনৈতিক পরিচয় বহনকারী প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা।
পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রকট সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা প্রশাসনের সহযোগিতা খুব কমই পান।
মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের সেক্রিফাইস : গোপালগঞ্জ উপজেলা সদরের হাটবাড়িয়া গ্রামের অধিবাসী ইতিহাসের অধ্যাপক প্রবীণ শিক্ষাবিদ সমাজসেবক সুখদেব বিশ্বাস জানালেন মুক্তিযুদ্ধের বহু অজানা ইতিহাস। তিনি বললেন, ভারতের লবনরদ শরনার্থী ক্যাম্পে বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ মানুষ (নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ) আশ্রয় নিয়েছিল। এখানে খাবারের সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন বহু শিশু মারা যেতো। শিশুদের মৃতদেহ ট্রাকে করে বাইরে নিয়ে গিয়ে দেয়া হতো গণকবর।
গোপালগঞ্জ সদরের পশ্চিমে মানিহার গ্রাম। এই গ্রামে একাত্তরের এপ্রিল কিংবা মে মাসে একসাথে ৭৫০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিনী। যাদের সকলেই কাপালী (হিন্দু) স¤প্রদায়ের লোক। বৌলতলী, সাতপাড়, ভেন্নাবাড়ীসহ পারিপাশ্বিক সমস্ত এলাকায় প্রতিদিন আসতো খান সেনারা। তারা হিন্দুদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করতো।
এমনও ঘটনা আছে, এক রশিতে বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে মানুষকে। বৌলতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাক সেনারা। বরিশাল, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের পাঁচ শতাধিক হিন্দু গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালায় পাক বাহিনী। কাটাখালী (মাদারীপুর বিলরুট ক্যানালে) নদীতে গানবোড নিয়ে আসতো খান সোনারা। গানবোর্ড থামিয়েই তারা পাখির মত গুলি করে মারতো হিন্দুদেরকে।
হিন্দুদের বাড়ি-ঘরের লুটকৃত মালামাল নৌকা ভর্তি করে নিয়ে যেতো পাক পশুর দল।
হিন্দুদের জমি হয়েছে শত্রু সম্পত্তি(এখন অর্পিত সম্পত্তি): গোপালগঞ্জ সদর থানার সাহাপুর ইউনিয়ন। এখানে একজন মানুষও নেই অন্য ধর্মের। সাহাপুরের সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই ইউনিয়নের পুরো এলাকাই হয়ে গেছে শত্র“ সম্পত্তি বা ইনিমি প্রপার্টি।
যা বর্তমানে ভেষ্টেট প্রপার্টি বা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত। একই অবস্থা গোপালগঞ্জ ও বরিশালের বহু গ্রামের। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলা সদরেও হিন্দুদের সম্পত্তি হয়ে গেছে ভেষ্টেট প্রপার্টি। ক্রমশ: দখল হয়ে যাচ্ছে হিন্দুদের জায়গা-জমি, বসতভিটা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংবাদিক বললেন, গোপালগঞ্জে দু’টি দল আছে।
একটি আওয়ামী লীগ, অন্যটি হিন্দুলীগ। কাজেই এখানে কারা কোন দলের ক্যাডাররা সংখ্যালঘু নির্যাতন করে তা স্পষ্ট করে বলার কোন দরকার আছে কি?
সংখ্যালঘুদের মাঝে গড়ে উঠছে পলায়নপর মানসিকতাঃ বরিশাল-গোপালগঞ্জে হিন্দুদের মাঝে গড়ে উঠছে পলায়নপর মানসিকতা। মেধা ও সম্পত্তি পাচার হচ্ছে ভারতে। নির্ভরশীল রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতেই নির্যাতিত হচ্ছেন হিন্দুরা। প্রশাসন, রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে কার্যকর সহযোগিতা না পেয়ে হিন্দুরা বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছেন।
যারা মাতৃভূমির মাটি আঁকড়ে ধরে থাকছেন তারাও মেধা ও সম্পত্তি পাচার করছেন ওদেশে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ী বললেন, গোপলগঞ্জ সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেড় লাখ ভোট পেলে বিএনপির প্রার্থী ভোট পায় (সর্বোচ্চ) মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার। কিন্তু তারপরও বিএনপির শাসনামলে অত নির্যাতন হয় না হিন্দুদের ওপর। গোপালগঞ্জে শতকরা ৫৪ শতাংশ হিন্দু ভোটার। বরিশালের উজিরপুরের মৃত কার্ত্তিক দাশের ছেলে গোবিন্দ দাশ জানালেন, অব্যাহত নির্যাতন ও হুমকির মুখে স্বাধীনতার পর শত শত পরিবার দেশ ছেড়ে চলে গেছে ভারতে।
উজিরপুরে এক সময় শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ হিন্দু বসবাস করতো। এখন হিন্দু মানুষ ৩০/৩৫ শতাংশের বেশি হবে না। স্বাধীনতার পর সংখ্যালঘুরা
হিন্দুলীগ নেতাদের ওপর যত আক্রোশ-আক্রমণ : ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-৩ আসনে হিন্দুলীগের প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দুলীগের মহাসচিব বীরেন্দ্র নাথ মৈত্র। আওয়ামী লীগ কর্মীরা বীরেন্দ্রনাথের নির্বাচনী ক্যাম্প ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। নির্বাচনী জনসভাও করতে দেয়া হয়নি তাকে।
হিন্দুলীগের কর্মীদের মারধোর করা হয়। এই আসনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। বাংলাদেশ হিন্দুলীগ কোটালীপাড়া থানা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিমল চন্দ্র বিশ্বাসকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোটালীপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের সামনে মারধোর করে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ওইদিন তার বাড়িও ভাংচুর করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিমলকে পুশকুনির (পুকুর) মধ্যে পানিতে ডুবানোর মত অমানবিক ঘটনাও ঘটে ওইসময়।
হিন্দুলীগ প্রার্থী বীরেন মৈত্রের পে কাজ করায় পরিমল চন্দ্রের ওপর মিলন ও রুহুল কবিরের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে হিন্দুলীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় আওয়ামী লীগ কর্মীরা পরিমল চন্দ্র বিশ্বাস ও ডা. সুনীল কুমার সরকারকে মারধোর করে। এসময় পরিমলের কাছ থেকে নগদ ৫ হাজার টাকা, মনোনয়নপত্র ও অন্যান্য কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয় হামলাকারিরা। এই ঘটনাটি ঘটে সাংবাদিক মোল্লা মহিউদ্দিন এর সম্মুখে।
নির্বাচনের আগেই মন্দির ভাংচুরঃ গোপালগঞ্জ সদরের হাটবাড়িয়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দির ভাংচুর হলো গত ৩১ অক্টোবর দিবাগত রাতে।
দৃর্বৃত্তরা মন্দিরের ৭টি মূর্তি ভাংচুর করে। মন্দির ভাঙ্গার ঘটনায় এলাকার হিন্দুদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার প্রেক্ষিতে মন্দির কমিটির সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস গত ৩ নভেম্বর গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা করেন (মামলা নং-৪, তাং-৩/১১/২০০৮, সকাল ৯টা ১৫ মি, ধারা-২৯৫/৪২৭ দন্ডবিধি)। মন্দির ভাঙার সন্দেহে পুলিশ করপাড়ার আহম মোল্লার দুই ছেলেকে গ্রেফতার করে। এদের একজন হলো আকিদুল।
কিন্তু ক’দিন পরই তারা জামিনে মুক্ত হন। মন্দির ভাঙ্গার ১০/১২ দিন আগে জমি দিয়ে হাঁটাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান মারামারি বাঁধে। যা গ্রাম্য সালিশে মীমাংশা করা হয়। মন্দির ভাঙ্গার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত দুইজনই আওয়ামী লীগ কর্মী। হাটবাড়িয়া উত্তরপাড়ার সতীশ চন্দ্র রায় (৮৫) বললেন, আমরা কি এবার পূজা করতে পারবো? তিনি সরকারের কাছে মন্দিরের সংস্কার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করলেন।
হিন্দু অধ্যুষিত আসনে মুসলমান প্রার্থীঃ গোপালগঞ্জে ৫৪ শতাংশ ভোটার হিন্দু। এখানে তিনটি নির্বাচনী এলাকায় এবার হিন্দু সংসদ সদস্য প্রার্থী নেই। হিন্দুলীগের প থেকে দলীয় প্রার্থী প্রতিদ্বদ্বিদ্বতা করতো। কিন্তু নির্বাচন কমিশন হিন্দুলীগকে নিবন্ধন করেনি। তাই হিন্দুলীগ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারছে না।
এই জেলায় আওয়ামী লীগ মুকুল বোসকেও মনোনয়ন দেয়নি। হিন্দুলীগের অভিযোগ, ২৯ ডিসেম্বরের পর ‘হিন্দুদেরকেব দেখিয়ে দেয়া হবে’ বলে একটি রাজনৈতিক দলের প থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
গোপালগঞ্জের বৌলতলী বাজারে ব্যবসায়ী লালমোহন বিশ্বাস (৫৩)’র কথায় হিন্দুদের মধ্যেকার অনৈক্য ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, আমাদের ধর্মের (হিন্দু) লোকেরা নির্বাচন করার সাহস পায় না। আমাদের স¤প্রদায়ের লোকেরা একতাবদ্ধ না।
সেলিম সাহেবকে (শেখ সেলিম) এলাকার সব মানুষই ভোট দেয় তাই আমিও দেই। তবে উনিতো এলাকায় আসেন না। কাজেই তিনি (শেখ সেলিম) এলাকায় জনসেবা কি করছেন তা তো বুঝতেই পারছেন।
সংখ্যালঘুদের নানান অভিযোগ : বরিশালের উজিরপুর উপজেলা সদরের অনিল আচার্যের স্ত্রী বকুল রানী আচার্য (৩৬) বললেন, আমাদের ১৮ শতাংশ জমির মধ্যে দেড় শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে জামায়াত সমর্থক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল করিম। এ ব্যাপারে স্থানীয় মুসলমান স¤প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের কাছে অভিযোগ করেছি।
কিন্তু কোন ফল পাইনি। একই ব্যক্তি সরকারী ভেষ্টেট প্রপার্টির ৬০ শতাংশ জায়গা লিজ নিয়ে কবরস্থান তৈরী করেছেন। সরকারী পুশকুনি আমাদেরকে ব্যবহার করতে দেয়া হয় না।
অব্যাহত হামলা, হুমকি, নির্যাতনে জর্জরিত উজিরপুরের মমতা চন্দ (৫৫)। তিনি অশ্র“সিক্ত নয়নে জানালেন, ‘আমরা কি বেঁচে থাকতে পারবো’? একই প্রশ্ন কানাই দাশের ছেলে শংকর দাশ (৩৭), সুনীল দাশ (৫০), অনিল চন্দ্র দাশ (৩৭), প্রয়াত চন্দ্র কান্ত হালদারের পুত্র সুশীল কুমার হালদার (৪৮), রাধা কান্ত দাশের ছেলে রাম দাশ (৩৯), প্রয়াত আনন্দ চন্দ্র দাশের ছেলে নিত্যানন্দ দাশ (৫৪), প্রয়াত গোপাল চন্দ্র নন্দীর ছেলে শংকর প্রসাদ নন্দী (৫৫), প্রয়াত কৃষ্ণ কান্ত নন্দীর ছেলে অমূল্য চন্দ্র নন্দী (৮১), প্রয়াত চন্দ্র কান্ত রায়ের ছেলে মতি লাল রায় (৬৫), মনোরঞ্জন চন্দ্র দাশের স্ত্রী মনিকা রানী দাশ ((৩০), প্রয়াত শরৎ চন্দ্র নন্দীর ছেলে নির্মল চন্দ্র নন্দী (৪৮), প্রয়াত নবকুমার মিস্ত্রীর ছেলে সুধীর কুমার মিস্ত্রী (৬০), প্রয়াত কৃষ্ণ কান্ত দাশের পুত্র শরৎ চন্দ্র দাশ (৫৫)সহ শত শত হিন্দু ধর্মাবলম্বীর।
গত ১৭ ডিসেম্বর উজিরপুরের সংখ্যালঘুরা এনডিআই নির্বাচন পর্যবেকদের এবং পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর ইউরোপীয় নির্বাচন পর্যবেক দলের সদস্যদের কাছে তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন, নিপীড়ন ও জায়গা-জমি দখলের কাহিনী তুলে ধরেন। প্রতিনিধি দলের কাছে সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ সকলে তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানালেন। নির্বাচন পূর্ব ও নির্বাচন উত্তর হামলা-নির্যাতন ও আক্রমণেল আশংকা-ভয়ে অনেকে ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়েছেন।
উজিরপুরের অনন্দ বিশ্বাসের ছেলে রঞ্জন বিশ্বাস সন্তোষ (২৫) জানালেন, ২০০১ এর নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে চাঁদাবাজি, সম্পদ লুটসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে সন্তোষের নামে স্থানীয় বিএনপি নেতা রতন শিউলীর মদদে ৪টি মামলা করা হয়। শ্রীকান্ত বিশ্বাসের পুত্র সব্যসাচী বিশ্বাস (২৪) বললেন, উজিরপুরের ডব্লিউ বি ইউনিয়ন ইনষ্টিটিউশন ভোট কেন্দ্রে ২০০১ সালের নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ সমর্থক এজেন্ট সিদ্দিকুর রহমান, জামাল, আলাউদ্দিন, রন্টু বাইনকে মারধোর করে বিএনপি ক্যাডাররা।
বিএনপির সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগ সমর্থক আলাউদ্দিনকে খালের পানিতে ফেলে দেয়।
কেস স্টাডি-১ : চতুর্মুখী নির্যাতনের মুখেও মাতৃভূমি আঁকড়ে থাকার লড়াইয়ে কান্ত দেবতোষ চন্দ ঃ ২০০৮ সালের ১৪ জুলাই সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেস্টা বরাবর দেয়া এক লিখিত অভিযোগে উজিরপুর থানার সাথে লাগোয়া প্রয়াত প্রমথ নাথ চন্দ’র ছেলে দেবতোষ চন্দ (৬৮) সংখ্যালঘু পরিবারের জানমাল ও সম্পত্তি রা এবং নিরাপত্তা বিধানের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার প্রধানের তরফ থেকে কোন সাড়া মেলেনি।
বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলাধীন জে.এল-৯২ নম্বর উজিরপুর মৌজার এস.এ ৮৩২ নং খতিয়ানভুক্ত হাল ৭৪৪ নং দাগে একটি দ্বিতল দালান ও একটি পাকা দূর্গা মন্ডপ ছিল। ১৯৬০ সালে উক্ত বাড়িটি ১১ আইনে আদালত কর্তৃক বিক্রিত হলে প্রমথ নাথ চন্দ আদালতের নিলামে অংশগ্রহণ করে বাড়িটি ক্রয় করেন।
বাড়িটির মোট জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৬২ একর। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ১৯৬১ সালে ২০/৬১ রিকুইজিশন কেসের মাধ্যমে থানা কৃষি অফিসের স্থান সংকুলানের জন্য বরিশালের জেলা প্রশাসক কর্তৃক রিকুইজিশন করা হয় এবং তার মাসিক ভাড়া নির্ধারণক্রমে ১৯৬২ সালের ১৩ জুন প্রমথ নাথ চন্দের নিকট হতে থানা কৃষি কর্মকর্তা ও থানা সমবায় কর্মকর্তা দখল বুঝে নেন। পরবর্তীতে প্রমথ নাথ চন্দ্রের আবেদনের প্রেেিত ১৯৬২ সালের ২৯ জুন বরিশালের জেলা প্রশাসক বাড়িটি ডি-রিকুইজিশনক্রমে মালিক বরাবর দখল হস্তান্তরের নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু অদ্যবধি মালিক বা তার উত্তরাধিকারীরর নিকট তা প্রত্যার্পন করা হয়নি।
এদিকে ইতোমধ্যে কতিপয় ভূমিদস্যুর নজর কাড়ে উক্ত বাড়ি ও সম্পত্তি।
১৯৬৯ সালের ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডার জারির বহু পূর্বে ১৯৬১ সনে প্রমথ নাথ চন্দ সরকারী নিলামে বাড়িটি ক্রয় করলেও স্থানীয় উপজেলা ভূমি অফিসের কতিপয় অসৎ কর্মচারির সহায়তায় অবৈধভাবে ১৯৮৭ সালে ৩৬/৮৬-৮৭ নং ভিপি কেস সৃজন করা হয়। ভিপি কেসের মাধ্যমে স্থানীয় ভূমিদস্যু সেকান্দার হাওলাদার, পিতা-আবদুর রব হাওলাদার, নূরুল ইসলাম হাওলাদার, পিতা-আজিজ হাওলাদার, মজিবর হাওলাদার, পিতা-মেনাজউদ্দিন হাওলাদার, সালাম খান, পিতা আম্মদ আলী খান গং জোরপূর্বক বাড়িটি দখল করে এবং দ্বিতল দালান ও পাকা দূর্গা মন্ডপ ভেঙ্গে ইট-খোয়া বিক্রি এবং ৮ লাধিক টাকার গাছ কেটে সাবাড় করে নেয়। ভূমিদস্যুরা এখনও বাড়িটি দখল করে আছে।
দেবতোষ চন্দ আপে করে বললেন, জেলা প্রশাসক হতে শুরু করে মন্ত্রনালয় পর্যন্ত বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়। কিন্তু ফল পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ে ভূঃমঃ/শা-৫/অর্পিত/৭৭-৭৮/৩৯৬ নম্বরে একটি নথি খোলা হয়। কিন্তু সর্বত্রই গরীবের আর্তনাদ নিস্ফল হয়ে ফিরিয়ে আসে। ভূমিদস্যুরা এতেই ান্ত নয়। তারা পূর্বোক্ত মৌজার এস.এ ৪১৭ নং খতিয়ানের হাল ৭৩৩ নং দাগের ১ দশমিক ৬৯ একর জমির ওপর দেবতোষের বাপ-ঠাকুর দাদা পরদাদার বসতভিটা। উক্ত বাড়ি থেকেও দেবতোষ চন্দ’র পরিবারকে উচ্ছেদের অসৎ উদ্দেশে দস্যুনেতা সেকান্দার হাওলাদার ও মজিবর হাওলাদারের পরামর্শে প্ররোচনায় ও মদদে এনায়েত হাওলাদার, পিতা-আজিমুদ্দিন হাওলাদার, আক্কাস রাঢ়ী, পিতা লেহাজউদ্দিন রাঢ়ী, মাখন লাল রায়, পিতা তরনী কান্ত রায় ও রাজ্জাক বালী, পিতা ছোনরউদ্দিন বালী দেবতোষের পরিবারের সদস্যদেরকে গৃহ অভ্যন্তরে আটকে রেখে কাঁচা ঘর স্থাপন করে দখল নেয়।
এ ব্যাপারে উজিরপুর সহকারী জজ আদালতে মামলা করলে আদালত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ এবং জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনকে দেবতোষের শান্তিপূর্ণ দখলে বিঘ্ন সৃষ্টি না করার জন্য স্থায়ীনিষেধাজ্ঞার আদেশ দেয়। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। স্থানীয় ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধ্য কর্মচারী ভূমিদস্যুদের সর্বদা সহায়তা করেই চলেছে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তনের পর দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে যৌথ বাহিনীর ভূমিকায় ভূমিদস্যুরা ৭৩৩ নং দাগের অবৈধ দখল দখলমুক্ত হয়। কিন্তু দস্যুদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই।
ভূমিগ্রাসী দুর্বৃত্তরা হামলা, হাঙ্গামা ও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। হামলার বিষয়ে থানায় জিডিসহ স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের কাছে অসংখ্য আবেদন করা হয় দেবতোষের পরিবারের প থেকে। সর্বশেষ ২০০৮ এর ১১ মে দিবাগত রাত অনুমান আড়াইটায় অন্যত্র চাল, বেড়া বানিয়ে পরিবহনযোগে তা এনে দেবতোষের বসতভিটা পুনরায় দখলের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু স্থানীয় জনতার প্রতিরোধ ও পুলিশের সহায়তায় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
দেবতোষ চন্দ ও তার পতœী মমতা চন্দ বললেন, ভূমিদস্যুগণ কখন কি ঘটায় তা বলা যায় না।
তাই আমরা সদা সর্বদা জানমাল হারানোর আশংকায় শঙ্কিত হয়ে ভয়-ভীতির মধ্যে কোন রকমে দিন অতিবাহিত করছি। ভূমিদস্যুগণ হুমকি দিয়ে বলছে, ‘তোদের বাড়ি ছাড়া নয়, তোদেরকে দেশ ছাড়া করব নয়তো স্বর্গে পাঠিয়ে দেব। ’ উল্লেখ্য, দেবতোষ চন্দ বরিশাল প্রধান ডাকঘরের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পোষ্ট মাষ্টার। দেবতোষ চন্দ জানালেন, ‘ভূমিদস্যুরা আমার বিরুদ্ধেমিথ্যা অভিযোগে ১৬/১৭টি মামলা করে। যার সবকটিতেই আমি বিজয়ী।
আর আমি যে মামলা করি সেটাতেও আমি ডিক্রি লাভ করি। আমাকে রা ও সহযোগিতা করার নামে ইশরাইল শরিফ নামে আরেক ভূমিদস্যু আমার কাছ থেকে কৌশলে ৮০ শতাংশ জমি দলিল করে নিয়েছে।
ভূমিদস্যুদের সন্ত্রাসী হামলার চিহ্ন মুছে যায়নি : সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম কমেনি। ২০০৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বেলা অনুমান ১১টায় দেবতোষ চন্দের বাড়ি আক্রমণ করে ভূমিদস্যুদের সন্ত্রাসী বাহিনী। বসতভিটা দখলের উদ্দেশে চালানো এই আক্রমণের সময় রাসেল হাওলাদার মোবাইল ফোনে তার পিতা এনায়েত হাওলাদারের সাথে কথা বলে।
রাসেল উচ্চস্বরে বলতে থাকে আব্বা কল্যাণ শালাকে শেষ করে দেব? ওপার থেকে এনায়েত হাওলাদারের নির্দেশ মত রাসেল ও তার সহযোগী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দেবতোষের ছেলে কল্যাণ চন্দ (৩৫) কে হত্যার উদ্দেশে তার নাক, কপাল ও মাথা ল্য করে লোহা ফুটানো কাঠের রুয়া দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এতে কল্যাণ গুরুতরভাবে রক্তাক্ত হন। কল্যাণের ওপর সেই আঘাতের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি। সেদিন হামলাকারী পশুর দল দেবতোষের স্ত্রী মমতা চন্দ ও তার পুত্রবধূ অপু চন্দকেও মারধোর করে। এতে মমতা চন্দ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন।
এ ঘটনায় দেবতোষ চন্দ উজিরপুর থানায় মামলা করতে গেলেও থানার পুলিশ মামলার এজাহার গ্রহণ করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করা হয়। যা এখন বিচারাধীন। এই মামলার পরবর্তী ধার্য্য তারিখ ১২ জানুয়ারি।
ভূমিদস্যুরা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ওয়ার্কাস পার্টির সমর্থক ঃ অভিযুক্ত দখলদার ভূমিদস্যুদের মধ্যে এনায়েত হাওলাদার (জাতীয় পার্টি), রাজ্জাক বালী (বিএনপি), নূরুল ইসলাম মাষ্টার (আওয়ামী লীগ), হুমায়ুন খান (বিএনপি), মজিবর রহমান (জাতীয় পার্টি), ফরিদ হাসেন শিকদার (ওয়ার্কাস পার্টি), সালাম খান (জামায়াত), সেকেন্দার আলী (বিএনপি)।
ভূমিদস্যু দখলদার চক্রের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে ‘এ’ আদ্যার নামে একজন আইনজীবী। এই আইনজীবী এলাকায় একজন সুবিধাবাদী হিসেবে সমধিক পরিচিত।
কেস স্টাডি-২ : হামলা-নির্যাতনে নিঃস্ব প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর পরিবারের সদস্যরা সর্বদা থাকেন আতংকে : বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলা সদরের প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র হাজার ১৯৫২ সালের ১১ আইনের নিলাম দ্বারা উজিরপুর জে.এল ৯২ নং উজিরপুর মৌজার মোকাম বরিশাল এস.এ খতিয়ান নং ৫৫/৮৪৩/৮৪৫/২৮০/৫৬১/৬২৬/৮৭২ মোট ৫ দশমিক ০৬ একর সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করেন। ১৯৫৯ সালে নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর নামে জমি রেকর্ড হয়। ১৯৭৭ সালে গুটিয়া ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান রশিদ মোল্লার নেতৃত্বে জাল নিলাম তৈরী করে এবং ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে রজব আলী ফকির, জহুরা খাতুন এবং আবুল কাশের নামে দেখানো হয় জমির রেকর্ড।
পরবর্তীতে তারা জমিতে একটি ঘরও তোলে। জাল নিলামের বিরুদ্ধে সেটেলমেন্ট অফিসে মামলা করে জমির মালিকানার স্বত্ত¡ লাভ করেন নারায়ণ চন্দ্র হাজারী।
নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর ছেলে বিদেশ চন্দ্র হাজারী (৩৩)’র দেয়া তথ্য মতে, ১৯৮১ সালে নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর ৪ একর ৬ শতাংশ জমি (বাড়িভিটাসহ) রশিদ মোল্লার মা জহুরা খাতুনের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে নিলাম করে রশিদ মোল্লা গং। বিদেশ হাজারী বললেন, দলিলপত্র পর্যালোচনা করে প্রশাসন সেই জালিয়াতির নিলাম বাতিল করে দেয়। এসময় আমার বাবাকে আলী আকাব্বার শিকদার সহযোগিতা করেন।
পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাবা আলী আকাব্বার শিকদারের নামে জমির অর্ধেক অংশ লিখে দেন। ১৯৮৭ সালে আলী আক্কাব্বার শিকদার তার নামে লিখে দেয়া জমির অংশ সোলেনামার মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে দেন আমার বাবা নারায়ণ চন্দ্রকে।
১৯৯৭ সালে আকাব্বার শিকদার এর ছেলে আউয়াল শিকদার বাবার নামে সেই অর্ধেক অংশ জমির মালিকানা দাবি করে মোকাম বরিশালের উজিরপুর সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা করে। এসময় আমি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চেয়ে ১২ ধারার একটি আবেদন করি বরিশালের পুলিশ সুপারের বরাবর। এরই প্রেেিত ৫ জন সশস্ত্র পুলিশ পাহারা দেয় ৯০ দিন যাবত।
২০০০ সালের ৪ এপ্রিল পুলিশ পাহারা না দিয়ে চলে যায় থানায়। সেই রাতেই আউয়াল শিকদার আমাদের জমির ওপর রাতের আঁধারে একটি ঘর তুলে। ঘর তুলে জমির দখল নেয়ার জন্য আউয়াল শিকদার ৪০০/৫০ সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির পাশে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটায়। বোমার প্রচন্ড শব্দে বাবা নারায়ণ চন্দ্র হাজারী হাটএ্যাটাক করেন। তাকে ভর্তি করা হয় উজিরপুর হাসপাতালে।
২০০০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে দখলদার ভূমিগ্রাসীর সন্ত্রাসী বাহিনী নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর ছেলে দীনেশ হাজারীকে অপহরণ করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। এরপর ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দীনেশকে মুক্ত করা হয়। একই সালের ৫ এপ্রিল দুপুর ১২টায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহসান কবির দুইপকে নিয়ে তার কার্যালয়ে মীমাংশা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে আউয়াল শিকদার গং ঘর তুলে নেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর উজিরপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাসদ সমর্থক আবুল কালাম আজাদ বাদল এর নেতৃত্ব ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।
২০০১ সালের ১৪ মার্চ আউয়াল শিকদারের মামলা খারিজ করে দেয় প্রশাসন। আউয়াল শিকদারের করা অন্য আরও ৫টি মামলা থেকে বাবা নারায়ণ চন্দ্র হাজারী ও আমরা তিন ভাই খালাস পাই। ২০০১ সালের ৯ জুন বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর সকাল অনুমান ৭টায় বিএনপির ২০/২৫ জন সশস্ত্র ক্যাডার বিদেশ হাজারীর বাড়ি আক্রমণ করে। লাঠি-সোঁটা, গাছের ডাল দিয়ে এলোপাতাড়ী পেটাতে থাকে বিদেশ হাজারীদের ওপর।
উজিরপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি লিখন নিজ হাতে গুলি করে বিদেশ হাজারীর বাম হাতের কনুইতে। সন্ত্রাসী হায়েনার দল বিদেশ হাজারীর মোটরসাইকেল লুট করে। গুরুতর আহতাবস্থায় বিদেশ হাজারী উজিরপুর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে যান। কিন্তু বিএনপি ক্যাডারদের ইশারা ও নির্দেশে চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করেনি। চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে বিদেশ হাজারী চলে যান ঢাকায়।
একই সালের ৫ অক্টোবর বিএনপি ক্যাডাররা বিদেশ হাজারীর বাড়ি-ঘর লুট করে। ২০০৭ সালের ৪ জুলাই হতে এখন পর্যন্ত আউয়াল শিকদার ও রাজ্জাক বালী গং বিদেশ হাজারী, তার দুই ভাই দীনেশ হাজারী ও বিক্রম হাজারীর নামে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনে অন্তত: ৯টি মামলা করে। এসব মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে বিদেশ হাজারীরা আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বিদেশ হাজারীর ওপর গুলি ও বাড়ি লুটের মামলা নেয়নি পুলিশ। বিদেশ হাজারী আয়েশা বেগম, রাজ্জাক বালী, আউয়াল শিকদারের শ্বশুর খালেক শিকদার গংদের বিরুদ্ধে জমির মালিকানা স্বত্ত¡ দাবি করে উজিরপুর সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা করেন (মামলা নং-৬৯/২০০৭)।
বিদেশ হাজারীর আশংকা : হয়ত নির্বাচনের দু’দিন আগে রাতে বাড়িতে এসে সন্ত্রাসীরা বলবে ‘ভোট দিতে যাবি না, গেলে অমুক মাকায় ভোট দিবি, নইলে জান থাকবে না। ’ তাই বিদেশ হাজারী ভাবেন ভোটের আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবেন অন্য কোথাও। বিদেশ হাজারীর অভিজ্ঞতা হলো, তত্ত¡বধায়ক সরকারের আমলে বরিশাল এলাকার হিন্দুরা মোটামুটি ভালই আছে। বিদেশ হাজারীর ভয় ও আতংক, রাজনৈতিক সরকার এলেই হিন্দুদের আতংক বেড়ে যায় কয়েকগুন। আতংক আর ভয়ে বিদেশ হাজারীর ভাই দীনেশ হাজারী পালিয়ে গেছেন বাড়ি ছেড়ে।
বিদেশ হাজারী আপে করে বললেন, পুলিশ প্রশাসন কখনও কোন সহযোগিতা করে না। ২০০১ সালের ২ অক্টোবর আমাকে গুলি করলো রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা। থানা গেলাম মামলা করতে। পুলিশ মামলা নিল না। এখন আমরা আতংকে-ভয়ে আছি।
আসলে আমাদের হিন্দুদের মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। ’
প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর পত্নী শোভা রানী হাজারী বললেন, 'আমরা ভয়ে আছি। আমাদের বেঁচে থাকায় মুশকিল বাবা। আমাদের দিকে একটু নজর দাও। '
ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক দলের প্রতিনিধিরা ১৮ ডিসেম্বর বিদেশ হাজারীর বাড়িতে গিয়ে অত্রাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের সাথে মতবিনিময করেন।
প্রতিনিধি দল সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও ভূমিগ্রাসের বিভিন্ন কাহিনী শোনেন। এসময় প্রতিনিধি দলের প থেকে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বলা হয়, 'আপনারা আপনাদের পছন্দের প্রার্থীকে আপনাদের সমস্যার কথাগুলো বলুন। এবং তাদের সহযোগিতা চান। আপনারা যারা দুর্বল তারা দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিন। আমরা আপনাদের সমস্যা ও পরিস্থিতিতে খুবই উদ্বিঘ্ন, আমরা আপনাদের বিষয়গুলো আমাদের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করবো।
জবাবে সংখ্যালঘুরা জানালেন, আসলে আমাদের সংখ্যালঘুদের প্রকৃত বন্ধু কেউ নেই। কারণ যারা বিভিন্ন দল থেকে প্রার্থী হন তাদের নানা রকমের হিসাব নিকাশ ও স্বার্থ রয়েছে। ফলে নির্যাতনকারীরা সব প্রার্থীর কাছ থেকেই সুবিধা পেয়ে থাকে।
বিরামহীন হামলা-হুমকির প্রেক্ষিতে বিদেশ হাজারীর পক্ষ থেকে বহু অভিযোগ করা হয় উজিরপুর থানাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক গত ২৩ জুলাই বরিশালের জেলা প্রশাসকের বরাবর একটি লিখিত অভিযোগে নারায়ণ চন্দ্র হাজারীর স্ত্রী শোভা রানী'র পরিবারের ওপর চাঁদা দাবি, সম্পত্তি দখলের চেষ্টা ও হত্যা প্রচেষ্টা এবং হুমকিদানের ঘটনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।
কিন্তু কোন কাজ হয়নি। সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যুদের হুমকি অব্যাহত আছে।
কেস স্টাডি-৩ : অমূল্য চন্দ্র নন্দীর মন্দির, জায়গা-জমি সবই বেদখল হয়ে যাচ্ছে : উজিরপুর উপজেলা সদরের বাজার সংলগ্ন বিশাল পরিসরের বাড়িটি প্রয়াত কৃষ্ণ কান্ত নন্দীর। তার ছেলে অমূল্য চন্দ্র নন্দীর বয়স এখন ৮৬ বছর। এই পরিবারটি ১৯৬৩ সাল হতে শান্তিপূর্ণভাবে ৫ একর ৩২ শতক জমির ওপর বসতভিটা করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছিলেন।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর ১৯৭০ সালে আবদুল হক শিকদার, পিতা-মৃত ওহাব আলী শিকদার একটি জাল ভুয়া ডিক্রি তৈরী করেন (ডিক্রি নং-৫৯/৭০)। এই ডিক্রি মামলা রুজুর তারিখ ২৫/২/৭০ এবং আদেশের তারিখ ২০/৫/৭০। যার মোট মেয়াদকাল ২ মাস ২৩ দন। পরবর্তীতে ভারতের বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে বরিশাল, গোপালগঞ্জ এলাকায় নির্বিচারে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, মন্দির ভাংচুর করা হয়। ওইসময়ে চিহ্নিত ভূমিদস্যু ফরিদ শিকদার গং, নুরু ইসলাম গং, আবদুল হক বালী গং (সাতলা) যৌথভাবে কৃষ্ণ কান্দ নন্দীর পরিবারের সদস্যদের জিম্মি রেখে সম্পতি রাতের আঁধারে দখল করে নেয়।
বর্তমানে পাকা বাড়ি তৈরী করে দখলদাররা তা ভোগ দখল করছে।
অমূল্য চন্দ্র নন্দী এই জবর দখলের বিরুদ্ধে উজিরপুর মুন্সেফ আদালতে মামলা করেন (মামলা নং-২৮/৯০)। এই মামলাটি বর্তমানে বরিশালের দ্বিতীয় সাব জজ আদালতে বিচারাধীন (নং-৪১৩/৯২)। অমূল্য নন্দী দৃঃখ ও হতাশামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, আমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় আজ প্রায় ২০ বছর ধরে মামলার কোন সুরাহা হচ্ছে না, আমরা পাচ্ছি না ন্যায় বিচার। প্রতিপ ৬২ বার সময়ের প্রার্থনা করে এবং তা আদালত মঞ্জুর করেছে।
বিরোধপূর্ণ জমির পরিমাণ ৪ একর ৯২ শতক। দখলদার বাহিনী শ্রী শ্রী শ্মশান কালী মন্দিরটিও দখল করে নিয়েছে কামাল শিকদার, জেলাল হক রাঢ়ী, ইস্কান্দার সরদার। মন্দিরটি উদ্ধারের জন্য গত ৪ ডিসেম্বর বরিশালের জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত আবেদন জানানো হয়। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
শুধু গোপালগঞ্জ-বরিশালই নয় গোটা দেশেই সংখ্যালঘুরা আতংকগ্রস্ত, শুরু হয়েছে নির্যাতন : ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরপরই বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের পরিকল্পিত হামলা-নর্যাতনের প্রধান ল্যবস্তু ছিল সংখ্যালঘুরা।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের সবচেয়ে ভয়াবহ ও রোমহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটে বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায়। সেই দুঃসহ নির্যাতনের ঘটনার কথা স্মরণ করে এখনও চমকে ওঠেন ওই অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ওইসব এলাকায় ফের নির্যাতন শুরু হয়েছে।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ৬ ডিসেম্বরের সংখ্যার রিপোর্টে বলা হয়, ২ ডিসেম্বর রাতে টরকী বন্দরের বার্ষিক কীর্তন শুনে বাড়ি ফেরার পথে আগৈলঝাড়ার বারপাইকা গ্রামের দিনমজুর জগদীশ বৈরাগীর পত্নী সুনিত্রী বৈরাগী (২৫)কে কাঞ্চন বেপারী ও ফিরোজ শিকদারের নেতৃত্বে একদল দৃর্বত্ত গণধর্ষণ করে। পরদিন ৩ ডিসেম্বর রাতে বিএনপি ক্যাডার রফিক চোকদার সংখ্যালঘু পলিন চন্দ্র বাড়ৈয়ের সম্মুখে তার কন্যা শোভা (১৪) কে ধর্ষণ চেষ্টা চালায়।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ক্যাবল ব্যবসায়ী বলাই কুন্ডুর বাড়িত দুর্বত্তরা ৪ ডিসেম্বর অগ্নিসংযোগ করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের রাত থেকে বিএনপি ক্যাডাররা ভোলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে গণলুট নির্যাতন চালায়। ওই রাতের তান্ডবে ২৮৭টি সংখ্যালঘু পরিবার নির্যাতনের শিকা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।