আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরুজীবন। ৮। লাল বাহিনীর খপ্পরে

দ্য কাপালিক ইজ ব্যাক

ভোর বেলা গোসল করে রেডি হয়ে মোবাইলটা খালি পকেটে নিয়ে যাচ্ছি মসজিদের দিকে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। একটু সামনে যেতেই দেখি লাল পুলিশের (আই.এস.এফ) গাড়ী একটা ঢুকছে গলির মাথায়। পাশের রোড দিয়ে চলে যাব কিনা চিন্তা করেও আবার মত পরিবর্তন করে দেখি নাই এমন একটা ভাব নিয়ে সোজা সামনে যেতে থাকি। কাতারে বিদেশীদের কাছে লাল পুলিশ হচ্ছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। বিশেষ করে অবৈধদের কাছে।

রমজানের আগ থেকে এরা খুব জোরে-সোরে অভিযান চালাচ্ছে অবৈধ শ্রমীকদের ধরার জন্য। ভোর বেলায় রাস্তায় বের হয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শ্রমীক দেখলেই ধরে ধরে আইডি কার্ড দেখছে। না পেলে সোজা হেডকোয়াটার। জেল-ভোগ এবং প্লেনের টিকেট জোগাড় করতে পারলে দেশে ফেরত।

মজার বিষয় হলো, এদের কাছে কোন অস্ত্র নাই। কেউ পালানোর চেষ্টা করলে তার পেছনে শুরু হয় দৌড়। ধরতে পারলে সমানে চড়। প্রতিদিন সকালে বাঙ্গালী আর নেপালী গাড়ী ভরে ভরে নিয়ে যাচ্ছে আমার পাশের এলাকা থেকে। যায়গাটার নাম "ন্যাশনাল"।

এটা কাতারে বাঙ্গালীদের আখড়া। কয়েকদিন আগে ভোর বেলায় ন্যাশনালের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাস-স্ট্যান্ড যাচ্ছি কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। হঠাৎ শুনি পেছন থেকে চিৎকার - "ওকিফ"। ঘুরে দেখি এক নেপালী দৌড়াচ্ছে, পেছনে লাল পুলিশ। রাস্তাটা আমার তিন-চার হাত পেছনে বাঁক নিয়ে আরেক দিকে চলে গেছে।

নেপালী সেই দিকে চলে যায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে। আর পুশিশ আমার পেছনে এসে দড়াম করে খায় এক আছাড়। উঠে আবার দৌঁড়। আমি সেদিকে না তাকিয়ে হাঁটতে থাকি সোজা। কারন তাকালেও বিপদ।

আরেকদিনের ঘটনা। রাস্তার পাশে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছি। পাশে অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে অপেক্ষা করছে স্কুল-বাসের জন্য। হঠাৎ এক মালবারী দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রাস্তা ক্রস করে। পেছনে লাল পুলিশ।

রাস্তার ওপারে গিয়ে মালবারী ধরা পরে। বেচারার কপাল খারাপ। পেছনে সিগনাল পড়ায় রাস্তাটা ছিল ফাঁকা। ধরেই ইচ্ছে মতো চড়। এরপর ধরে রাস্তার এই পাশে নিয়ে আসে গাড়ীতে উঠানোর জন্য।

বাঙ্গালী এক লেবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিল। এসে ওটাকে ধরেই এক চড়। "তুই কি দেখস? আইডি আছে?" নাই বলতেই সোজা গাড়ীতে। সন্ধ্যা বেলায় বাসায় ফিরে পাশের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, সে অবৈধ শ্রমীক। তারা এখনো ঘটনা কিছু জানে না।

এই হেন লাল পুলিশের গাড়ী দেখে পাশের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়ার চিন্তাটা বাদ দেয়ার কারন হলো, চলে যেতে দেখলে পালাচ্ছি মনে করে দৌঁড়িয়ে ধরবে, এরপর কিছু জিজ্ঞেস না করেই প্রথমে দিবে মাইর। তাই সোজাই যেতে থাকি। পাশে যেতেই গাড়ীর গ্লাস নামিয়ে এক পুলিশ হাত বের করে শুধু বলে "আইডি কার্ড দাও"। বলি কার্ড বাসায় রেখে এসেছি, মসজিদে যাচ্ছি নামাজ পড়তে। বাসা কাছেই।

বলে, ঠিক আছে, গাড়ীতে ওঠ। গাড়ীতে করে বাসায় নিয়ে আসে। এরা সাধারনত কারো বাসায় ঢোকে না। তিনজনে গার্ড দিয়ে আমাকে বাসায় ঢোকায়। রুমে এসে বলে, লাইট জ্বালাও।

লাইট জ্বালিয়ে কার্ড বের করে দেখাই। ওয়াকি-টকিতে আইডি নাম্বার হেডকোয়াটারে চেক করে দেখে এই পাসপোর্ট সেখানে জমা আছে কি না। নিশ্চিত হয়ে বলে, ঠিক আছে। রুম মেট শুয়ে ছিল কম্বল মুড়ি দিয়ে। এই ভোর বেলায় লাইট জ্বালাতে দেখে আমাকে কিছু বলার জন্য লাফ দিয়ে উঠে।

উল্টা তাকিয়ে পুলিশ দেখে নট-নরন-চরন। উঠে কোন কথা না বলে আইডি কার্ড বের করে। সে পাশের রুমে অবৈধ ইন্টারনেট টেলিফোনের দোকান চালায়। আমার সাথে লাইট নিয়ে একবার বড় ধরনের ঝগড়ার পর বলেছিলাম, পুলিশ খবর দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিব। এখন ভেবেছে আমি বোধ হয় পুলিশ নিয়ে এসেছি।

ভয়ের চোটে একবার নতুন আইডি কার্ড দিয়ে আবার পুরানটা বের করে দিয়ে বলে "এইটা পুরান"। পুলিশ বলে, লাগবে না। এই ব্যবসা ধরতে পারলে ২৫ হাজার রিয়েল জরিমানা, সেই সাথে ব্যাগ-এন্ড-ব্যাগেজ বাড়ী ফেরত। আমি যেতে পারি কি না জিজ্ঞেস করে বের হয়ে চলে আসি। গেইট দিয়ে যখন বের হচ্ছি, পুলিশরা বের হয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, এইখানে কোন অবৈধ লোক থাকে? বলি যে জানি না।

গেইটের পাশের রুমে নক করে আইডি চেক করে তারা চলে যায়। পেছনের রুমে একজন অবৈধ শ্রমীক থাকে। বাইরের লাইট না জ্বালানোয় সেই রুমটা দেখে নাই। সেই সাথে ইন্টারনেটের রুমটাও। অল্পের জন্য দু'টো পরিবার রক্ষা পেয়েছে।

সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরি, সবাই আমাকে ঘিরে ধরে। "ভাই, এইটা একটা কাজ করলেন? লাল পুলিশেরে বাড়ী চিনাইলেন? আইডি কার্ড নিয়া বাইর হইবেন না!" বলি, চিন্তা কইরেন না। এইবার থিকা বাথরুমে গেলেও আইডি কার্ড নিয়া যাব, ইনশাল্লাহ্।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।