আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্মদিনের রাত কাটলো মসজিদে এবং...

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুস্পের হাসি

...রাত ১টা বেজে যাচ্ছে। চোখে ঘুম নেই। চোখের সামনে ভাসছে বাবা, সিদ্দিক মামা আর বড়মামাকে কবরে নামানোর স্মৃতি। আমার ঠিক বাম দিকের গহীন অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছেন তারা। মূল মসজিদের টিউব লাইটের আলো চোখে লাগছিলো বলে লেপের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে চারপাশ অন্ধকার করার চেষ্টা করলাম এবার।

যদি এতে ঘুম আসে। মিনিট দশেক এভাবে থাকার পর লেপের বাইরে যখন মাথা আনলাম তখন আমার বুকটা বেশ কেঁপে উঠলো। দেখলাম ঘরে কোন আলো নেই। নিভে গেছে মসিজদের টিউব লাইটের আলো। ... লেখাটা আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার লেখ্য অংশ।

ধর্মীয় অনভূতিকে ছোট দেখার কোন ইচ্ছে এই লেখায় বা আমার মাঝে নেই। মসজিদে একটা রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাই শুধু বর্ণনা করেছি ব্লগারদের জন্য। গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) জুম্মার নামাজ শেষে আমার বাবার স্মরণে একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয় আমার বাড়ির পাশের মসজিদে। মিলাদ শেষে যখন তবারক বিতরণ করছিলাম তখন পাশ থেকে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আমার বড় ভাইয়ের কাছে আমার খোঁজ করছিলেন। আমার সঙ্গে ছিলো আমার পাড়ার বন্ধুরা।

আমি কিছু না বুঝে সেক্রেটারির সামনে গিয়ে বললাম, ভাই, কি বলেন? উনি বললেন, ইমাম সাহেব আজ সিংড়া যাবেন। তুই একটু আসর, মাগরিব আর এশার নামাজটা পড়িয়ে দিস। আমি কি বলব বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। কারণ, এর আগে তিনটা জানাজার নামাজ পড়ানো ছাড়া নামাজ পড়ানোর আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। এসময় আশপাশের মুরুব্বীরা বললেন, পারবে, পারবে, ও-ই পারবে।

আমি মাথা নেড়ে রাজি হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি বন্ধুদের মুখ-চোখ কালো। রহস্য বুঝলাম না। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে চাবি বুঝে নিতে গিয়ে জানলাম ফজরের নামাজটিও পড়াতে হবে আমাকে। আসর, মাগরিব বা এশার ক্ষেত্র সমস্যা ছিলোনা। কিন্তু ফজরের নামাজ পড়াতে হলে রাতে মসজিদেই থাকতে হবে।

ভাবতেই অজানা ভয়ে গা কেঁপে উঠলো। মসজিদের বাইরে এসে পড়লাম বন্ধুদের রোষাণলে। বিকেলে আমাদের এক বন্ধুর বাসায় যাবার কথা। রাতের খাবারো সেখানেই সারবার কথা। নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব নেয়ার সময় এটা মনে ছিলো না।

অগত্যা, বন্ধুদের গালি হজম করেই ফিরতে হলো বাসায়। আসর, মাগরিব আর এশার নামাজ কী করে পড়ালাম তার বর্ণনা দিতে গেলে লেখাটা অনেক বড় হবে। ওই বর্ণনা পড়ে দেয়া যাবে। আজ দিই শুধু মসজিদে রাত কাটানো আর ফজরের নামাজ পড়ানোর বর্ণনা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হলাম।

বন্ধুদের পরামর্শে সঙ্গী হলো মামাতো সবুজ। লেপ, মশার কয়েল আর টর্চ লাইট হাতে দুজনে মিলে চললাম মসজিদে। আমাদের মসজিদের কাঠামোটা এরকম-মূল মসজিদের সাথেই ইমাম সাহেবের রুম। মূল মসজিদের ভেতরের একটি দরজা দিয়ে ওই রুমে যাওয়া যায়। রুমটার পাশেই এলাকার কবরস্থান।

কবরস্থানের পর বিস্তীর্ণ জমি। মানে পুরোটাই অন্ধকার। আমরা দুজনে মসজিদে ঢুকেই ইমাম সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়লাম। রাত পৌনে ১১টায় শেষ কবে ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেছি মনে নেই। তবে ওই রাতে ওই সময়েই শুয়ে পড়লাম।

ইমাম সাহেবের ঘরে দুটো বিছানা। একটা মূল সমজিদের সঙ্গে লাগোয়া। তারপাশেই মূল মসজিদে ঢোকার ছোট্ট দরজা। রুমে একটা গোল লাইট। সবুজ ওইটা নিভিয়ে মূল মসজিদের টিউব লাইট জ্বালিয়ে দিলো।

আমার দুজন শুয়ে পড়লাম। ডান কাত হতেই চোখে পড়ছে টিউব লাইটের আলো। টিনের ওপর গাছ বেয়ে পড়া শিশিরের শব্দ। সেইসাথে তাল মেলাবার চেষ্টা করছে ঝিঁঝিঁ পোকা। রুমের বামদিকে কবরস্থানের নির্জনতা।

সবমিলিয়ে ওই অবস্থা ব্যাখ্যা করার ভাষা এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই। অনেকক্ষণ শুয়ে আছি, ঘুম আসছে না। রাত পৌনে ১২টায় ফোন দিলো বন্ধু বাপ্পী। মোবাইল রিসিভ করতেই একটা গালি দিলো দেরিতে ফোন রিসিভ করার অপরাধে। লেপের ভেতর মাথা ডুকিয়ে ফিসফিসিয়ে যখন বললাম, `আমি মসজিদে'-তখন থামলো গালির স্রোত।

পরে কথা বলব বলে ফোন যখন কাটতে যাবো, তখন বাপ্পী বললো, `বন্ধু, শুভ জন্মদিন। ' ফোন রেখে বুঝলাম ১৩ ডিসেম্বর যে আমার জন্মদিন তা ভুলেই গিয়েছিলাম অজানা ভয়ে। আরো আতঙ্কে পড়লাম আরো অনেক ফোন আসবে রাত ১২টার পরে-এটা ভেবে। ঠিক ১২টা ২ মিনিটে ফোন এলো বনশ্রীর। `মসজিদে শুয়ে পরনারীর সঙ্গে মোবাইলে আলাপন! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা!' -এটা বলে জ্বিন মহোদয় এসে টুটি চেপে ধরতে পারে এই আশাঙ্কায় বনশ্রীর ফোন ধরলাম না।

দুবার ব্যর্থ হয়ে বন্ধু আমার থামলো আমি ঘুমিয়ে গেছি ভেবে। কিন্তু থামলো না জয়ীতা, স্বর্ণ, হেমলতা, জিতু, ফাহাদ কিংবা গণিমিয়া। ওরা ফোন দিয়েই যাচ্ছিলো। শেষমেষ গণিমিয়ার কল রিসিভ করতে বাধ্য হলাম। বেচারা ৯বার রিং দিয়ে ফেলেছে এরি মধ্যে।

রিসিভ করে মসজিদে আছি বলতেই নিচু কণ্ঠে বেচারা গণিমিয়া শুধু শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন রাখলো। রাত ১টা বেজে যাচ্ছে। চোখে ঘুম নেই। চোখের সামনে ভাসছে বাবা, সিদ্দিক মামা আর বড়মামাকে কবরে নামানোর স্মৃতি। আমার ঠিক বাম দিকের গহীন অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছেন তারা।

মূল মসজিদের টিউব লাইটের আলো চোখে লাগছিলো বলে লেপের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে চারপাশ অন্ধকার করার চেষ্টা করলাম এবার। যদি এতে ঘুম আসে। মিনিট দশেক এভাবে থাকার পর লেপের বাইরে যখন মাথা আনলাম তখন আমার বুকটা বেশ কেঁপে উঠলো। দেখলাম ঘরে কোন আলো নেই। নিভে গেছে মসিজদের টিউব লাইটের আলো।

চারপাশে অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থেমে গেছে। অন্যরকম একটা শব্দ চারপাশে। পাশে তাকিয়ে দেখি সবুজ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভয় পেলে মানুষের শরীর না কি হিম হয়ে আসে।

আমার দেখি উল্টো। গরমে লেপ গায়ে রাখতে পারছি না। ছোটবেলায় শুনেছি মসজিদে ফেরেশতারা থাকেন। মুরুব্বীদের কাছে জ্বিনের গল্পও শুনেছি। সে রকম কী কিছু ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে? হঠাৎ, মনে পড়লো, আচ্ছা, কারেন্ট চলে যায় নি তো? মনে পড়তেই মোবাইলের দিকে হাত বাড়ালাম।

উদ্দেশ্য পাড়ার কাউকে ফোন দিয়ে জানা যে, আসলেই কারেন্ট গেছে কি না। অবাক করা ব্যাপার, ফোনে হাত দিতেই আবার জ্বলে উঠলো টিউবলাইটের আলো। এতে ভয় গেলো আরো বেড়ে। তার মানে আমার মনের কথা কি কেউ পড়ে নিচ্ছে? এভাবে ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে একটা অবচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গেলাম। ঠিক ৫টায় ঘুম ভাঙলো।

দেখলাম, সব ঠিক আছে। ইমাম সাহেবের পূর্ব পরামর্শে সাড়ে ৫টায় ফজরের আজান দিয়ে মসজিদে বসলাম। তিনজন এলেন নামাজ পড়তে। পড়লাম ফজরের নামাজও। নামাজ পড়ানোর বিষয়টি আসর, মাগরিব ও এশার নামাজের বর্ণনার সঙ্গে অন্য একদিন বর্ণনা করা যাবে।

নামাজ শেষে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাসার দিকে বের হলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে শুধু মনে পড়ছিলো, এবারের জন্মদিনের শুরুটা একটু অন্যরকম হলো। মসজিদে রাত কাটানো এবং জন্মদিন। জন্মদিনের সঙ্গে মৃত্যুদিনের ভয়ও পেলাম। বুঝলাম, জীবনটারে কত ভালোবাসি।

১৮ ডিসেম্বর ২০০৮

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।